ধর্ম

করোনা নিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত আলেমরা যা বলছেন

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসাই এ পরিস্থিতির অন্যতম দাবি। বিশ্ববিখ্যাত আলেমরাও বলছেন, করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে গোনাহ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসলেই মানুষ এসব মহামারি থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকবে। বিশ্ববিখ্যাত আলেমদের মতামত ও পরামর্শগুলো তুলে ধরা হলো-

Advertisement

আয়েজ আল কারনি‘লা তাহযান’ খ্যাত কিতাবের লেখক সৌদি আরবের বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার শায়খ ড. আয়াজ আল-কারনি বলেন, ‘মহামারি করোনায় আতঙ্কিত হয়ে বসে না থেকে নামাজ আদায় ও তেলাওয়াতে মগ্ন থাকুন। প্রাণঘাতী মহামারি করোনা থেকে মুক্তি লাভে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগির প্রতি জোর দিন।’ এক টুইট বার্তায় মুসলিম উম্মাহর প্রতি তিনি এ আহ্বান করেন।

তিনি আর বলেন, ‘করোনাভাইরাসে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে পরিবারের সঙ্গে ঘরে কাটানো সময়কে গুরুত্ব দিন। তাদের সঙ্গে নিয়ে-- নামাজ পড়ুন,- কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াত করুন, - মাতাপিতার সেবায় মনোযোগ দিন,- ছোট-বড় সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করুন,- নিজের ভুল কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে রোনাজারি করুন এবং- সতর্কতা অবলম্বন করুন।

মুফতি তকি উসমানি

Advertisement

বিশ্বব্যাপী আলোচিত করোনাভাইরাস নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি মুফতি তকি উসমানির গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে। সেটি এমন-

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভাইরাসটি প্রতিরোধের জন্য সর্তকতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ মনে করেন, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইসলামের তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী। এ কথাটি একেবারেই সঠিক নয়। স্বয়ং প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরকম (মহামারি) পরিস্থিতিতে পূর্ব সতকর্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। যেমন-‘তাউন বা প্লেগ রোগ কোথাও ছড়িয়ে পড়লে, বাহির থেকে কাউকে সেখানে যেমন যেতে বারণ করেছেন। আবার সেখান থেকে লোকদের বাহিরে আসতেও নিষেধ করেছেন।’

এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইসলামি শরিয়তের অন্তর্ভু্ক্ত বিষয়। সুতরাং এ ব্যাপারে সরকার প্রধান বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যেসব নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে, তা অনুসরণ করা শুধু উচিত-ই নয়, বরং শরিয়াতের দৃষ্টিতেও জরুরি।

Advertisement

করোনাসহ যে কোনো মহামারি রোধে রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলাও জরুরি। যেমন-

- অধিক হারে লোক সমাগম হয় এমন কোনো প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানে যেহেতু করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আংশকা প্রবল, তাই এ মুহূর্তে এমন প্রোগ্রামের আয়োজন না করাই উচিত।

- বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান ছোট পরিসরে করা উচিত। লোক সমাগম যেনো কম হয়। তাছাড়া বিয়ে শাদী ছোট পরিসরে হওয়াই সুন্নাহ। হয় বিয়ে শাদীর প্রোগ্রাম এ মুহূর্তে পিছিয়ে দিন অথবা পরিসর ছোট করুন।

- জুমআ ও অন্যান্য ফরজ নামাজের ক্ষেত্রে মসজিদে শুধু ফরজ পড়বে। বাকি সুন্নাত ও নফল নামাজ ঘরে আদায় করবে। তাছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায়ও নফল নামাজ ঘরে পড়াই উত্তম।

- এমনকি ওজুও বাসা থেকেই করে আসবে।

- এমনকি মসজিদের ইমাম ও খতিবদের জন্য নামাজের কেরাতও সংক্ষেপ করা উত্তম।

- স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় যদি মুসাফাহা (হ্যান্ডশ্যাক) না করার পরামর্শ দেয়া হয়, মুসাফাহা করবে না। কারণ তা ফরজ বা ওয়াজিব নয়। আর যা ফরয বা ওয়াজিব নয়, সেটা এ মুহূর্তে ত্যাগ করতে কোনো সমস্যা নেই।

ইসমাইল বিন মুসা মেনকবিশ্ববিখ্যাত জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলার জিম্বাবুয়ের ইসমাইল বিন মুসা মেনক করোনায় আতঙ্কিত হয়ে দুঃশ্চিরন্তা করতে নিষেধ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় প্রকাশ পাবে আমাদের কার ঈমান কতটুকু শক্তিশালী। দুঃখের বিষয় হলো আমরা এ পরীক্ষায় ফেল করতে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘করোনায় আতঙ্কিত হয়ে অন্যায়ভাবে আমরা বিভিন্ন পণ্য মজুদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের পণ্য মজুদের এ অবস্থাই প্রমাণ করে যে, আমরা আল্লাহর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছি।’

তিনি বলেন, ‘অন্যের বেলায় আমাদের তো সেই কাজই করা উচিত যা আমরা নিজেদের বেলায় নিজেদের জন্য পছন্দ করি। আমাদের তো এ অবস্থায় পণ্য মজুদ নয় বরং আল্লাহর আরও নৈকট্যশালী হওয়ার জন্য বেশি বেশি চেষ্টা করা উচিত।’

খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানিভারতের প্রসিদ্ধ আলেম খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস পুরো দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। যারা নিজেদের প্রযুক্তির উপর বড়াই করত এবং নিজেদের বিজ্ঞানকেই প্রভু তথা সর্বেসর্বা মনে করত তারাও এই অদৃশ্য ভাইরাস এর মোকাবেলায় নিজেদের অক্ষমতা ও অপরাগতার কথা স্বীকার করছে।

তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা এই দুনিয়ায় উপকার গ্রহণের জন্য এবং তার ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য উপায় অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই জন্যই চিকিৎসা এবং সর্তকতা দুটিরই গুরুত্ব রয়েছে। হাদিসে এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এমন কোনো অসুস্থতা নেই যার প্রতিষেধক আল্লাহ অবতীর্ণ করেননি।’ (আবু দাউদ)

সুতরাং করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে মহান আল্লাহর ওপর অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে কুরআনে বর্ণিত উপদেশ গ্রহণ ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে যে, তারা মসজিদের জামাআতে শরীক হবে না। কিন্তু সামাজিকভাবে মসজিদে জামাআত বন্ধ করে দেয়াকে তিনি ঠিক মনে করেন না।

ইউসুফ আল-কারযাভীআরব বিশ্বের প্রখ্যাত আলেম শায়খ ইউসুফ আল-কারযাভী বলেছেন, ‘আল্লাহর জিকির এমন একটি আধ্যাত্মিক শক্তি এবং এমন শক্তিশালী দুর্গ যেখানে সব সময় শান্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া যায়। যেখানে যুদ্ধের সময় শক্তি পাওয়া যায় এবং অস্থিরতার সময় স্থিরতা পাওয়া যায়। যেখানে নিরাশা বা হতাশার সময় আশা পাওয়া যায়।

তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই বিখ্যাত হাদিসের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। প্রিয় নবি বলেছেন, ‘এমন কোনো রোগ নেই যার প্রতিষেধক নেই।’ (আবু দাউদ)

মুফতি রফি উসমানিপাকিস্তানের প্রধান মুফতি ও দারুল উলুম করাচির মুহতামিম মাওলানা রফি উসমানি বলেছেন, বর্তমান করোনাভাইরাসে এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সমাধান হচ্ছে তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা।তিনি বলেন, ‘গোটা মুসলিম বিশ্বের উচিত, তারা তাদের গোনাহের জন্য তাওবা-ইসতেগফার করা। নিজেদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সুন্নাতের আমলগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করা। সেগুলো মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা।

এ সবের মধ্যে সবক্ষেত্রেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দেয়া। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতাকে ঈমানের অঙ্গ বলেছেন।

মুহাদ্দিস ড. শরীফ হাতেম আউনিবিশ্ববিখ্যাত বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ ড. শরীফ হাতেম আউনি সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ‘প্রার্থনা দিবস’ সম্পর্কে এক টুইটে লেখেন-

‘মানুষের ধোঁকা খাওয়ার একটা সীমা ‍থাকা উচিত। মানুষ সব সময় তার প্রকৃত অবস্থা নিয়ে অজ্ঞ! এখন সে (ট্রাম্প) বুঝতে পেরেছে যে, সে তো তার নিজকেও রক্ষা করতে সক্ষম নয়! সে সৃষ্টি জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি জীবের কাছে কত অসহায়, অক্ষম!

তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আহ্বান জানিয়েছেন, করোনা থেকে মুক্তি লাভের জন্য যেন দেশব্যাপী আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয়।’

বিশ্ব ওলামা সংঘের আহ্বানবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মসজিদসহ অন্যান্য ইবাদত স্থলগুলোও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের এ পরিস্থিতে যেন মুসলিম উম্মাহ ইবাদত-বন্দেগি থেকে বিরত না থাকে। বরং বাড়িতে থেকে অধিক পরিমাণে আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ওলামায়ে কেরামের আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্ব মুসলিম ওলামা সংঘ।

সংগঠনটি এক টুইটা বার্তায় এ ঘোষণা দেন। তাতে আরও বলা হয়, অন্তত ঘরে হলেও মুসলিম উম্মাহ যেন জামাআতে নামাজ আদায় অব্যাহত রাখে।

টুইটে বিশ্ব মুসলিম ওলামা সংঘ জানায়, মানব গোষ্ঠীর ওপর চলমান কঠিন এই বিপদের সময়ে মুসলিম উম্মাহর বেশি বেশি দান-সদকা ও ভাল কাজ করা উচিৎ।

তাছাড়া বেশি বেশি কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াতের আহ্বান জানান সংগঠনটি। যাতে কোনোভাবেই সময় অপচয় না হয়। অনর্থক সময় নষ্ট করা না হয়। বরং যেকোনো ইবাদতে প্রতিটি মুসলিম যেন ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে এবং সতর্কতা অবলম্বন করেন।

বিশেষ করেকরোনায় অতি আতঙ্কিত না হয়ে আল্লাহর সাহায্য লাভের পাশাপাশি সর্তকতা অবলম্বন করা একান্ত জরুরি। সতকর্তা বা সচেতনা দ্বীনি যে কোনো ইবাদত বা কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে না বরং তা সহায়ক। কেননা ইসলামের সবকিছুতেই মধ্যপন্থাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষায়, ‘মধ্যপন্থা মেনে যে কর্ম করা হয় সেটাই শ্রেষ্ঠ।’ (বায়হাকি)

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘদিনের খাদেম হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে রাসুল! আমি কীভাবে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করব? আমার উটনীটি ছেড়ে দিয়ে, না বেঁধে রেখে?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘প্রথমে তোমার উটনীটি বাঁধ, এরপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর।’ (তিরমিজি)

আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা যেমন একজন মুমিনের ঈমানের অপরিহার্য অংশ তেমনি সচেতনতা বা সতর্কতা অবলম্বনও খুবই জরুরি।

করোনায় শুধু সতকর্তা বা সচেতনতা অবলম্বনই নয় বরং করোনা প্রতিরোধে সতর্কতার সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহর ওপর যথাযথ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখাই জরুরি। গোনাহের কাজ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দিকে তাওবা-ইসতেগফার করে ফিরে আসায় রয়েছে কল্যাণ ও সফলতা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনা প্রতিরোধে সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি বিশ্ববিখ্যাত আলেম-ওলামাদের পরামর্শ গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আামিন।

এমএমএস/এমকেএইচ