জোবায়ের মিলন
Advertisement
‘অতলান্তিক প্রেম’ কবি রাশেদ রানার একটি কাব্যগ্রন্থ। রাশেদ রানা বয়সে নবীন না প্রবীণ, লেখার ধারায় নতুন না পুরাতন—তা প্রশ্নেই আসেনি; যখন তাকে পড়তে শুরু করি। তার কবিতা সরল নয়, সহজও নয়। কঠিনও নয়, জটিল নয়। তড়তড় করে পড়ে যাওয়ার মতো কাব্যকথা।
সে কথা যদি নতুনের হয় তবে তিনি নতুন, সে কথা যদি পুরানের হয় তবে তিনি পুরান। ভালো লাগাটাই প্রধান। ‘আমার অতলান্তিক প্রেম চক্ষুষ্মান হয়নি কখনো তোমার/ বহতা জীবন স্রোতের বৈপরীত্যে নিজেকে লুকিয়েছি বারবার।/ ...জরাজীর্ণতায় শীর্ণ হৃদয়, স্বপ্নগুলোর ফাঙ্গাস জমে/ কণ্টকহীন গোলাপের মাঝে ফ্যাকাসে আজ ধ্রুপদি প্রেম।’ (অতলান্তিক প্রেম)
‘একটা পুরো জীবন, একটা আকাশ সমান ভালোবাসা, এক সমুদ্র জলোচ্ছ্বাসের বিপ্লব, মহাশূন্যের সবটুকু হাকাকার লিখে দেওয়া যায় শুধু একটি কবিতায়। কবি নিজেকে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবকে, ছোট-বড় দেখা-অদেখা সব আকাঙ্ক্ষাকে কবিতার সূক্ষ্ম বুননে নকশায়িত করেন নিমিষে। একেকটা কবিতা যেন একেকটা বিমূর্ত মুহূর্ত। এ রকমই কিছু মুহূর্ত কারুকার্যময় শব্দের জালে বন্দি হয়ে, কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে ‘অতলান্তিক প্রেম’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয়। কিছু কবিতা কবির আঙুলে প্রেমিকের অমল আকাঙ্ক্ষার শাশ্বত রূপ হয়ে ভেসে উঠেছে আবার কিছু কবিতায় যেন একেকটা মুহূর্তকে রঙের পটে এঁকেছে বিচক্ষণ দর্শনে। কাব্যগ্রন্থটিতে কবিতার মোহিত শব্দগুলো শুধুই মোহর নয়, প্রতিটি শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে বিশদ অর্থের নিগড় হিসাবে। কবিতাগুলোয় ডুব দিলে দেখা যায়, সবগুলো কবিতার সবগুলো শব্দ স্বমহিমায় প্রতিভাত।’ কাব্যগ্রন্থটির মুখোকথায় এমনই বলেছেন কথাসাহিত্যিক ফৌজিয়া খান তামান্না।
Advertisement
কবির ভাষায়, ‘আকাঙ্ক্ষা, মনে কি পড়ে?/ এই তো গেলো বছর/ অগ্রহায়ণের ধুলি ওড়া ঝড়ে/ তুমি আমি গিয়েছিলাম নীপবনে,/ মেঘের আড়ালে ধুমকেতু হতে ঝরে পড়েছিলো উল্কাপিণ্ড।/ প্রচণ্ড উষ্ণতা ছেয়ে গিয়েছিলো দু-জনার দুটি মনে।/ অধরে অধর চেপে আকাণ্ড গিলেছি সুরা,/ মাতাল হাওয়ায় ভেসে উড়েছি মোরা/ মনে পড়ে আজও—/ অনাবাদী বুকে ছিলো কতটা মেঘ আর কতটা খরা।’
জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘কবিতার পৃথিবী মানেই তো স্বপ্নের পৃথিবী। আর সেই স্বপ্নের সারথি কমপক্ষে দুইজন: তুমি আর আমি। সেই দুইজনের একজন এখন রাশেদ রানা—কবির আদলে অবিনাশী প্রেমের যে আজন্ম যাযাবর। পরিযায়ী পাখির মতই কবি নিয়ত ভ্রমণপ্রবণ। প্রেম মানুষকে আত্মশুদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। রাশেদ রানা প্রেমে শুদ্ধচিত্ত, তাই কবিতার বয়ানে কথনভঙ্গির আঙ্গিকে লিখেছেন আজন্ম সাংরাগময় পঙক্তিমালা। চিত্তকল্প বা উপমার চেয়ে বোধের গভীরতাই তার কবিতার মূল শক্তি। রাশেদ রানা এঁকেছেন এমন এক শহরের চিত্র, যেখানে শ্বাস নেওয়ার অক্সিজেন নেই, ভালোবাসার বৃক্ষ নেই। অথচ রাশেদ রানা বিশ্বাস করে, ‘আজ থেকে সহস্র বছর পর পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছেয়ে যাবে প্রেম/ উচ্ছ্বসিত প্রেমিকের জুটি গা ভেজাবে প্রেমের নহরে’। অতলান্তিক প্রেমের কবি রাশেদ রানার এখানেই কাব্যসিদ্ধ।’
কবি যখন বলেন, ‘তবুও আমি নিয়ম করে প্রতীক্ষায় রই—/ দিন মাস বছর.../ খুঁজে বেড়াই পাহাড় থেকে জঙ্গল, অন্ধকার থেকে আলো,/ শহর থেকে শহর।/ আর নৈঃশব্দের উপাখ্যানে শুধু জমতে থাকে/ প্রতীক্ষারই বহর।’ (টান)। ফলে কাব্যগ্রন্থটি পাঠের পর উপর্যুক্ত জ্যেষ্ঠজনের মন্তব্য ছাড়িয়ে অধিক কিছু বলার নেই।
এছাড়া বলার কিছু নেই যে—আর একটু গভীরতা, আর একটু ভাবনা, আর একটু ছবির সংযোজন হলে সবগুলো কবিতা হয়ে উঠতে পারতো পূর্ণতৃপ্তির খোরাক। যা হয়েছে তা-ও মন্দ নয়। সর্বোপরি গ্রন্থটির প্রচ্ছদ, মলাট, পেস্টিং, বাইন্ডিং, পেপার সব মিলিয়ে সুন্দর একটি প্রকাশনা। আমি কাব্যগ্রন্থটির সুসাফল্য কামনা করছি।
Advertisement
বই: অতলান্তিক প্রেমধরন: কবিতা প্রচ্ছদ: সোহেল আশরাফ প্রকাশনী: চলন্তিকা প্রকাশকাল: ২০২১ দাম: ১৫০ টাকা।
এসইউ/জিকেএস