দেশের প্রযুক্তিখাতে যেসব নারী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন; তাদের অন্যমত সোনিয়া বশির কবির। সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করেছেন দীর্ঘ ১৫ বছর। কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডেলের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। মাইক্রোসফটের বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান এবং লাওস শাখার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন।
Advertisement
মাইক্রোসফট ছেড়ে শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠান এসবিকে টেক ভেঞ্চার এবং এসবিকে ফাউন্ডেশন। এছাড়াও ইউনাইটেড ন্যাশন গভর্নিং কাউন্সিলের বোর্ড মেম্বার এবং ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। ইউনেস্কোর অধীনে মহাত্মা গান্ধী ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ফর পিসের বোর্ড মেম্বার।
পাশাপাশি এফবিসিসিআইয়ের টেকনোলজি অ্যাডভাইজার এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে বোর্ড অব ট্রাস্টি হিসেবে আছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকারে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তিখাতের সফল এ নারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খালিদ সাইফুল্লাহ্—
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবসের গুরুত্ব কী রকম?
Advertisement
সোনিয়া বশির কবির: আমার মতে, নারী দিবস হচ্ছে একটা ওয়েস্টার্ন কনসেপ্ট। আমাদের দেশে আমি নারীদের নিয়ে অনেক কাজ করি, ইয়াং জেনারেশনদের নিয়ে অনেক কাজ করি, তাদের জন্য নারী দিবস অথবা ইন্টারন্যাশনাল ওমেন্স ডে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন না। দেখুন, এখন নারীরাও সবক্ষেত্রেই পুরুষদের সাথে কম্পিটিশন করছে। এমনকি প্রযুক্তি দুনিয়া- যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ পূর্বে অনেক কম ছিল এখন সেখানেও নারীরা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি যখন টেকনোলজি সেক্টরে ছেলেদের সাথে কঠিন কঠিন কম্পিটিশন করছি সেখানে ৩৬৫ দিনের একদিনকে নারী দিবস হিসেবে দেখা মানে মেয়েদেরকে ছোট করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ: পেশাগত সেক্টরে বাংলাদেশের নারীরা এখনও পিছিয়ে রয়েছেন। এর কারণ কি? এর প্রতিকারের উপায় কি?
সোনিয়া বশির কবির: দেখুন, নারীদের ক্ষেত্রে আমরা যদি মনে করি পড়াশোনা শেষ করেই সে খুব ভালো চাকরি করবে, লিডারশিপ পজিশনে আসবে, টপে উঠে যাবে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে- আমাদের এই চিন্তাটা বদলাতে হবে। কারণ এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেমন- ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা ফ্যামিলির ডিসিশন মেকিং-এ কম কথা বলে, চুপ থাকে, তাদের মতামত বলতে লজ্জা পায়। ছোটবেলা থেকে এইভাবে বেড়ে উঠলে হয়ত বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি গিয়েও তারা পিছিয়ে থাকবে, কাজেও পিছিয়ে থাকবে। কর্পোরেট বেশিরভাগ মিটিং-এ দেখা যায় মেয়েরা কম কথা বলে, কারণ ছোটবেলা থেকেই তারা এভাবে গড়ে উঠেছে। তাই আমার মনে হয়, পেশাগত সেক্টরে নেতৃত্ব দিতে হলে পারিবারিক পর্যায় এবং কর্মক্ষেত্রে ডিসিশন মেকিং-এ অংশগ্রহণ করতে হবে। পরিবারে মেয়ে সন্তানদের এভাবেই গড়ে তুলতে হবে।
জাগো নিউজ: আইসিটি এবং স্টার্টআপ সেক্টরে বাংলাদেশের নারীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। এর কারণ কি? আইসিটি সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য কি কি করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
Advertisement
সোনিয়া বশির কবির: আইটি সেক্টরে মেয়েদের কম দেখা যায় এটা সত্য। আর স্টার্টআপ কালচার আমাদের দেশে সবেমাত্র শুরু হয়েছে বলা যায়। যদিও আমাদের সরকার টেকনোলজি ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরি করার জন্য অনেক কাজ করছে, তবুও আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে।
এখন হঠাৎ করে নারীদের স্টার্টআপে আসা কঠিন কারণ এখনও তারা লিডারশিপ পজিশনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। আমাদের অল্প অল্প করে সমস্যার সমাধান করতে হবে, প্রথমে নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি করতে হবে, তাদের মধ্যে থেকে লিডার তৈরি করতে হবে। এরপর তাদেরকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি স্টার্টআপ এবং প্রযুক্তি সেক্টরে আসার জন্য। তাই আগে ভিত্তিটা মজবুত করতে হবে।
জাগো নিউজ: দেশের অর্থনীতিতে উদ্যোক্তাগণ বিশাল অবদান রাখছেন। দিন দিন নতুন নতুন উদ্যোক্তা বাড়লেও নারীদের উদ্যোক্তা হবার সংখ্যা এখনো অনেক কম। নারীদের মধ্যে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
সোনিয়া বশির কবির: আমরা মাইক্রো ফাইন্যান্স বা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যাবসা করা অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা দেখতে পাই। কিন্তু সারাজীবন লোন নিয়ে ব্যবসা করলে সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। আবার, আমাদের মধ্যে রোল মডেল বা সফল নারী উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপের সংখ্যা খুবই কম। মেয়েরা যদি রোল মডেল দেখতে পারে তাহলে তারা স্বপ্ন দেখবে, উদ্যোক্তা হবার ইচ্ছা এবং আগ্রহ পাবে। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই ডিসিশন মেকিং এবং সামনে আসার চেষ্টা করতে হবে।
জাগো নিউজ: নারীর উন্নয়নে আপনি এবং আপনার প্রতিষ্ঠান কি কি কার্যক্রম কিংবা পদক্ষেপ নিয়েছেন?
সোনিয়া বশির কবির: নারীদের উন্নয়নে আমার স্বপ্ন হলো আমি প্রত্যেক নারীর হাতে প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে চাই। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে তাদের এগিয়ে নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব। আমি মাইক্রোসফট ছেড়ে এসবিকে টেক ভেঞ্চার এবং এসবিকে ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছি। আমি বিশ্বাস করি গ্রাম পর্যায়ে নারীদের টেকনোলজি ব্যাবহারের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করতে হবে, এজন্য আমি এসবিকে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলায় টেকনোলজি হাব তৈরি করেছি। প্রতিটি টেকনোলজি হাবে কয়েকটি ল্যাপটপ, কম্পিউটার, প্রিন্টার, প্রজেক্টর ইত্যাদি আছে যেগুলোর মাধ্যমে সেখানের নারীরা ইন্টারনেট এবং টেকনোলজির ট্রেনিং পায়। আমরা এভাবে ২০ হাজার জনকে ট্রেনিং দিয়েছি ইতোমধ্যেই। এখন আমি তাদেরকে বিভিন্ন অর্গানাইজেশন এবং কোম্পানির মাধ্যমে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছি যাতে তারা নূন্যতম ১০০ ডলার ইনকাম করতে পারে। আমার স্বপ্ন হলো দেশের এক লাখ গ্রামে এক লাখ টেক হাব গড়ে তোলা।
জাগো নিউজ: নারীদের এগিয়ে নেবার জন্য আপনি এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমূহ কি কি?
সোনিয়া বশীর কবির: আমার স্বপ্ন হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে প্রত্যেক সেক্টরে নারীদের প্রত্যক্ষ অবদান দেখা। আমরা এখনো কর্মক্ষেত্রে এবং নেতৃত্বের স্থানে খুব কম নারীদের পাচ্ছি। আমার পরিকল্পনা এবং স্বপ্ন হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে সব সেক্টরে নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও আমি কাজ করতে চাই।
জাগো নিউজ: সব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এবং নারীদের এগিয়ে নেবার জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কি কি করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
সোনিয়া বশির কবির: সরকার এবং প্রাইভেট সেক্টরগুলো থেকে ইতোমধ্যেই এমন একটা ইকোসিস্টেম এবং অবকাঠামো তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে নারীরা সব ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এখন নারীরা নিজেরা যদি এগিয়ে না আসে তাহলে আমরা সবাই যতই চেষ্টা করি আর যত সুযোগ সুবিধাই দেই সফল হব না। তাই নারীদের প্রতি আমার অনুরোধ- আপনারা মাঠে নামুন। আপনারা ডিসিশন মেকিং এবং নেতৃত্বের গুণ অর্জন করুন, টেকনোলজি নিয়ে সামনে আসুন। আপনারা এত সুবিধা পাবার পরও মাঠে না নামলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এমএমএফ/জেআইএম