ভ্রমণ

পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের সমুদ্রে সাঁতার

সালমান ইসলাম

Advertisement

নদী, পাহাড়, সমুদ্র আমাকে সব সময়ই রোমাঞ্চিত করে নতুন প্রেমিকার মতো। ভ্রমণ একটি ওষুধ, যা মনকে সুস্থ রাখে। যখনই সুযোগ পাওয়া যায় ঘুরে বেড়ানোর; তখনই নদী, পাহাড় ও সমুদ্রে চলে যাওয়া হয়। হ্যাঁ, আজ এক ভ্রমণপিপাসুর সাজেক ঘুরে আসা গল্প জানাতে চাই। যেখানে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘের সমুদ্রে সাঁতার কাটা যায়। গল্প শুনেছি, উপলব্ধিও করেছি। তবে যাওয়া হয়নি। এমনকি সাজেককে মেঘ-পাহাড়ের রাজ্য বলা হয় শুনেছি। সাজেক যাব যাব করেও ব্যাটে-বলে মেলেনি। এই তো মাঝে করোনাও আটকে দেয়। অবশেষ দেখা মিললো সব বাধা দূর করে।

কলাবাগান বাস কাউন্টার থেকে রাত সাড়ে ১০টায় যাত্রা শুরু। চার বন্ধু আড্ডা-গল্প করতে করতে দেখি কুমিল্লায় বাস বিরতিতে। রাতে নাস্তা করে আবার যাত্রা শুরু। যেহেতু অনেক রাস্তার জার্নি; তাই একটু ঘুম দিলাম সবাই। ঘুম ভাঙতেই দেখি বাস দাঁড়ানো খাগড়াছড়ি যাওয়ার মোড়ে। রেল ক্রসিং সামনে। কতক্ষণ লাগবে এখান থেকে যেতে? শুনতেই সুপারভাইজার বললেন, ‘সকাল ৬টা নাগাদ খাগড়াছড়ি যাবো।’

বাস খাগড়াছড়ির পথে কিছুদূর যাওয়ার পরই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। কখনো তীব্র গতি, কখনো ধীর গতিতে এভাবে পথচলা। হাল্কা হাল্কা আলোয় যখন সকালে ঘুম ভাঙলো, এক অন্যরকম অনুভূতি। আমাদের দেশে এত সৌন্দর্য রয়েছে, যা এতদিন আমার খোলা দৃষ্টির বাইরে ছিল। যতবার ভেবেছি; ততবার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। এত সুন্দর প্রকৃতি দু’চোখ ভরে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

Advertisement

এভাবেই ভোরের আলো জানান দিচ্ছিল, আশেপাশের পাহাড়ের বিশালতা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় কখনো ধীরে কখনো তীব্র গতিতে ছুটে ঠিক সকাল ৬টা ৩০ মিনিট খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর পৌঁছে দিলো আমাদের গাড়ি। এখান থেকেই মূলত চাঁদের গাড়ি ভাড়া করতে হয়। অথবা দীঘিনালা থেকেও পাওয়া যায়।

আপনাদের সুবিধার জন্য জানিয়ে রাখি, বাস থেকে নেমেই সিএনজি বা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে নিন। তবে অবশ্যই দামাদামি করে নেবেন ভাড়া। আর যতদূর পারবেন, রওনা দিয়ে দেবেন সাজেকের উদ্দেশে। না হয় সকালের স্কোয়াড মিস করবেন। সকালের নাস্তা সেরে আমরা যখন চাঁদের গাড়ির জন্য অপেক্ষারত; তখন পাশের স্থানীয় বাজার থেকে কিছুটা হেঁটে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে পা বাড়ালাম। রাস্তার ধারে ছোট একটি বাজারে নাম না জানা কিছু পাহাড়ি সবজি ছাড়া খুব বেশি কিছু ছিল না আমাদের কেনার মতো।

সকাল ১০টার এসকর্টে সাজেকের পথ ধরলাম। আর্মির পাহারায় একসঙ্গে সব গাড়ি সারিবদ্ধভাবে যায় সাজেকের পথ ধরে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে চলছে আমাদের চাঁদের গাড়ি। কখনো আকাশের দিকে উঠতে থাকে তাে আবার কখনো নিচে নামতে থাকে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ের বাঁকে খুব সামনের পথও দেখা যায় না। মনে হয়, এই বুঝি পাহাড়ের খাদে পড়ে যাচ্ছি।

চাঁদের গাড়িতে রওনা হতেই শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল যেন এক শীতল অনুভূতি। নিয়ম ভেঙে চলে গেলাম চাঁদের গাড়ির ছাদে। যত দামি গাড়ি হোক, ইঞ্জিন পাওয়ার থাকে সাধারণত পেছনের দুই চাকায়। কিন্তু চার চাকায়ই ইঞ্জিন পাওয়ার বিশিষ্ট পাহাড়ি রাস্তায় চলার একমাত্র বাহনটি যখন পাহাড়ের পর পাহাড় পার হচ্ছিল; তখন মনে হচ্ছিল যেন উড়ে উড়ে এগিয়ে চলেছি অসীমের দ্বারে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারেই গিরিখাত। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে পাখিই ভেবে নিয়েছিলাম হয়তো। তার ওপর রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী বাচ্চারা যখন হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছিল তাদের পাহাড়ি জনপদে; নিজেকে তখন তাদের মেহমান মনে হচ্ছিল। এ যেন এক নতুন অনুভূতি।

Advertisement

ঠিক বেলা ১২টায় পৌঁছলাম ১৮০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ের চূড়া সাজেকে। চূড়ায় উঠতেই চোখে পড়লো রাস্তার দু’ধারে গড়ে ওঠা কিছু হোটেল। আমাদের হোটেলটি আগে থেকে নির্ধারিত থাকায় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। হোটেলের প্রবেশপথ বারান্দা হয়ে। আমাদের কামরাটি পেছন দিকে হওয়ায় ঝুলন্ত বারান্দা থেকেই দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। ফ্রেশ হতে যে কামরায় ঢুকবো, সেই মনের ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উপত্যকার সৌন্দর্য দু’চোখে ধারণ করে নিলাম।

ফ্রেশ হওয়ার জন্য গোসল করতে গিয়ে মনে হলো, আমরা প্রতিনিয়ত কত পানিই না অপচয় করি! আর এখানে পানির বড়ই অভাব। এক হাজার ৫০০ লিটারের দাম ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। তার চেয়ে কষ্টের কথা, প্রায় এক হাজার ফুট নিচ থেকে পানি আনতে হয়। তাই খুব সীমিত পানি খরচ করে গােসল করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে।

দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় চোখ কিছুটা কপালে উঠে গেল মেন্যু দেখে। পাহাড়ি বাঁশের সবজি, ব্যাম্বু চিকেন, পাহাড়ি আলু ভর্তা আর ডালের সঙ্গে সাদা ভাত। সাধারণত যতখানি খাই; ওইদিন দুপুরে বোধ হয় তার চেয়ে কিছুটা বেশিই খেলাম খাবারের স্বাদের আনন্দে। খাওয়া শেষে চা খেতে গিয়ে দেখি এখানেও বাঁশের সুনিপুণ কারিগরি দক্ষতা। বাঁশের তৈরি কাপেই খেতে হবে চা। বেশ আগ্রহ নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে এর স্বাদের কাছে নিজেকে সপে দিলাম।

চার বন্ধু গল্প করতে হেঁটে হেঁটে গেলাম সেনাবাহিনীর তৈরি হেলিপ্যাডে। যেখানে বসেছে পাহাড়ি কিছু খাবারের অস্থায়ী দোকান। সাজেকে ঘুরতে আসা অধিকাংশ পর্যটকই তখন হেলিপ্যাডে নিজেদের মত করে সময় কাটাতে ব্যস্ত। আমিও তাদের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।

চলবে...

এসইউ/এএ/জেআইএম