ভ্রমণ

হাওরের যে রূপ এখনো দেখেনি কেউ

রফিকুল ইসলাম

Advertisement

রূপের হাওরের ভাগ্যবিড়ম্বিত প্রায় ২৬ হাজার গ্রামের দু’কোটি বাস্তুসঙ্কটাপন্ন হাওরবাসীর বিষাদের গল্প কাব্য দিয়েই শুরু করা যাক—‘মাটির উপরে জলের বসতি জলের উপরে ঢেউ/ তরঙ্গের সাথে পবনের পিরিতি নগরের জানে না কেউ।’ হাওরের জলবায়ুর দুটি রূপ—স্বপ্নীল ও ভয়াল। আবহাওয়ারও দুটি ধরন—নিরাগ (শান্ত) ও আফাল (তুফান)। যা একেক সময় একেক রূপে আবির্ভুত হয়।

নৈসর্গিক হাওরের রূপবৈচিত্র্যের বৈপরীত্যে রুদ্রতার উপাখ্যানই বিমূর্তভাবে চিত্রায়িত হয়েছে লোকগীতির চরণখানিতে। কিন্তু পর্যটনে ও বিনোদনে গৌণ-গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বিশ্বের বৃহৎ মিঠা পানির একক ‘ওয়াটার বডি’ হাওরাঞ্চল স্বপ্নীল রূপে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওর। বলা হচ্ছে বর্ষায় অস্ট্রেলিয়া, শুকনায় নিউজিল্যান্ড। আসলে হাওর তার চেয়েও বেশি। সুন্দরে সুন্দরে পাল্লা।

জলের কিনারায় বিশ্বের তাবৎ পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠায় পর্যটন শিল্পের প্রাচীনতম ইকো ট্যুরিজম এবং কমিউনিটি ট্যুরিজমের সর্বোৎকৃষ্ট তীর্থক্ষেত্র এখন হাওরাঞ্চল। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তার বিচারে ট্যুরিজমে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান সমগ্র হাওরাঞ্চল পর্যটকদের কাছে এক স্বপ্নের ঠিকানা। প্রতিনিয়ত ডাকছে অফুরন্ত পর্যটন সম্ভাবনার দুর্নিবার হাতছানিতে। প্রকৃতিও সাজিয়েছে উদার নীড়ে তার সৃষ্টিকে। প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার মতো এখানে রয়েছে পর্যটকদের চিত্তাকর্ষণে যত সব উপজীব্য, যা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে হয়ে উঠেছে রূপকন্যার স্বপ্নপুরীতে।

Advertisement

স্বপ্নীল হাওর: ‘প্রকৃতি সাদিয়া সিদ্ধি/সেবে দেখ না/প্রকৃতি সাধনের মূল/যথায় অনন্তের মূল।’ রূপসী বাংলার অপরূপ হাওরের বিশালতা ও মনোহর রূপমাধুরী রূপায়নে কবি জীবনানন্দ দাশের পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল। রূপকন্যা হাওরের সৌন্দর্য এমনই যে, ‘পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে জলে,/পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে।/আকাশে ছড়ায়াছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে,/ছুটছে প্রকৃতিপ্রেমি মহোৎসবে প্রশান্তি লাভে অসীমের প্রাণে।’

হাওরের রূপ-সৌষ্ঠব-মাধুর্য স্বচক্ষে না দেখলে উপলব্ধিতেও আসবে না প্রকৃতির ঐশ্বর্য। হাওরের রূপের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছেন বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সব পর্যটকরা। সর্বশেষ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরকে আখ্যায়িত করেছেন ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’ হিসেবে। পূর্ববঙ্গকে প্রাচীন গ্রন্থসম্ভারে অভিহিত করা হয়েছে ‘উড়া পঙ্খির দেশ’ বলে। ওই পাখি শিকারেই এসেছিলেন বাংলার ছোট লাট লর্ড কারমাইকেল ১৯১২ সালে নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরীর হাওরে।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাটি অঞ্চল বা হাওরাঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভাটিরাজ্য দখলে কিশোরগঞ্জের হাওর অববাহিকা অষ্টগ্রামের অন্তর্গত কাস্তুলে মুঘল সুবেদার খান জাহানের নেতৃত্বে নৌ-সেনাপতি শাহ বরদীর সঙ্গে ঈশা খাঁর মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর নৌ-যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। এমনকি ভাটি অঞ্চল ও এগারসিন্দুরে একসময় কামরূপের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল বলেও বিভিন্ন সূত্রের মধ্যে ষোড়শ শতাব্দীর কবি নিত্যানন্দ দাসের ‘প্রেমবিলাস’ কাব্য অন্যতম।

ছয় ঋতুর দেশ হলেও হাওরে মৌসুম দুটি—বর্ষা ও শুকনা। বর্ষা মৌসুমকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘বাইরা মাস’ বা ‘অদিন’ এবং শুকনা মৌসুমকে বলা হয় ‘সুদিন’। এই ‘অদিন-সুদিন’ মিলে বারো মাস। বর্ষায় দিগন্তজোড়া অথৈ গভীর জলরাশি এবং শুকনায় মাঠজোড়া সোনালি ফসল আর সবুজ চারণভূমি। আরও রয়েছে পানির নিচে সর্পিল ডুবু সড়ক আর পানির উপরে নান্দনিক আডুবা সড়ক।

Advertisement

হাওরাঞ্চলের নয়নাভিরাম দৃশ্য ঋতুভেদে রূপ বদলায়। শুকনা মৌসুমে হাওরের আঁধার কেটে ‘সুদিন’র প্রত্যাশায় সূর্য উদিত হয় মাটি ফুঁড়ে ওঠা সোনালি রোদের আলোকচ্ছটায়। চারিদিকে দিগন্তবিস্তৃত সবুজে, কখনোবা সোনালি ফসলি মাঠ নেচে ওঠে নৈঋতী হাওয়ায়। মাছ শিকারীদের বিলে বা জলাশয়ে পলো ও কুচ দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য। দুর্বার আসাদনে কৃষকের ঘর্দমাক্ত ব্যস্ত কর্মযজ্ঞ। পূর্ণিমার রাতে বিলের ফুটন্ত শাপলা ফুল ভাব জমায় চাঁদের সাথে। শরৎ-হেমন্তে মুখরিত সাইবেরীয় অতিথি পাখির কলতানে। মালার মতো দলবেঁধে দৃষ্টিসীমায় উড়ে চলে বলাকার ঝাঁক। বৈশাখ মাসে পাকা সোনালি ধান ঘরে তোলার অকুণ্ঠ উচ্ছ্বাসে কৃষাণ-কৃষাণীর কণ্ঠে কতই না স্বপ্নবোনা গীত। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে জোনাকি ও ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে শস্য-শ্যামল ফসলি মাঠের মাঝ দিয়ে হাওরের বুক চিড়ে তৈরি কিশোরগঞ্জের হাওরে ৪০ কিলোমিটার সাবমার্সিবল রোড বা ডুবু সড়কে ফুরফুরে শীতল হাওয়ায় মোটর বাইক বা গাড়ি হাকিয়ে বেড়ানো মনমোহিনী পুরীর দেশে বিচরণের শিহরণ জাগে অন্তরে অন্তরে।

বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতি ফিরে পায় ভরা যৌবন। হাওর রূপ নেয় নীল দরিয়ার কলতানে। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। এসময় মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিস্টদের পদচারণায় হাওর হয়ে ওঠে সরগরম। থৈ থৈ জলে রুপালি মাছের খেলা। মাথার উপর কিচিরমিচির মৃদুল শব্দে পাখপাখালির দল। নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে মেঘের পালক ও শুভ্র মেঘের বিনুনি। কোথাও কোথাও ছায়া হয়ে করচ হিজল বনের সবুজ বেষ্টনির দ্যুতিময়তা। মেঘছায়া আকাশে দক্ষিণা হিম উদাসীন হাওয়া শনশন শব্দে পরশ বুলিয়ে ছুটে চলে হিমালয় পানে তার প্রিয়তমা মালতির দেশে। দিনের ঝলমল আলোয় কাকের চোখের ন্যায় কালো স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে ডুবুডুবু ভাসমান দূরের বিচ্ছিন্ন সবুজ ছাতায় আচ্ছাদিত গ্রামগুলো দেখতে ‘আন্দামান দ্বীপ’র মতোই ঠিক যেন জলেভাসা পদ্ম। অরুণ আলোর প্রভায় গভীর জলরাশিতে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে সুনীল অসীম আকাশের সাথে দিগন্তজোড়া হাওরজলের মিতালি। রাতে হাওরের ভর পানিতে ডেঙ্গি বা কোশা নৌকার হ্যাজাক বা চার্জ লাইট দিয়ে আলোয় মারা মৎস্য শিকারীদের দুঃসাহসিক বিচরণ। কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা নীলাভ রাঙা চাঁদনি রাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলে যেকারো মন কেড়ে নেবে। প্রেমবৈচিত্র জেগে কণ্ঠে বেজে উঠবে—‘এই চান্নি রাতে তোমারি সাথে...’ অথবা ‘ওরে নীল দরিয়া...।’ কিংবা রাতের নিরব-নিস্তব্ধ হাওরজলে চাঁদের নীলাভ আভায় প্রতিবিম্বের কাব্যময়তা—‘অমাবস্যায় চন্দ্র উদয়, দেখতে যার বাসনা হৃদয়/প্রেমিক বলে থেক সদায় ত্রিবেণীতে থেকো বসে।’

নিরাগ দুপুরে ও অমাবস্যার রাতে জোনাকি পোকার মতো অসীম আকাশের মিটিমিটি তারকারাজি এবং দূর গ্রামে লাল-নীল বিজলী বাতির আলোর নাচন। পরিযায়ী পাখি আর আকাশে সাদা মেঘের ভেলার সাথে পাল্লা দিয়ে ওড়াউড়ি করা ধবল বক। নির্মল মুক্ত বাতাসে ‘মনপবনের নাওয়ে’ চড়ে স্রোতে অনুকূলে ভেসে বেড়ানো এবং স্পিডবোট ও রঙিলা ট্রলার চেপে দুরন্ত ছোটাছুটি আর টইটুম্বুর তরঙ্গজলে উচ্ছ্বসিত দাপাদাপি-জলকেলির রোমাঞ্চে স্বর্গীয় অনুভূতিতে স্বপ্নপুরীর মায়াবী হাতছানি প্রকৃতিপ্রেমি ও পর্যটকদের পাগলপারা করে তুলেছে। শহুর জীবনের জৌলুসের গল্প গ্রামীণ জীবনে অবসর বিনোদনের অঙ্গ ছিল। এখন সেই শহুরেরা জৌলুস ছেড়ে সুর তুলছে, ‘হাওরদেশে আইস্যা আমার আশা ফুরাইছে...।’

শুধু কি তা-ই! মেঘমালায় হাতির শুর দিয়ে আসমানে হাওরের পানি তুলে নেওয়ার দৃশ্য এবং হাওরজলে উদিত রংধনুর ‘নয়ন জোড়ানো’ অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য দেখার অফুরান দুর্নিবার ব্যাকুলতা। নির্মল মুক্ত বাতাসে হাওরের নিরাগ গভীর জলে অবগাহনে প্রশান্তির স্ফূরণে হাজার হাজার পর্যটকের আছড়ে পড়া ভিড় বৈশ্বিক করোনা মহামারীও পারছে না রুখতে। আবেগের কাছে উপেক্ষিত প্রশাসনের কঠোর নির্দেশনাও।

‘ফোট অর বোট’ মানে ‘বর্ষায় নাও শুকনায় পাও’ এবং কপি বাতির কাল হালে গতপ্রায়। হাওর-দরিয়ার গভীর জলরাশির নিচে বিস্তৃত সর্পিল ডুবু সড়ক এবং হাওরের সমতলভূমি থেকে জলরাশির উপর পর্বতসম উচ্চতায় শৈল্পিক শৈলীতে তৈরি অলওয়েদার রোড বা আডুবা সড়কের সাথে জনবিচ্ছিন্ন দুর্গমগিরি হাওর জনপদে বিজলী বাতির বিচ্ছুরণ ছিল কল্পনারও অতীত। প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যময়তার সাথে নান্দনিকতার ঐকতানিতে হাওর হয়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন রূপনগরে।

অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি উপভোগে মন্ত্রী ও আইন পরিষদের সদস্য, বিচার বিভাগের বিচারপতি এবং সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিসহ দেশি-বিদেশি সব স্তরের পর্যটকরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এমনকি হানিমুন করতে উপচেপড়া ভিড় করছে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামজুড়ে পানির উপর নির্মিত ৩০ কিলোমিটার স্বপ্নের অলওয়েদার রোড বা আবুরা সড়কবাঁধ এবং ছোটবড় ১৬টি সেতুতে। তিন উপজেলার ৩টি নদীর ওপর ৩টি বড় সেতু—ভাতশালা, ঢাকী ও ছিলনী সেতুতে এবং সুদীর্ঘ অষ্টগ্রাম-বাঙ্গালপাড়া সংযোগকারী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেতুতে। এছাড়া ইটনা, মামুদপুর, ঢালারপাড়, বোরনপুর, মহিষারকান্দি, মিঠামইন, দেওদরিয়া, উড়িয়ন্দ, ভাতলা, কররা, কাস্তুল এবং মিঠামইন-করিমগঞ্জ মধ্যকার গোপদিঘীর হাসানপুর সেতুতে। এছাড়া চামড়া-ইটনা ৩ কিমি, চামড়া-মিঠামইন ২ কিমি ও বাজিতপুর-অষ্টগ্রাম রোডে ২ কিমি মোট আরও ৭ কিলোমিটার আবুরা সড়কেও।

সমভাবে ভিড় জমাচ্ছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-নিকলীর বেড়িবাঁধ ও হাওরে। করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা-চামড়াঘাটের বেড়িবাঁধ ও হাওরে। মিঠামইনে তিনশ একর জায়গাজুড়ে সমতলভূমি থেকে পর্বতসম উচ্চতায় হাওরজলের উপর নির্মাণাধীন আডুবা (ডোবে না) ক্যান্টনমেন্টে, অত্যাধুনিক মেরিন একাডেমি, সেনানিবাসের পাশে ঘোড়াউত্রা মরা গাঙ্গেও হতে যাওয়া ক্যান্টনমেন্ট লেকের জায়গায়, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক সরকারি কলেজ ও সংলগ্ন হেলিপ্যাডে, কামালপুর গ্রামে রাষ্ট্রপতির বাড়ি-মসজিদে, ইত্যাদি খ্যাত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পল্লীতে, কাঠখালে শত শত হিজলরূপী দৈত্যের উপাখ্যানে ঘেরা মুঘল আমলের দিল্লির আখড়ায় ও ঘাগড়ার ভরা গ্রামে হযরত শাহজালালের (রাহ.) সফরসঙ্গী হযরত লতিফুল্লাহ্ ইয়ামেনি (রাহ.) ওরফে মালিক শাহ্ দরগা দর্শনে।

এ ছাড়া ভিড়ভাট্টা করছে মুঘল আমলে নির্মিত নিকলীর গুরুই মসজিদে, দামপাড়ায় পরিত্যক্ত দ্য চিটাগাং জুটমিল-বাংলোতে ও গ্রীনহাউস খ্যাত বর্ধিষ্ণু ছাতিরচর গ্রামে। অষ্টগ্রামে মুঘল আমলের পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদে। ইটনায় বহুল আলোচিত গায়েবি মসজিদে। সেটি গায়েবি মসজিদ খ্যাত হলেও ষোড়শ শতাব্দীতে মজলিশ দেলোয়ার কর্তৃক স্থাপিত। যিনি ১৫৭৮ সালে অষ্টগ্রামের কাস্তুলের যুদ্ধে ঈশা খাঁর পক্ষে মুঘলদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন (সূত্র: সামসুদ্দিন আহমেদ কৃত Inscription of Bengal) ও ইটনার সা’ব বাড়িতে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কলেজে, জয়সিদ্ধি গ্রামে উপমহাদেশর একমাত্র রাংলার আনন্দমোহন বসুর বাড়ি এবং ধনপুরের কাঠইর গ্রামে দানবীর গুরুদয়াল সরকারের বাড়ি দর্শনে।

ছুটছে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় বিথঙ্গলের আখড়ায়। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে লোকগানের বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে, জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগানে, জাদুকাটা নদীতে, নিলাশ্রী লেকে, বাঁশতলা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে, তাহিরপুর ও ধর্মশালা উপজেলার প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত রামসার সাইট খ্যাত বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরে, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওরে।

কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রাণসংহারের ঝুঁকি নিয়েও অকূল হাওর-দরিয়ার মাঝ দিয়ে তৈরি স্বপ্নিল অলওয়েদার রোডে বেপরোয়া মোটর বাইক বা গাড়ি চালানো এবং সুউচ্চ ব্রিজগুলো ছাড়াও হাওরের উপর দিয়ে সিলেট থেকে গাজীপুরে যাওয়া ১ লাখ ৩২ হাজার বোল্ডেজের জাতীয় গ্রীড লাইনের আকাশ ছোঁয়া বৈদ্যুতিক টাওয়ারের চূড়ায় চড়ে মনমাতোয়ারা হয়ে লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি এবং উত্তাল হাওরজলে ওঠা বিক্ষুব্ধ ঢেউ সাদা পাপড়ি পড়ে পাগলা হাতির মতো ফুঁসে ছুটে চলার তালে পাল্লা দিয়ে উদ্দাম পর্যটকরা অরক্ষিত অবস্থায় সাঁতারে মেতে উঠছে অনাকাঙ্ক্ষিত অ্যাডভেঞ্চারে।

হাওরে পর্যটক বা মানুষের অবাধ পদচারণা বেশিদিনের নয়। অথচ পর্যটন শিল্পে হাওর প্রাচীনতম হলেও চরম অবহেলায় অনুন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুণ এতদিন রয়ে গেছে মানুষের দৃষ্টির বাইরে। সম্ভব হয়েছে টানা তিন মেয়াদে থাকা আওয়ামী সরকারের নজরে এবং টানা দু’মেয়াদে ভাটির শার্দুল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কর্মে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরসহ রাজধানী ঢাকার সাথে উন্নত সড়ক যোগাোগে যুগান্তকারী হাওর রূপান্তরের ফলে। হাওরের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেটা মাথায় রেখেই রাষ্ট্রপতির বাড়ি কামালপুর গ্রাম হতে নিকলী উপজেলার মরিচখালি পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার উড়ালসেতুসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সংযোগ সড়ক হিসেবেও অভূতপূর্ব উন্নয়ন সূচিত হতে যাচ্ছে। পরিকল্পনায় রয়েছে অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়া হতে চাতলপাড় সেতু এবং মিঠামইনের গোপদিঘী হতে করিমগঞ্জের বালিখলা পর্যন্ত অ্যালিভেটেড সেতু নির্মাণের। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার মধ্যকার সংযোগ স্থাপনে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার উড়ালসেতুসহ ১৯০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে নববধূর লাবণি রূপ পেয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ পর্যটন শিল্পেও সমৃদ্ধ হবে হাওরাঞ্চল।

হাওর এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। চিত্রিত হচ্ছে প্রকৃতির জীববৈচিত্র ও প্রেমবৈচিত্রের লীলানিকেতন এবং সম্পদের খনি হিসেবে। সেমতে হাওরাঞ্চলকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণার সম্ভাব্যতা যাচাইও সম্পন্ন হয়ে গেছে। গত ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) জাবেদ আহমেদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু ছাইদ শেখ ও মহিউদ্দিন খানসহ ৫ জন অতিরিক্ত সচিব কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল পরিদর্শন করে গেছেন। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাটি বা হাওরাঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও মর্যাদার দিক বিবেচনায় অঞ্চলটির ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক স্থান-স্থাপনা ও একাত্তরের শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগও জরুরি।

ভয়াল হাওর: ‘যোগক্ষেমে আফাল আসে যখন হিংস্রবাণে/ত্রিবেণীতে বসত ভিটেবাড়ি ভেসে যায় সমানে...।’ ভৌগোলিক এবং ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হাওরাঞ্চল একটি নিচু, জলামগ্ন, ভয়ঙ্কর দুর্গম ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। চীনের বিখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সম্ভবত ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এবং ইবনে বতুতা ১৩৩৩ ও ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘কিতাবুল রেহালায়’ হাওরাঞ্চলের প্রকৃতির নান্দনিকতায় মুগ্ধ হলেও বিরূপতায় নিদারুণ কুপিত ও রুষ্টতা পোষণ করেছিলেন।

দেশের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত ৭টি জেলা যথাক্রমে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতান্তরে ৪৭টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত মোট ভূখণ্ডের এক-ষষ্ঠাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হাওরকে সোনালি ধানের দেশ, রুপালি মাছের দেশ, গ্যাসের দেশ এবং পর্যটনে ‘রূপের দেশ’ বলা হয়। এটা অনেকটা ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে’র মতো। কিন্তু মেঘের ঘূর্ণন ঘনঘটায় টিকে তবেই না! ৩৯টি হাওর হারিয়ে হাওর নিজেই অস্তিত্বের সংকটে বিপন্ন যেখানে, সেখানে হাওরপাড়ের জনবসতি টিকে থাকা বলাই বাহুল্য।

হাওরের রূপের সম্মোহনীতে না দেখে কেউ হাওরের মেহনতি মানুষের দুর্বিষহ জীবন জীবিকা, না শুকনায় নদী ও বর্ষায় হাওরের ভাঙনযজ্ঞে দেশান্তরিতা, না নীড়হারার আহাজারি, না অকাল বন্যায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানীর হাহাকার, না মচ্ছবে পরিণত হওয়া হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের দুর্নীতি, না অপ্রতিরোধ্য ওয়াটার লর্ড বা ফিশারি ইজারাদারদের জুলুমে নিষ্পেষিত জেলেদের অসহায়ত্ব, না সরকারি সাহায্য-সহায়তায় ত্রাণ-অনুদানে বণ্টন ন্যায্যতায় বেইনসাফিতে অভাবীদের কান্না। এক্ষেত্রে প্রখ্যাতির বন্ধনার পেছনে পড়ে থাকায় সত্যটা তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেক গণমাধ্যমের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গিও কম নয়। যে কারণে সরছে না ‘আড়ালের’ মেঘমালা।

বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক আবহমানকাল থেকে বাংলার রূপবৈচিত্র্যের বর্ণনা করেছেন নানান ব্যঞ্জনায়। নজরুলের ‘বাংলাদেশ’, রবি ঠাকুরের ‘সোনার বাংলা’, জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’। আর ভাটির লোকগীতির প্রবাদপুরুষ একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিমের লোকগীতির চরণে হাওরের অপরূপকতাকে ছাপিয়ে হাওরপাড়ের জনজীবনের বাস্তুসঙ্কটাপন্ন কঠিন বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন ভয়াল রাক্ষসীরূপে। হাওরের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের চমৎকার বাস্তবিক বর্ণনা মেলে তাঁর ভাটির চিঠিতেও—‘আকাশ থেকে পাহাড়েতে নামত যখন ঢল,/পলিমাটি সঙ্গে নিয়ে নিচে নামে জল।/পাড়ালী পলিমাটি নিচে এসে পড়ে,/সাগরের তলদেশ ধীরে ধীরে ভরে।...উঁচু জায়গাগুলোতে হল গ্রাম ঘর,/নীচু জায়গাগুলোতে নাম হল হাওর।/গ্রামের কাছে নীচু জায়গাগুলোর নাম হল ঝিল,/গভীর জলাশয়গুলোর নাম হল বিল।’

ইতিহাসের দৃষ্টিতে সম্ভবত ষষ্ঠ শতাব্দীতে সমুদ্রবক্ষ থেকে হাওরের উৎপত্তি। ৮ হাজার ৫শ ৯০ বর্গকিলোমিটার পরিধির বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির একক ‘ওয়াটার বডি’ হাওরাঞ্চল, যা ভরতের আসামে যতসামান্য অঞ্চল ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও নেই। মোট ৩৭৩টি হাওরের মধ্যে কিশোরগঞ্জে রয়েছে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, মৌলভীবাজারে ০৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, নেত্রকোণায় ৫২টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ০৭টি হাওর রয়েছে। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাওরগুলোর গড় উচ্চতাও বেশি নয়, মাত্র ২.০০-৪.০০ মিটার।

পানির দেশ হাওরাঞ্চল। ভারত থেকে ৫৪টি নদী দিয়ে পানি প্রবেশ করে সারা বাংলায়। এর মধ্যে ২৪টি নদী-নালা দিয়ে হাওরে প্রবেশ করে মোট পানির শতকরা ৬৭ ভাগ। এছাড়া বর্ষাকালে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জিসহ মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার বৃষ্টির পানি পাহাড় বেয়ে ঝরনা ও নদী-নালা দিয়ে হাওরে প্রবেশ করে। এতে অসংখ্য হাওর-বিল-কোড়-ডোবা-নালা ও নদীর পানি একাকার হয়ে বর্ষা মৌসুমে একটি হাওরে পরিণত হয়ে রূপ নেয় সাগরে।

প্রতিবছর হাওর বেসিন থেকে গড়ে ১৫ লাখ ৯ হাজার ৮৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি নির্গমন হয়। কিন্তু নামার পথ একটি। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মেঘনা নদী। অথচ ওই নদীর ওপর নির্মিত রেল লাইন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতুর ফলে একমাত্র সরু পথ দিয়ে পানি বঙ্গোপসাগরে সরতে না পেরে তা জমে সমুদ্রের রূপ ধারন করায় প্রায় দু’কোটি হাওরবাসী ছয় মাস পানিবন্দি থাকেে। পানিই হাওরের সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং সবচেয়ে বড় আপদের নাম। অতিরিক্ত এবং অতি কম পানি দুই-ই হাওরবাসীর জীবন বিপন্ন করে তুলছে।

পরিবেশ ও ভৌগোলিকগত কারণে হাওরে বর্ষা মানেই বন্যা, প্রচণ্ড ঢেউ আর ভাঙনযজ্ঞের ধ্বংসলীলা। যদিও তখন কবি-সাহিত্যিক, প্রকৃতিপ্রেমি ও পর্যটকদের কাছে নৈসর্গিক রূপ লাভ করলেও হাওরবাসীর দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। বসত ভিটা-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা, গবাদিপশুসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন ছাড়াও গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাক্ষসী হাওরজলে। এতে ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই বাস্তুচ্যুত হয়ে হাওর ছাড়ছে হাজারো মানুষ।

এর ভয়াবহতা আঁচ করতে একটা খণ্ডচিত্র তুলে ধরছি। শুধু কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় ১৯৯৩ সালে কালীপুর গ্রাম নিয়ে ৭টি গ্রামসহ কয়েকযুগের ব্যবধানে এ জনপদ থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ৪৩টি গ্রাম। এর কিছুকাল আগে হাসানপুর গ্রাম, দৌলতপুর মৌজার ৫টি গ্রাম, শরিফপুর মৌজার ৫টি গ্রাম, কৈয়েরকান্দা মৌজার ৩টি গ্রাম, খুনখুনি মৌজার ২টি গ্রাম ও গড়বন্দ মৌজার ১টি গ্রাম। এছাড়া মহিষারকান্দি গ্রামের ২টি পাড়া, কামালপুর গ্রামের ১টি পাড়া, মৌলভীপাড়া গ্রামের ১টি পাড়া, শান্তিপুর গ্রামের ১টি পাড়া, মিষ্টা গ্রামের ১টি পাড়া বিলীন হয়ে গেছে। যদিও পরবর্তীতে কিছু কিছু পাড়া ও গ্রাম গড়তে দেখা গেছে।

তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হযরত আলী ১৯৯৩ সালে আমাকে জানিয়েছিলেন, ১৯৮১ সালে গ্রামের সংখ্যা ছিল ১০১টি। ভাঙনে ১০ বছর পরে দাঁড়িয়েছিল ৭৯টিতে। একইভাবে ১৯৮১ সালে মিঠামইন উপজেলার লোকসংখ্যা ছিল ৯৯ হাজার। তা ১০ বছরে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৮২ হাজারে। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে হওয়ার কথা ছিল সোয়া লাখে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, ২০২০ সালে গ্রামের সংখ্যা গড়িয়েছে ১৩৫টিতে এবং লোকসংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার ৬২০ জনে। অর্থাৎ ৪০ বছরে গ্রাম বেড়েছে ৩৪টি এবং লোকসংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২৪ হাজার ৬২০ জন। এ ক্ষেত্রে জন্মশাসন নয়, দৃশ্যত হাওরাঞ্চলের লোকবসতি উঠে যাচ্ছে বিনাশী আফালের অভিঘাতে, রাক্ষসী হাওরের ভাঙনযজ্ঞের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে।

বর্ষাকালে হাওরাঞ্চল ১০-৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কার্তিক মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সমস্ত হাওরাঞ্চলে চলে সীমাহীন পানির রাজত্ব। বর্ষার প্রস্তুতি হিসেবে এখানকার বসত ভিটাবাড়ি গড়া হয় দূর্গের সুরক্ষায়। সমতল ভূমি থেকে ১২-১৩ ফুট মাটি ফেলে পর্বতসম উচ্চতায় এর চারিদিকে মজবুত প্রতিরক্ষা বেষ্টনী বা স্থানীয় ভাষায় ইড় বা ঘাইল তৈরি করে বালির বস্তা বা শক্ত বন ও বাঁশ দিয়ে। রক্ষণাবেক্ষণসহ এতে হাতপ্রতি ব্যয় হয় ১০০০-১২০০ টাকা। দুর্যোগ বা আফালের সময় প্রতিরক্ষা বেষ্টনী রক্ষায় পানিতে নেমে দিনরাত প্রলয়ঙ্করী ঢেউয়ের সঙ্গে মরণপণ যে সংগ্রাম করতে দেখা যায়, তা অবর্ণনীয় হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেষ রক্ষা হয় না ঘরের বেড়া ও টিনের চালসহ সর্বস্ব বিলিয়েও।

বর্ষা শেষে ফের মাটি ভরাট করে ভিটাবাড়ি গড়লেও বর্ষাগমনে আবার ভাঙে। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় আয়ের সিংহভাগ অর্থই বাসস্থানের পেছনে খরচ করে দিনদিন নিস্ব হতে হতে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পরিবার ভাটি ছেড়ে উজানে উঠছে। এছাড়া বছরের ৬ মাস জলমগ্নতায় স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় লোকজনের অভিবাসনের প্রবণতাও বেশি। স্বল্পসংখ্যক লোকে মাছ ধরা ছাড়া এ সময়টাতে কোনো কাজ থাকে না। সেসব লাখো ছিন্নমূল মানুষের শহরমুখীতার জন্যই অস্তিত্বের প্রশ্নে বর্ষাকালের এ সময়টাকে বলা হয়ে থাকে ‘অদিন’।

‘সুদিন’ও যে ছিল না তা নয়। স্থানীয় প্রবাদে রয়েছে, ‘এক ফসলি ধান হাওরবাসীর প্রাণ।’ সেই প্রাণ হালে ওষ্ঠাগত। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে শুকনা মৌসুমের ফসল ফলানোর ছয় মাস সময়কে এক সময় উদার প্রকৃতির দরুণ ‘সুদিন’ বলা হলেও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হাওরবাসীর সেই ‘সুদিন’ আর নেই। কৃষিনির্ভর হাওরাঞ্চলে মরুকরণের ফলে মেরুকরণে সেচ কাজে ব্যবহৃত পানি প্রাপ্তির প্রধান উৎস নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা-জলাশয়, পুকুর-দীঘি, হাওর-বাঁওড় প্রভৃতি খনন বা সংস্কারের অভাবে এবং নদীতে স্রোত না থাকায় নাব্যতা হ্রাস পাওয়া শুধু নয়, সম্পূর্ণ ভরাটও হয়ে গেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। সেচের অভাবে এবং উৎপাদন খরচ না ওঠায় লাখো একর জমি পতিত থেকে লাখ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হারাচ্ছে।

প্রকৃতির হেঁয়ালিপনায় নদীভাঙন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ভূমিধ্স, পাহাড়ি পলিযুক্ত ঘোলা পানি নদীর তলদেশে কিউমুলেটিভ বা ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে জমা হয়ে অযাচিত মরুকরণে পানির ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে মাঠের ধানকে আগাম বন্যার হুমকির সম্মুখীনই শুধু নয়, ভাসিয়েও নিয়ে যায়। এতে ব্যতিক্রম ছাড়া বছরে ক্ষতি হয় ৮ লাখ ১৫ হাজার ১শ একর জমির ফসল। এছাড়া শীতকালে অতি শৈত্য বা কম শৈত্য পড়া, গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় ও ঘূর্ণিবায়ু তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিভিত্তিক হাওরের জনজীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী। বছরের ৬ মাস পানিতে ভাসমান আর ৬ মাস শুকনায় প্রাকৃতিক নিয়মের ছকে বাঁধা হাওরবাসীর জীবনচক্র। ফলে প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট প্রকৃতির মেজাজ-মর্জির উপর নির্ভরশীল জীবনমান এতই নাজুক যে, হাওর উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০১২ অনুযায়ী হাওরাঞ্চলের দারিদ্র্যের হার ৩০% প্রায়।

অত্যন্ত উর্বর এক ফসলি এই হাওরাঞ্চলে চাষযোগ্য বোরো জমির পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ১শ একর। এতে বছরে ৫২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবার কথা থাকলেও বিভিন্ন প্রতিকূলতায় সব জমি আবাদে না আসায় উৎপাদনে আসতে পারছে না। এছাড়া পলি পড়ে প্রতিবছর কৃষি জমি কমছে ০.৩৩%। সর্বশেষ এ বছর বোরো ধান আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর বা ১০ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ একর জমিতে। যাতে উৎপাদিত হয় প্রায় ৩৮ লাখ মেট্রিক টন ধান। এতে দেশের প্রায় ২০ ভাগ জোগান দেয় হাওরাঞ্চলের বোরো ধান।

ব্লু ইকোনোমিক অর্থাৎ সুনীল অর্থনীতির উর্বরক্ষেত্র ও মিঠাপানির আধার বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে ছোট-বড় ৩৭৩টি হাওরে ৩ হাজারেরও অধিক জলমহাল, ১৫ হাজারের মতো পুকুর, ডোবা ও গাতা রয়েছে। বর্ষায় বিশাল জলরাশি ছাড়াই এতে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন মাছ। যা দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে আহরিত মাছের শতকরা ২৫ ভাগ। এছাড়া দেশে উৎপাদিত মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের শতকরা ৯০ ভাগই আহরিত হয় হাওরাঞ্চল হতে।

স্বপ্নের সেই হাওর ও অধিবাসীরা আজ অস্তিত্বের সংকটে। আওয়ামী শাসনামলে স্বল্পসংখ্যক হাওর ও গ্রাম সুরক্ষা ছাড়া সমগ্র হাওরাঞ্চলের সাড়ে ১৫ হাজারের মতো গ্রাম এখনও অরক্ষিত। বিগত ৩২ বছর আগে ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার এক কিলোমিটার লম্বা হাসানপুর গ্রামটি ১০-১১ উচ্চতায় পুননির্মাণ করে প্রতিরক্ষা দেয়াল দেওয়ায় ৯০-৯২টি পরিবারের জিরাতি জীবনের অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করে গ্রামের বাসিন্দা মো. মোস্তফা মিয়া (৪০) জানান, বন্যায় আফাল থেকে বাঁচতে গ্রামটি আরও ৩-৪ ফুট উঁচু করা না হলে টিকা যাবে না। জিরাতি জীবন হলো মৌসুমী বাসিন্দা। হাওরের ভাঙনে চলে যাওয়া উজান থেকে শুকনা মৌসুমে ভাটিতে এসে জমির ফসল মাড়িয়ে ফের চলে যাওয়া। এ সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও সহজেই অনুমেয়।

এক তথ্যে জানা যায়, পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬৬-৬৭ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দেশের হাওর অধ্যুষিত ৬০টি থানার (উপজেলা) হাওর উন্নয়নের জন্য দুইশ পঁচিশ কোটি একষট্টি লাখ ষাট হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল। হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোর প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ ছিল উক্ত মহাপরিকল্পনার প্রধান কাজ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকারগুলো সে বিষয়ে কোনো গরজ দেখাইনি। উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে এই হাওরাঞ্চল জনমানবশূন্য জলাভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ‘অ্যাসেসমেন্ট অব সি লেভেল অন বাংলাদেশ কোস্ট থ্রু ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস’ অনুযায়ী জানা যায়।

হাওরাঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ইকো-ট্যুরিজমের তাৎপর্য বা গুরুত্ব ধরে রাখতে গেলে সর্বোপরি পরিবেশগত বিপন্নতা ঠেকাতে গেলে যোগাযোগের পাশাপাশি ইকোলজিক্যাল বা পরিবেশগত তথা জলবায়ুর অভিঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি সম্পদ ব্যবহার, জীববৈচিত্র্য ও জলাশয় সংরক্ষণসহ আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ কৃষিবীমা চালু ও সরকারি বিভিন্ন সাহায্য-সহায়তা, ত্রাণ-অনুদানে সুষম বণ্টন-ন্যায্যতা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। ডেলটা প্ল্যানে হাওরাঞ্চলের অন্তর্ভুক্তি হলেও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে হাওর মন্ত্রণালয় গঠন করে পৃথক মাস্টার প্ল্যানের ভিত্তিতে যদি দু’কোটি অধিবাসীর নিদানকালের মেঘ কেটে সূর্যের হাসির যদি দেখা মেলে।

হাওরের উর্বর মাটি, বিশাল জলরাশি এবং মানবকূল এখানকার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই তিন সম্পদের সমন্বিত ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করছে ডিজিটাল বালাদেশের সোনালি ভবিষ্যৎ। হাওরে জলাভূমি মিঠাপানির প্রাণবৈচিত্র্যের একটি বড় আবাসস্থল, যেখানে লুকিয়ে আছে বিশাল সম্পদ। এই বিশাল জলাভূমির ওপর শুধু হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্বই জড়িত নয়, এ জলাভূমির ইকোসিস্টেমের উপর মানবজীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি, মৎস্য, গ্যাস ও পর্যটন উৎস হতে পারে আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধ এবং সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম সোপান।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

> আরও পড়ুন- টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ- শেষ পর্বপর্যটকদের মন কেড়েছে নিকলী হাওরবালিখলা হাওরে আলো-আঁধারির খেলা

এসইউ/এএ/জেআইএম