জাগো জবস

নারী উদ্যোক্তাদের আপনজন ‘নিশা আপা’

বাংলাদেশের আইটি খাতে ক্যারিয়ারে নারীর অগ্রযাত্রা সম্প্রতি যে কয়েকজন মানুষের কারণে খুব চোখে পড়ছে, বলতে দ্বিধা হবে না নাসিমা আক্তার নিশা তাদের প্রথমজন। নারী উদ্যোক্তা কেন্দ্রীক জনপ্রিয় প্লাটফর্ম উইয়ের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নিশার ক্যারিয়ার ও সফলতার গল্প শোনাচ্ছেন বেনজির আবরার-

Advertisement

নিশার ছোটবেলা: নাসিমা আক্তার নিশার ছোটবেলা কেটেছে বনানীতে। বাবা হাজী সাহাব উদ্দিনের অনেক আদরের মেয়ে নিশার সবকিছুই বাবার কাছ থেকে শেখা। বাবা প্রচুর দান করতেন। ছোট্ট নিশা যেন তখন থেকেই শিখতেন সবকিছু। বনানীতেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে।

ব্যবসায় কিছুদিন: কলেজ শেষে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দু’এক বছরের মাথায়ই বাবার ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যবসা দেখতে শুরু করলেন পুরোদমে। কাজকে করে নিতে লাগলেন আপন করে। এরপর এভাবেই চলছিল কিছুদিন। ২০০৬ সালের শেষে দানা বাঁধে এক রোগ, যা তাকে ভুগিয়েছে চার বছর। দেশের বাইরে ট্রিটমেন্টে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশে যৌথভাবে একটি গেমিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তুু ভাগ্য খারাপ! যখন ফিরে এলেন, প্রতিষ্ঠানটি নানা কারণে এগোলো না।

উদ্যোক্তা জীবন: খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন। হাল ছাড়েননি, নিজের আইটি নলেজ না থাকলেও গেমিং ইন্ড্রাস্টির প্রতি প্রচ্ছন্ন একটি ভালোবাসা ছিলই। নর্থ সাউথের বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রিভারি কর্পোরেশন’। বনানীতে বর্তমানে ১৬ জনের টিম কাজ করছে গেম ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপসহ বিভিন্ন কাজে। এর মাঝেই আরেকটি বড় ব্যাপার ঘটিয়েছেন। মহাখালীতে সম্পূর্ণ নিজের তত্ত্বাবধানে গার্মেন্টস চালিয়েছেন কিনে। পরে অবশ্য সময় স্বল্পতা, ই-ক্যাব নিয়ে ব্যস্ততায় গার্মেন্টসটি বন্ধ করে দেন।

Advertisement

সংসারে নিশা: বিয়ে করেন নিজের পছন্দে। স্বামী ফয়সাল ছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী। বিয়েতে উকিল বাবা ছিলেন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। আগে থেকেই বেসিসের সদস্য ছিলেন, ই-ক্যাবের মূল প্লাটফর্মে যুক্ত হলেন। কাজ করার ফলাফল এসেছে দ্রুত। ই-ক্যাবের ইসিতে আসেন তিনি। বর্তমানে জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছেন।

উইয়ের যাত্রা: নিশা এর মধ্যেই এদেশীয় নারীদের ই-কমার্স ব্যবসায় আগ্রহ দেখে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম-উই’। যেখান থেকে তিনি নারী উদ্যোক্তাদের নানাভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করলেন ব্যবসায় দাঁড় করাতে। হঠাৎ নেমে এলো ঝড়, সবকিছুর মূল শক্তি জীবনসঙ্গীকে হারালেন অকালে। এ অস্বাভাবিক প্রিয়জন হারানোর গল্পে নিশা এরপর যেন এক দিশেহারা নাবিক। শোককে শক্তিতে পরিণত করে পুরোদমে কাজ করা শুরু করলেন দেশের নারীদের জন্য। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। সারা পৃথিবীর অন্যতম বড় উদ্যোক্তা কমিউনিটিগুলোর একটি এখন বাংলাদেশের উই। দেশের ৬৪ জেলায় ছুটে যাচ্ছেন নাসিমা আক্তার নিশা।

উই যেভাবে নারীর পাশে: বর্তমানে উইয়ের ফেসবুক গ্রুপে ১ মিলিয়নের বেশি সদস্য। উইয়ের উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগ পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংকে গুরুত্ব দেন। কারণ এ গ্রুপে সেল পোস্ট করা নিষেধ। নিজের পণ্যের এবং নিজের পরিচিতি দিয়ে পোস্ট করাটাই এখানকার মূল বৈশিষ্ট্য। গ্রুপের রুলস অনুযায়ী পোস্ট করলে সবার পোস্টই অ্যাপ্রুভ হয় এখানে। উই থেকে কেনাবেচা হলে কাউকে কোনো কমিশনও দিতে হয় না। উইয়ের অ্যাডমিন বা মডারেটররা কোনো উপহার নিতে পারেন না সদস্যদের কাছ থেকে। এরকম অনেক সুন্দর সব নিয়মের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের প্রিয় প্লাটফর্ম এখন উই।

কয়েকজন সফলের কথা: নাটোরের মেয়ে তাহসিন বারি সুহা। বয়স মাত্র ১৫ বছর। মাছ-ফলসহ দেশীয় বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। সুহার উদ্যোগের নাম ‘ফলের ঝুড়ি’। তার ব্যবসা ফেসবুক গ্রুপ ও পেজভিত্তিক। ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে নিজের গ্রুপ ‘সুহার ঝুড়ি’ ও পেজ ‘ফলের ঝুড়ি’র মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেন সুহা। এত দূরে থেকেও অনায়াসে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার পণ্যকে পরিচিত করতে উইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য বলে তিনি জানান।

Advertisement

সুলতানা পারভীন, অনলাইনভিত্তিক পেজ ‘চিরাচরিত’, বেতের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। করোনাকালীন চাকরি হারানো সুলতানা উইয়ের কল্যাণে হয়েছেন লাখপতি। তার এখন পর্যন্ত ২১ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে বলে উই কর্তৃপক্ষ জানায়।

মুন’স ক্লজেটের মালিক ফাতেমা জাহান। কাজ করছেন ব্লক, টাই-ডাই ও স্ক্রিন প্রিন্ট, হোম ডেকর থেকে শুরু করে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি নিয়ে। তার কাছে উই হলো স্বপ্ন পূরণের কারিগর।

আফসানার চোখে স্বপ্ন পূরণের প্ল্যাটফর্ম উই। তার কথায়, ‘উই একটি জাগরণের নাম, বিপ্লবের নাম। দেশি পণ্য নিয়ে আমিসহ অনেকেই দীর্ঘদিন স্ট্রাগল করে যাচ্ছিলাম। বাজারে বিদেশি পণ্যের আধিপত্য এতটাই ছিল যে, দেশি পণ্য মানুষের মন ও মগজে জায়গা করতে পারছিল না। উই সেই কাজকে সহজ করে দিয়েছে অনায়াসে।’

কুমিল্লার ‘খাদিরানী’ খ্যাত মুক্তা আকতার কাজ করছেন খাদি নিয়ে। তার অনলাইনভিত্তিক পেজের নামও খাদিরানী। উইয়ের মাধ্যমে তার খাদিপণ্য বেশ সমাদৃত হয়েছে। তার তৈরি পণ্য পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, শাল, কুর্তি, ব্যাগ ইত্যাদি।

নাসিমা আক্তার নিশার কথা: আসলে পরিবার, ব্যবসা, ই-ক্যাব সবকিছু মিলিয়েই এগিয়ে চলছি। দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জীবনমান উন্নয়নে সারাজীবন কাজ করে যাবো। নারী দিবস উপলক্ষে বলবো, সব ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমাদের সার্থকতা।

এসইউ/জেআইএম