রাজনীতি

অন্তর্ঘাতে রক্তাক্ত বিএনপি, ভেতরে বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া

অন্তর্ঘাতে রক্তাক্ত বিএনপি, ভেতরে বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া

টানা ১৯ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সরকার গঠন করতে পারে তারা। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একের পর এক অন্তর্ঘাতে রক্তাক্ত বিএনপি। বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণসহ নানান ধরনের অপরাধের ঘটনায় ক্ষুব্ধ দলটির সাধারণ নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও আমজনতা।

Advertisement

গত জানুয়ারি থেকে জুন- ছয় মাসে ৫২৯টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনায় অন্তত ৭৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ১২৪ জন। এর মধ্যে ৪৪৫টিই বিএনপির অন্তঃকোন্দল ও বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বলে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ষাণ্মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত সোমবার (৭ জুলাই) ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানুয়ারি-জুন ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এইচআরএসএস।

সর্বশেষ গত বুধবার (৯ জুলাই) পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে হত্যা করেন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।

ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ হত্যা মামলায় গ্রেফতার চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক রহমান রবিন। ছবি: জাগো নিউজ

Advertisement

আরও পড়ুনমিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দায় এড়াতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী: বিএনপি মিটফোর্ডে বর্বরতার দায় বিএনপিকেই নিতে হবে: ইসলামী আন্দোলন ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিএনপির ওপর দায় চাপানো নোংরা রাজনীতি

সোহাগ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন রাজধানীর চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন ও একই থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব অপু দাস।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অর্ধশতাধিক লোক এ হামলায় অংশ নেয়। এর মধ্যে রিয়াদ, সজীব, নান্নু, লম্বা মনির ও ছোট মনির— এই পাঁচজন মিলে সোহাগের মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারা সবাই মহিনের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূলহোতা মহিন, চকবাজার থানার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক রহমান রবিন ও মো. টিটন গাজীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এছাড়া এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কেরানীগঞ্জের ইবনে সিনা হাসপাতাল এলাকা থেকে দুই আসামি যুবদল নেতা মহিনের কর্মী লম্বা মনির ও মিটফোর্ড হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী ছোট মনিরকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ নিয়ে মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা এখনো পলাতক। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।

Advertisement

বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া

সোহাগ হত্যার ভিডিও দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এমনকি বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। হত্যার প্রতিবাদে এরই মধ্যে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

আরও পড়ুনচাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ, ব্যবসায়ীদের মারধর দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করলে অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে: শায়খ আহমাদুল্লাহ দেশব্যাপী চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে ইন্টেরিমকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের বাইরে রাখতে হবে: হাসনাত

সাবেক ছাত্রদল নেতা মামুন খান সরাসরি সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের কমিটি ভেঙে না দিলে, আমরা গুলশানের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় অভিমুখে মার্চ করব।’

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এই পৈশাচিক ঘটনা কেবল একটি জীবনহানিই নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গভীর হতাশার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সংগঠনের নীতি, আদর্শ ও রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাস এবং বর্বরতার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধী যেই হোক, তার স্থান কখনোই আইন ও ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, উল্লিখিত ঘটনাটির অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করুন। প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা নেওয়ার পরও, বিচ্ছিন্ন ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপানো অপরাজনীতি, এটা নোংরা রাজনীতির চর্চা।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠন কোনো অপরাধীকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, কোনোদিন দেবেও না। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান জিরো টলারেন্স।

সোহাগ হত্যার ঘটনায় যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রদলের অভিযুক্ত সদস্যদের আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।

আরও পড়ুন‘তারা প্রতি মাসে দুই লাখ করে টাকা চায়, না দেওয়ায় মেরেই ফেললো’ মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যা: ছাত্রদল-যুবদলে পদত্যাগের হিড়িক ‘আজীবনের জন্য ছাত্রদল-বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম’কুষ্টিয়ায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার বাড়িতে আগুন

যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় করা মামলার আসামি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকিকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

হত্যার শিকার ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ। ছবি: সংগৃহীত

এই অবস্থা কেন বিএনপির?

বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে কেন্দ্র ও তৃণমূলের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। স্থানীয় নেতৃত্ব কার্যত স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। সাধারণত নেতাকর্মীদের কোনো অপরাধের ঘটনা ভাইরাল হলে বা ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দোষীদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া বা দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের চাপে পদক্ষেপ না নেওয়ার সংস্কৃতি অপরাধপ্রবণতাকে উৎসাহিত করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, নৈতিকতা নয়, পেশিশক্তি ও অর্থ এখন বিএনপির পদ বণ্টনের মাপকাঠি। এ কারণে আদর্শিক কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। শেখ হাসিনার দীর্ঘ দমন-পীড়নের ফলে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ‘অস্তিত্ব রক্ষার’ নামে অপরাধকে হাতিয়ার বানাচ্ছেন। এছাড়া বহিরাগত দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশে দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

সমাধান কী?

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএনপির অস্তিত্ব আজ আর কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, তাদের লড়াই এখন নিজের ভেতরের অপশক্তির বিরুদ্ধে। এই দায়ভার থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আর সরে থাকার সুযোগ নেই। বিএনপি কি সত্যিকার অর্থে একজন রাষ্ট্রনায়কত্বের দল হিসেবে টিকে থাকতে চায়, না কি নিজের ভেতরেই নিঃশেষ হবে—এই মুহূর্তের সিদ্ধান্তই তা নির্ধারণ করবে।

সময় এখন নির্মোহ ও নিষ্ঠুর—দেরি করলে হয়তো পথই থাকবে না

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, অপরাধীর দলীয় পরিচয় বিবেচনা না করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দলের মূল্যায়ন কমিটি চালু করে দলীয় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে। বিতর্কিত, অনুপ্রবেশকারী ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের কোনোভাবেই বিএনপির মনোনয়ন ও পদ দেওয়া যাবে না। খুন-সন্ত্রাসে জড়িতদের শুধু দল থেকে বহিষ্কার নয়, রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

নেতৃত্ব কী বলছে?

বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জাগো নিউজকে বলেন, আমরা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রয়োজনে আরও কঠোর হবো।

আরও পড়ুন

‘আমরা যেন নরকে বাস করছি’: মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডে বললেন বাঁধন ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে খুনের ঘটনা বড়ই দুঃখজনক: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যায় নেটজুড়ে ক্ষোভ ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে হত্যার প্রতিবাদে মহানগর ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দলে দুষ্ট ও সুবিধাভোগীদের জায়গা নেই। শৃঙ্খলা ফেরাতে সময় লাগবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দলের ভেতরেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে প্রয়োজন হলে প্রতিদিন বহিষ্কার হবে, যত ইচ্ছা হবে।

তিনি বলেন, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় নিজ দলের ভেতরে কেউ অপকর্ম করলে তার বিরুদ্ধেও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেকে আছে গত ১৭ বছর জেলে গেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে কিন্তু এখন বিশৃঙ্খলায় জড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দল থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে। এমন বিশৃঙ্খলা হচ্ছে যে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।

বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এই নেতার মতে, প্রতিনিয়ত প্রতিটি ঘটনার পর আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে যে বিএনপিতে কেউ অপরাধ করলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্যই আমরা বিশৃঙ্খলা বন্ধ করব। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে।

বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, রাজনীতির সবচেয়ে গভীর সংকট হলো—দল গঠনে কোনো স্ট্যান্ডার্ড মানদণ্ড নেই। আজ দলগুলোতে অসংখ্য অঙ্গসংগঠন রয়েছে—যুবদল, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক দল কিংবা স্বেচ্ছাসেবক লীগ—এসবের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ নেই। এসব সংগঠনের হাতে প্রকৃত কোনো কাজ না থাকায় তারা নিজেরা কাজ তৈরি করে নেয়, যার সহজ পথ হলো চাঁদাবাজি।

আরও পড়ুনমিটফোর্ডের সামনে নৃশংস হত্যায় আরও একজন গ্রেফতার, মোট ৫ বিক্ষোভে উত্তাল সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ ফখরুলের মিটফোর্ডের নির্মমতায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছি: জামায়াত আমির

তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনীতি নিজের আয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলের কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই, নেতার কথাও তৃণমূল কর্মীরা শুনতে চায় না। গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা একটি বড় পরিবর্তন এনেছে—রাষ্ট্রক্ষমতা যেন এখন লুটপাটের উৎস। যখন একটি দল রাষ্ট্রকে লুটে নেয়, তখন অন্য দলগুলোও সেই সংস্কৃতিতে উৎসাহিত হয়।

অধ্যাপক সাব্বির বলেন, এখন আইন থাকলেও তা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ব্যবহার হয়। আগে আওয়ামী লীগ চলেছে, এখন বিএনপিও ক্ষমতায় না গিয়েই সেই একই মানসিকতা নিয়ে চলছে। কোনো রাজনৈতিক দলে নেই শৃঙ্খলা, নেই নৈতিক শিক্ষা। আমাদের দলগুলো চলছে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে।

'দলগুলোর এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—নেতাকর্মীদের নিয়মিত কিছু দায়িত্ব দিতে হবে। শুধু তারেক জিয়ার প্রোগ্রাম অনুযায়ী মাঠে নামা নয়, নেতাকর্মীদের বোঝাতে হবে, মিছিল-মিটিংয়ের বাইরে কীভাবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, সেটাই শিখতে হবে। সাংগঠনিকভাবে সংস্কার ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।'

জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টান্ত টেনে অধ্যাপক সাব্বির বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে জামায়াত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দল। তারা কর্মীদের চাকরি-বাকরি দেয়, কাজে লাগায়—এটা ইতিবাচক। কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো অর্থনৈতিক মডেল নেই—তাদের মডেল শুধু চাঁদাবাজি আর সরকারি সম্পত্তি অপচয়। দলকে নতুনভাবে ভাবতে হবে—কীভাবে সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সে পথে হাঁটতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতি বিশ্লেষক মোবাশ্বের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা কখনোই কোনো অপরাধে জড়াবে না—এমন নিশ্চয়তা দলটির পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অপরাধীদের যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তার দায় অবশ্যই বিএনপির। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, বিএনপির যেসব নেতাকর্মী অপরাধে জড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সে কারণে দলটিকে পুরোপুরি দায়ী করার সুযোগ নেই। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতার দায় সরকারের ঘাড়ে বর্তায়।

তিনি বলেন, বিএনপি যখন সরকারে ছিল, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দৃশ্যমান কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। সেনাবাহিনী দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ পরিচালনা করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়েছিল এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই র্যাব গঠন করে যৌথভাবে পুলিশের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার পরে র্যাবকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে সেই প্রতিষ্ঠানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। গত ১৬-১৭ বছরে ভদ্রলোকের পক্ষে রাজনীতি করা কার্যত অসম্ভব করে তোলা হয়েছে, ফলে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে দুর্বৃত্তরা।

'শুধু বহিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এরই মধ্যে ৪ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হলেও সহিংসতা থেমে নেই। এখন সময় এসেছে—অপরাধীর পাশাপাশি তাদের মদতদাতাদের, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন নেতাদেরও বহিষ্কার করার।'

মোবাশ্বের হোসেনের মতে, গত ১৫ বছরে রাজপথে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারার অন্যতম কারণ, বিএনপির ভেতরের সাহসী নেতাদের দমন ও কোণঠাসা করে রাখা। এ সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও সংক্রমিত হয়ে গেছে। তবে দলীয়ভাবে বিএনপি কখনো এসব কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয়নি, বরং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে।

তিনি বলেন, বিএনপির বর্তমান সিদ্ধান্ত ও অতীত ইতিহাস বলছে—আগামীতে যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তাহলে আইনশৃঙ্খলার ব্যত্যয়ে জড়িত অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যদি তারা ছাড় দেয়, তবে আওয়ামী লীগের মতোই পরিণতি বরণ করতে হবে—যেটা শেখ হাসিনার পরিণতির মধ্য দিয়ে এখন স্পষ্ট।

মোবাশ্বের হোসেনের ভাষ্যমতে, সময় বড়ই নির্মম। এখনই শুদ্ধি অভিযান শুরু না করলে ভবিষ্যতে হয়তো বিএনপির সামনে কোনো পথই খোলা থাকবে না।

কেএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম