খালিদ সাইফুল্লাহ্
Advertisement
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাঙিক্ষত পণ্য কেনাকাটা যেমন বাড়ছে তেমনি এই ই-কমার্স সেক্টরে উদ্যোক্তাদের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ধারণা করা হচ্ছে যে ই-কমার্সই হতে যাচ্ছে আগামীর কেনাকাটা করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে ই- কমার্সের মাধ্যমে কেনাকাটা চলে আসলেও এতদিন ছিল না কোনো সরকারপ্রণীত ই-কমার্স নীতিমালা এবং বাধ্যবাধকতা। দেশের ই-কমার্স ইকোসিস্টেম যথাযথভাবে গড়ে না ওঠা এবং বাধ্যবাধকতা না থাকার ফলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়কেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হত।
সম্প্রতি ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কার্যকর হতে যাচ্ছে "ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১" বা ই-কমার্স নীতিমালা। গত ৪ জুলাই "ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১" অনুমোদন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
Advertisement
এই নীতিমালা কার্যকর হলে ই-কমার্সে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে ক্রেতাবান্ধব পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং ই-কমার্সে জনসাধারণের আস্থা বাড়বে৷
পণ্য পরিশোধের পর ক্রেতা কয়দিন পণ্য পাবেন, মার্কেটপ্লেসের বিক্রেতারা কতদিনে পেমেন্ট পাবেন, "এসস্ক্রো" ব্যবস্থায় ক্রেতার টাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নকল ও ক্ষতিকর পণ্য, জুয়া, লটারি ও এমএলএম নিষিদ্ধকরণ, পণ্য দিতে ব্যর্থ হলে রিফান্ড বা টাকা ফেরতের সময়সীমা এবং এই নীতিমালা না মানলে আইনগত ব্যবস্থা সবই রয়েছে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায়। ক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এই নীতিমালায়।
দেখে নিই অনুমোদিত ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকায় ক্রেতার সুরক্ষায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট-
★ ই-কমার্স এর মাধ্যমে এমএলএম, জুয়া এবং লটারি ব্যবসা করা যাবে না।
Advertisement
★ বিক্রয় বিজ্ঞপ্তিতে কী পরিমাণ পণ্য স্টকে রয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে এবং পণ্যের স্টক হালনাগাদ করতে হবে। পণ্য বিক্রেতা বা চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে স্পষ্টভাবে “স্টকে নেই” বা “Stock out” কথাটি স্পষ্টভাবে পণ্যের পাশে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে রেডি টু শিপ অবস্থা ব্যতিরেখে কোন ধরনের পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না।
★ বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা পণ্য সামগ্রী ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার নিকট হস্তান্তর করতে হবে।
★ অগ্রিম মূল্য আদায়ের ক্ষেত্রে প্রদর্শিত পণ্য অবশ্যই দেশের ভিতরে 'রেডি টু শিপ' পর্যায়ে থাকতে হবে। সম্পূর্ণ মূল্য গ্রহণের পরবর্তি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি পারসন বা প্রতিষ্ঠাণের হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় নেই এমন পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্যমূল্যের ১০% এর বেশি অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে ১০০% পর্যন্ত অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে।
★ সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) দিন এবং ভিন্ন শহরে বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ (দশ) দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি প্রদান করতে হবে।
★ ক্রেতা কোনো মাধ্যমে অগ্রীম মূল্য পরিশোধ করলে এবং বিক্রেতা কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে সে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে মূল্য পরিশোধের সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে ক্রেতার পরিশোধিত সম্পূর্ণ অর্থ যে মাধ্যমে ক্রেতা অর্থ পরিশোধ করেছেন সেই একই মাধ্যমে ফেরত প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো চার্জ থাকলে মার্কেটপ্লেস বা বিক্রেতাকে তা বহন করতে হবে।
★ যেকোনো অভিযোগ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান করতে হবে।
★ নির্দেশিকার বিধান প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে কর্তৃপক্ষ বিক্রেতা বা মার্কেটপ্লেস এর ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট নিবন্ধন ইত্যাদি বাতিল করাসহ সংশ্লিষ্ট মার্কেটপ্লেস নিষিদ্ধকরণসহ অনান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
★ এ নির্দেশিকা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা ক্রেতা বা কোন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আইনানুগ প্রতিকারের জন্য অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।
বর্তমানে ই-কমার্সে কেনাকাটা করতে গিয়ে ক্রেতারা যেসব সমস্যার সন্মুখীন হন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- প্রতিশ্রুত সময়ে পণ্য না পাওয়া। এমনকি কয়েক মাসেও পণ্য না পাওয়া, বিক্রেতা কর্তৃক পণ্যের স্টক না জানিয়ে অধিক অর্ডার নিয়ে রিফান্ড পেতে ভোগান্তি।
বিক্রেতা পণ্য দিতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম টাকা ফেরত দিতে কয়েকমাস সময় নেয়া, কাস্টমার কেয়ারে অভিযোগ করলে সমাধান না পাওয়া ইত্যাদি। ক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষায় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায় এই বিষয়গুলোর স্পষ্ট নীতিমালা এবং বাধ্যবাধকতা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিক্রেতা এই নীতিমালা নীতিমালা না মানলে যথাযথ শাস্তির বিধান এবং ক্রেতা কর্তৃক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও উল্লেখ রয়েছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতার তোয়াক্কা না করে খেয়াল-খুশিমতো পরিচালনা করতে পারবে না।
ফলে ক্রেতাদের ভোগান্তির অবসান হবে। এতে করে ই-কমার্সে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, ই-কমার্সে ক্রেতার আস্থা বাড়বে, ফলে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়বে, একইসাথে ই-কমার্সে নতুন উদ্যোক্তাও বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থান হবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাব আমরা।
লেখক: ই-কমার্স এবং গণমাধ্যম কর্মী, সদস্য, মেম্বার'স ওয়েলফেয়ার কমিটি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ।
এমএমএফ/এএসএম