সাহিত্য

তরুণ কথাসাহিত্যিকের অনন্য কথকতা

আহমদ রফিক

Advertisement

হারুন পাশা (জন্ম ১০ নভেম্বর ১৯৯০) তরুণ কথাসাহিত্যিক; বয়সে নবীন হলেও লিখে যাচ্ছে নিষ্ঠার সাথে। লিখেছে এখন পর্যন্ত তিনটি উপন্যাস এবং গোটাবিশেক গল্প। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা প্রথম গল্প। তার উপন্যাসগুলো হলো—‘তিস্তা’, ‘চাকরিনামা’ এবং ‘বদলে যাওয়া ভূমি’।

‘তিস্তা’র প্রকাশসাল ২০১৭, ‘চাকরিনামা’ ২০১৮ এবং ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ ২০২১। হারুন পাশা পরিশ্রমী লেখক। লেখার জন্য পরিশ্রম করে এবং বিনিয়োগ করে দীর্ঘসময়। যতটুকু জেনেছি, তার প্রথম উপন্যাস ‘তিস্তা’ লিখেছে তিন বছর ধরে। এটা পরিশ্রম আর সময় বিনিয়োগের ভালো উদাহরণ। সে লেখে প্রস্তুতি নিয়ে। হারুন পাশার লেখায় কিছু কৌশল আছে। তার গল্প-উপন্যাসে লেখকের উপস্থিতি থাকে না। চরিত্ররা উপন্যাসে পালন করে মুখ্য ভূমিকা। শুরুর পর মধ্যভাগ বা উপন্যাসের পরিণতি আসে চরিত্রের কথকথায়। আবার এক চরিত্র গল্প শোনায় আরেক চরিত্রকে। চরিত্ররা কখনো আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, কখনো কথা বলে প্রমিত বয়ানে। উপন্যাসের ভেতরে রয়েছে ‘সংযুক্তি’ অংশ—এই সংযুক্তি উপন্যাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং এক কাহিনির সাথে আরেক কাহিনির লিঙ্কআপ বা সেতু হিসেবে ব্যবহৃত। এমন কৌশল প্রয়োগে পাশা নতুন ফর্মে লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ প্রাকরণিক অভিনবত্ব প্রশংসার দাবি রাখে।

হারুন পাশা কাজ করে বিচিত্র বিষয় নিয়ে। তার তিনটি উপন্যাস তিন রকমের বিষয় নিয়ে লেখা। ‘তিস্তা’ খরায় আক্রান্ত পানি না-থাকা তিস্তা নদী এবং তিস্তাপারের মানুষের বিপর্যস্ত জীবনকথা। ‘চাকরিনামা’ বেকার মানুষের হতাশা, জীবন যন্ত্রণা, সম্ভাবনা ও সাফল্যের আখ্যান। আর তৃতীয় উপন্যাস ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ করোনা মহামারিতে সংকটাপন্ন দেশ এবং দেশের বাইরের মানুষের জীবনকথা। তার তিনটি উপন্যাসেই আছে কোনো না-কোনো সংকটের কথা। অর্থাৎ তার কথাসাহিত্যে ব্যক্তি, সমাজ কিংবা দেশের সংকটময় অবস্থার চিত্র প্রকাশ পায়। এটা তার লেখার বিষয়গত বৈশিষ্ট্য। খ.হারুন পাশার প্রথম উপন্যাস ‘তিস্তা’। এটি তার অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের মূলভিত্তি তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার বিপর্যস্ত পরিবর্তন। এর ট্রাজিক চরিত্র এ ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। স্থানিক ও অস্থানিক মানুষের জীবন-নাট্যের বিচিত্র ও অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

Advertisement

দুর্ভাগা তিস্তাকে নিয়ে, তিস্তাপারের জীবনযাত্রা ও তার দুঃখজনক পরিণাম নিয়ে হারুন পাশার লেখা উপন্যাস ‘তিস্তা’, যা আসলে তিস্তাপাড়ের জীবনকথা। এ উপন্যাসের বাস্তব দিক হলো তিস্তাকে নিয়ে রাজনৈতিক চাতুরির তথ্যাদি, লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর সেই অভিজ্ঞতার নান্দনিক বিচার-বিশ্লেষণ। সেসব বাস্তবতাই উপন্যাসটির শিল্পরূপ তৈরি করেছে।

উপন্যাসটির প্রথম বৈশিষ্ট্য, এ রচনা লেখকপক্ষে বক্তব্য উপস্থাপনের বিবরণরীতি অনুসরণ করেনি। ছোটো ছোটো প্রতিটি অধ্যায়ে চরিত্রগুলোর সংলাপে উপন্যাসের কাহিনিবয়ান, যা প্রচলিতরীতি থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। এই রীতির একটি নান্দনিক সুবিধা, উপন্যাসের পাত্রপাত্রী তাদের কথকতার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ স্বতন্ত্র চারিত্র-বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটায়, লেখকের প্রত্যক্ষ ও ইচ্ছাটান সাহায্য ব্যতিরেক। এ প্রাকরণিক উদ্যোগ প্রশংসনীয়।দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা যে বিষয়টির ব্যাখ্যা রয়েছে লেখকের রচিত মুখবন্ধে তথা ‘কিছু কথা’য়। উপন্যাস, ছোটগল্পে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নতুন কিছু নয়। কিন্তু ‘তিস্তা’র অধিকাংশেই আঞ্চলিক ভাষায় সংলাপ, ভিন্নধারার চরিত্রের মুখে প্রমিত সাহিত্যভাষার ব্যবহার। তা সত্ত্বেও ‘তিস্তা’কে মূলত আঞ্চলিক ভাষার উপন্যাস বলা চলে। এ বৈশিষ্ট্যও উল্লেখযোগ্য।

এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট রাজনৈতিক, ভিতটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক। এর অন্তর্নিহিত চরিত্রে রয়েছে জীবনসংগ্রামের তথা লড়াইয়ের চিত্র। মানবসৃষ্ট সংকটের দূষিত পরিণামে মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন লড়াই তথা আন্দোলনের বিকল্প থাকে না। তারা আন্দোলনে নামে, পানির দাবি নিয়ে আন্দোলন। পানিপ্রাপ্তির আন্দোলনে সবাই এক হয়ে যায়। এ উপন্যাসে ইতিবাচক চরিত্রগুলোর পাশাপাশি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী চরিত্ররাও আন্দোলনে অংশ নেয়। আর জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ এসব সমস্যা তো আছেই।

সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সমকালীন বা উত্তরসূরি কারো কারো উপন্যাসে রাজনৈতিক লড়াইয়ের দৃশ্য দেখা যায়। ‘তিস্তা’ যেহেতু নদী-ভিত্তিক উপন্যাস, ফলে এখানে পানির দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর আরেক নাম জীবনযাপনের লড়াই, অথনৈতিক লড়াই। সমৃদ্ধ শ্রেণিবাদে নিম্নতর শ্রেণিতে জীবন মানেই এক সহিষ্ণু লড়াই। সেখানে রয়েছে হারজিত, যেমন রয়েছে ‘তিস্তা’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসের লড়াইয়ে রয়েছে শ্রেণি সংগ্রামের স্পর্শ। সেইসঙ্গে ক্ষমতালোভী শ্রেণির ষড়যন্ত্র, যা ব্যক্তিজীবনকেও স্পর্শ করেছে।

Advertisement

এ উপন্যাসে ঘটনা ও চরিত্র আপন স্বাতন্ত্র্যে বিশিষ্ট। এবং চরিত্রগুলো যথারীতি বিভিন্ন শ্রেণির। তিস্তা ব্যারেজ এ সংগ্রামের একটি প্রেক্ষাপট। সেখানে জমি অধিগ্রহণ, ঐতিহ্যবাহী দুনীর্তি এবং জমি মালিকের বঞ্চনা প্রথাসিদ্ধ বিষয়। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো একদিকে ব্যারেজ, অন্যদিকে জলবিহীন মুমূর্ষু তিস্তা তার সন্তানদের এমন দুর্বিপাকে ফেলে যে তাদের জীবনযাত্রার চিত্রটাই পাল্টে যায়। জলজীবী মানুষকে হতে হয় স্থলজীবী মানুষ—জীবন উঠে যায় শহরে বস্তিতে, সেখানে দুর্বিষহ জীবন; কখনো অন্যের বাড়িতে ঘর-বাড়ি মেরামত করার কাজ বা ব্লকে কাজ করে, কখনো রিকশাচালনায় কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু ফেলে আসা প্রাকৃত জীবন ঠিকই পিছু ডাকে।

তিস্তাপাড়ের কাহিনিতে এভাবে প্রতিফলিত জীবনের এক করুণ অধ্যায়, যাকে আমরা ভিন্ন ভাষায় বলি ট্রাজেডি। ‘তিস্তা’ তার সন্তানদের এই করুণ চিত্রটাই যথাযথ শব্দচিত্রে তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে নীতি-দুর্নীতির দ্বন্দ্ব, আছে প্রেম-অপ্রেমের কূট খেলা, যেমনটি আমরা দেখতে পাই চিরায়ত উপন্যাসে। আছে শুদ্ধ প্রেমের সুশ্রী বয়ান। এছাড়াও আছে রাজনীতির চৌকস খেলা, যা বাস্তবে প্রায়শ দেখা যায়। এখানে তা স্থানিক বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ পেয়েছে।

হারুন পাশার লেখা ‘তিস্তা’ উপন্যাসটি বহুমাত্রিক চরিত্র আখ্যানে পরিণতি লাভ করেছে। এখানে রয়েছে স্থানীয় রাজনীতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কূটনৈতিক রাজনীতি এবং তাতে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশিদের প্রতিক্রিয়া। আছে স্থানীয় জীবননাট্যের ট্রাজিক রূপায়ণ, তা যেমন ব্যক্তিগত তেমনি শ্রেণিগত। নীতি-দুর্নীতি, নৈতিকতা-অনৈতিকতার বাস্তব চিত্রণ।

এর মধ্যে একটি আকর্ষণীয় দিক হলো স্থানীয় লোকছড়া, লোকবিশ্বাস, লোকগীতি, ভাওয়াইয়ার লাগসই অনুষঙ্গ যা উপন্যাসটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। তবে সব কিছুর পেছনে নদীমাতৃক রাজনীতি ও সমাজনীতির চালচিত্রই প্রধান। বলাবাহুল্য সব কিছুর মূলে ঘটনাবলীর চালিকাশক্তি। কিন্তু ওই তিস্তা, যেন এক সজীব সত্তা, যে এক মানবসৃষ্ট গভীর অসুখে গতিহীন, মানবিক ভাষায় বলা যায় চলৎশক্তিহীন অবস্থায় পরিণত।

তরুণ হাতের রচনা প্রথম উপন্যাসটি সুলিখিত, আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে। মাঝে মধ্যে দর্শকের বক্তব্যে কিছু শৈল্পিক নাটকীয়তার প্রকাশ। লেখকের চেষ্টা এতে বহুমাত্রিক চরিত্রগুলোর সংযোজন ঘটানো। হারুন পাশা সেকাজটি যথাযথভাবেই সম্পন্ন করেছেন। বিশেষ করে তিস্তাপারের দুর্দশা-পীড়িত মানুষের জীবননাট্যের ট্রাজিক চিত্ররচনায়। সেখানে ঐতিহ্যধারারও রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।

একদিকে প্রকৃতির খেয়াল-খুশিতে স্থায়ী জীবনে ভাঙনের খেলা, অন্যদিকে মানবসৃষ্ট কৃত্রিম সংকটে মানুষের নিরাপত্তাহীন অসহায়তা। এ দুই ধারার অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে রয়েছে সামাজিকশক্তির টানাপড়েন, আবার শ্রেণি-বৈষম্যরও প্রকাশ। তিস্তাপারের বিপর্যস্ত জীবনচিত্রের বাস্তবরূপ প্রকাশ পেয়েছে ‘তিস্তা’ উপন্যাসটিতে।নদী, বালুচর, মানবসৃষ্ট বন্যা-ভাঙন এবং প্রাকৃত রূপের দ্বিমাত্রিকতা নিয়ে রচিত ‘তিস্তা’য় মানবজীবনেরও অনুরূপ চিত্রণ। জলই জীবন, পানিই জীবন এই বহুপ্রচলিত আপ্তবাক্যের বাস্তবতাও ধরা পড়েছে চরিত্রগুলোর জবানিতে। ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত ‘তিস্তা’ উপন্যাসটি মনোযোগী পাঠক ও আলোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

গ.হারুন পাশার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাকরিনামা’। এ উপন্যাসে মাহিন, আয়ান, জামসেদ এবং আনাফের মধ্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশের বেকারদের জীবনচিত্র প্রকাশিত। বেকার জীবনের হতাশা, ক্ষয়, সেখান থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে কর্ম পাওয়া এবং তাদের পছন্দের কাজটি ভালোভাবে করতে পারার আখ্যান চিত্রিত।

আমাদের সমাজবাস্তবতায় বেকারদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। তারা বিড়ম্বিত হয় ঘরে এবং ঘরের বাইরেও। তাদের আকাঙ্ক্ষা বা প্রতিবাদ কোনোটাই গুরুত্ব পায় না পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ, এমনকি প্রিয়তমার কাছেও। তাদের মেধা থাকে, প্রতিভা থাকে, কেবল থাকে না মেধা-প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ বা পেট্টোনাইজ করার মতো কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মতো রাষ্ট্রও তাদের সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেকারের সংখ্যা কম থাকলেও এখন এই সংখ্যা কল্পনাতীতভাবে বেড়ে গেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে।

এ উপন্যাসে উন্মোচিত হয়েছে চাকরিব্যবস্থার ভেতর বাস্তবতা, বিদ্যমান চাকরির সংকট-সমস্যা। চাকরি ব্যবস্থায় থাকা কোটা বৈষম্য কমাতে চরিত্র যুক্ত হয়েছে আন্দোলনে।

বেকারত্ব সাময়িক সমস্যা, অথচ এই সাময়িকতাকেই মেনে নিতে পারে না সমাজ এবং পরিবারের মানুষ। একদিকে বেকার হওয়ায় চরিত্ররা নিজেদের সব সময় সংকুচিত করে রাখে, অন্যদিকে পরিচিতদের বারবার জিজ্ঞাসা ‘চাকরি হলো’ এই উত্তরের মুখোমুখি হয়ে তারা নিজেদের একেবারেই গুটিয়ে ফেলে। নিজেদের মনে করতে থাকে সমাজ বিচ্ছিন্ন প্রাণি। প্রতিক্রিয়ায় বেপরোয়া হয়ে কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে পাচার চক্রের শোষণ ও নির্মমতার শিকার হয়।

বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট, পরিবার-পরিচিতদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও তারা সফল হওয়ার লক্ষ্যে নিজেদের তৈরি করতে থাকে। আমরা কেবল সাফল্যের সংবাদ শুনতে চাই কিন্তু সফল হতে সহযোগিতা করি না। নানা যন্ত্রণা, হতাশা এবং অসহযোগিতা সামলে সাফল্য এলে অন্যরা তাকে নিজের লোক হিসেবে ভেবে সুবিধা আদায়ে মাতে। কিন্তু সফলদের ফেলে আসা জীবনের যে ক্ষয় সেটার ভাগীদার কেউ হতে চায় না। বেকারত্ব কেবল ব্যক্তির দায় নয়, এ দায় রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রযন্ত্র তথা শাসক শ্রেণির। সর্বোপরি শাসন ব্যবহার। রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা হলো অধিক মানুষের কর্মের সুযোগ তৈরি করতে না পারা।

এ উপন্যাসে একটি ভালো দিক হলো সরকারি চাকরির বাইরেও যে বেসরকারি চাকরি করা যেতে পারে বা উদ্যোক্তা হওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। মানুষের সরকারি-চাকরিমুখীতা থেকে বের হওয়ার আহ্বান লক্ষণীয়। ব্যক্তি উদ্যোক্তা হয়ে জীবনে সমৃদ্ধি এনে পরবর্তীতে নিজের প্রতিষ্ঠানে বেকারের কর্মের ব্যবস্থা করতে পারে।

হারুন পাশার ‘চাকরিনামা’ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে তরুণদের মুখের ভাষা। তরুণরা যে ভাষায় প্রত্যহ কথা বলে সেই ভাষাতেই লিখিত হয়েছে চাকরিহীনের সংকট, সমস্যা এবং উত্তোরণ। লিখিত হয়েছে চাকরিব্যবস্থার ভেতর বাস্তবতার আখ্যান। সবাই যে বিসিএসমুখী হয়ে যাচ্ছে এবং শিল্প-সাহিত্য-গবেষণায় কেউ যাচ্ছে না—এতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তারও স্পষ্ট প্রকাশ আছে। সব মিলিয়ে ‘চাকরিনামা’ হয়েছে চাকরিহীনের দুর্দশার সঙ্গে সাফল্যেরও চিত্র।

ঘ.হারুন পাশার তৃতীয় উপন্যাস ‘বদলে যাওয়া ভূমি’। করোনা মহামারি নিয়ে অধিকতর পরিণত বয়ানে লেখা এ উপন্যাস।

বিশ্বমারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শেষপর্যন্ত বাংলাদেশেও আসে। রাজধানীতে আবির্ভূত এই ভাইরাস ক্রমশ বিস্তার ঘটায়। যা এক সময় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। করোনা সংক্রমণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, চিরাচরিত বহুমুখী সামাজিক দুর্নীতি, সরকারি ত্রাণপ্রচেষ্টায় জনপ্রতিনিধিসহ ব্যবসায়ীকুলের দুর্নীতি, নিম্নবর্গীয় মানুষের দুঃখকষ্ট সবকিছুই স্বল্প সংখ্যক চরিত্রের কথকতায় চিত্রিত। চরিত্রের কথকতায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাক্রম চিত্রিত হওয়া হারুন পাশার উপন্যাসের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য।

উপন্যাসটি ব্যতিক্রমধর্মী এই অর্থে যে, দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সফল গল্প-উপন্যাস সৃষ্টি হলেও মহামারী নিয়ে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের দেখা মেলে না। নাৎসী জার্মানির ফ্রান্স আক্রমণের দুর্দশার প্রতীকী উপন্যাস আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’ এক মহৎ সৃষ্টি। পাশার বইটির তুলনায় সেটি বেশ কিছু ভিন্ন চরিত্রের। সেদিক বিচারে হারুন পাশার করোনা মহামারীভিত্তিক উপন্যাসটির ভিন্নমাত্রিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এখানে মূল ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিক, বিশেষত সামষ্টিক বিচারে।

এ উপন্যাসের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এর অন্তর্নিহিত শ্রেণিচেতনা। করোনা ভাইরাসের টার্গেট ফুটপাতে ঘুমানো শ্রমিক বা দেহাতি মানুষ, বস্তিবাসীর তুলনায় নধরকান্তি, মেদস্থুল দেহের অধিকারী বিত্তবান, উচ্চশ্রেণির মানুষ। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী প্রভৃতি সুবিধাবাদী শ্রেণিও করোনার টার্গেট।

সমাজে, প্রশাসনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে যে দুর্নীতিচিত্র দীর্ঘ সময় ধরে চলছে স্বরূপ উদঘাটন এবং বিস্তার করোনা সংক্রমণের উপলক্ষে চিত্রিত। পাশাপাশি এর ইতিবাচক দিক দুর্নীতি ও অনৈতিকতা-বিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলন, নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবর্গীয়দের বেঁচে থাকার লড়াই। এককথায় উপন্যাসে ইতি ও নেতির দ্বৈত রূপের প্রকাশ আপন বৈশিষ্ট্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ যথাযথ প্রতীকের ব্যবহারে।

এ উপন্যাসে কেবল দেশের নয়, এসেছে বহির্বিশ্বের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকট। চরিত্ররা কেবল দেশে বিদ্যমান সমস্যা-সংকট নিয়েই চিন্তিত নয়, তারা খোঁজ রাখছে বহির্বিশ্বের সমস্যা ও সংকটের। কারণ যুগটা বিশ্বায়নের, দেশগুলো নানা স্বার্থে পরস্পর-সংশ্লিষ্ট।

এ উপন্যাসের আখ্যান দুটি পর্বে বিভক্ত। একটি হলো ‘ঘর আমার আপন হলো’ এবং অন্যটি ‘সবুজ ডগায় ধূসর নাচ’। আর এ উপন্যাসে যেহেতু লেখকের উপস্থিতি নেই সেহেতু এসেছে ‘সংযুক্তি’ অংশ। দুই পর্ব বা উপন্যাসের কাহিনির লিঙ্কআপ হলো এই ‘সংযুক্তি’।

‘বদলে যাওয়া ভূমি’ উপন্যাসে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হিশাম এবং সাব্বির। হিশাম ব্যবসা করত এবং সাব্বির চাকরি করত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

‘ঘর আমার আপন হলো’ হিশামের চিন্তা-ভাবনার নোট। যে চিন্তা-ভাবনা করোনার সময়ে তার নিজের, সমাজের মানুষের উদ্ভট কার্যক্রম, ব্যবসায়ীদের ধূর্ততা এবং করোনায় ঘটে যাওয়া নানা সংকট থেকে আগত।

‘সবুজ ডগায় ধূসর নাচ’ অংশ হলো সাব্বিরের জীবন, সংসার বা চারপাশে ঘটে যাওয়া সংকটের নোট। যেখান থেকে জানা যায় সাব্বিরের পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট এবং বাবা, ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের বউয়ের করোনায় আক্রান্ত হওয়া। জানা যায় সাব্বিরের অর্থ-সংকট, পরিবারে করোনা রোগী, চাকরি থাকা, না-থাকা নিয়ে তার সংশয়, এ অবস্থাতেও হাসিমুখে ছেলেমেয়েকে সময় দেওয়া, বউকে সংসারের কাজে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে সাব্বিরের বিপর্যস্ত জীবনের চিত্র।

এ উপন্যাসে করোনাক্রান্ত ভূমির সঙ্গে পাওয়া যায় করোনামুক্ত ভূমিও। উপন্যাসের শেষে চরিত্ররা আনন্দ করে করোনামুক্ত ভূমিতে। কারণ তখন তাদের হাতে এসে গেছে করোনার ভ্যাকসিন। আবার পাওয়া যায় অনেকেই যে আন্দোলন করছে তারও চিত্র। এ আন্দোলন করছে তারাই, যারা করোনাকালে চাকরি হারিয়েছে, যাদের আত্মীয়-স্বজন চিকিৎসা অবহেলায় মারা গেছে, মত প্রকাশ করতে গিয়ে আইসিটি আইনে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তির দাবিতেও হচ্ছে এ আন্দোলন।

সব কিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে স্বদেশ-বিদেশে বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তব উপাদান, সেইসঙ্গে সমাধানের সুস্পষ্ট আভাস-ইঙ্গিতে। চরিত্র প্রধান কাহিনি বর্ণনার নতুনত্ব তথা অভিনবত্ব পূর্ব উপন্যাসের চেয়েও এ উপন্যাসে অধিকতর কুশলতায় প্রতিফলিত। পাঠক এ উপন্যাসে করোনা সংক্রমণের বাস্তব ও নান্দনিক রূপচিত্রের প্রতিফলন দেখতে পাবেন। বিষয় নির্বাচন ও প্রকাশশৈলীর অভিনবত্বই এ উপন্যাসের বড় গুণ।

হারুন পাশার তিনটি উপন্যাসেই আন্দোলন দৃষ্টিগোচর। ‘তিস্তা’য় পানির জন্য আন্দোলন, ‘চাকরিনামা’য় কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন এবং ‘বদলে যাওয়া ভূমি’তে আন্দোলন দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্যখাত, আইসিটি আইনের বিরুদ্ধে ও চাকরি ফিরে পাওয়ার লক্ষে, এ আন্দোলন বিরাজমান সমাজ বদলের লক্ষে।

উপন্যাস তিনটিরই, বিশেষত শেষটির ভাষা আপনশৈলীতে সহজ, সরল, গতিময়, স্বভাবতই সুখপাঠ্য। উপন্যাসমাত্রেরই এটি অন্যতম একটি বড় গুণ যা উপন্যাসকে সৃষ্টির সার্থকতার পথে চালিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত কাহিনিবিন্যাসের কুশলতা ও সমাজবাস্তবতার যথার্থ চিত্রণ যা উপন্যাসকে পরিকল্পিত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। তারুণ্যেই হারুন পাশার উপন্যাস-সৃষ্টির যাত্রা সেই লক্ষ্যাভিমুখী সেকথা নিশ্চিত বলা যায়। এ যাত্রার পরিমাণ এবং অবশেষ ভবিষ্যৎ একমাত্র আগামীকালই বলার অধিকার রাখে। তবে আমি আশাবাদী। শ্রম, দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ সঠিক থাকলে অভাবিত অর্জনও সম্ভব। হারুন পাশা তরুণ কথাসাহিত্যিক বলেই শেষোক্ত কথাগুলো উপসংহারে বলা।

এসইউ/জিকেএস