স্বাস্থ্য

টেস্ট-চিকিৎসাও কি গুজব?

‘এক বছরের বাচ্চাটার হাত ফুটো হয়ে গেছে টেস্টের জন্য রক্ত দিতে দিতে। গত কয়েক দিন হাসপাতালে পড়ে আছি। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিচ্ছেন- এসবও কি গুজব?’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মেয়র সাঈদ খোকনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়লেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাজমুন নাহার।

Advertisement

এক বছরের শিশু আব্দুল্লাহকে কোলে নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের একটি বিছানায় বসেছিলেন তিনি।

সাংবাদিক পরিচয় শুনে নাজমুন নাহার বললেন, ‘শুনলাম দক্ষিণের মেয়র ডেঙ্গুকে গুজব বলেছেন। কিসের ভিত্তিতে তিনি এটা বললেন? তিনি কি শহরের হাসপাতালগুলোর খবর রাখেন না!’

কথা বলতে বলতে কোলে রাখা ছেলেকে চামচ দিয়ে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন নাজমুন নাহার।

Advertisement

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে ছেলের খুব জ্বর আসার পরদিন ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। ওকে নিয়ে চারদিন হাসপাতালে আছি। আমরা জানি, সন্তানের এ কষ্ট চোখে দেখা কত যন্ত্রণার!’

নাজমুন নাহার আরও বলেন, ‘সরকার একদিকে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার ওপর স্বীকারও করছে না এর ভয়াবহতা। সরকারের উচিত ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদাভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। দরিদ্রদের জন্য এ চিকিৎসা বিনামূল্যে হওয়া উচিত।’

পাশের বিছানায় দুই বছর বয়সী নাতনিকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন জাহানারা বেগম। তিনি এসেছেন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচা থেকে। সেখানে দু’দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পরে নাতনি আলিফকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন তিনি।

জাহানারা বেগম বলেন, ‘এক কাপড়ে চলে এসেছি। এখনে বাচ্চাদের খাবার দেয়া হয় না। ঢাকায় তেমন আত্মীয় নেই। কিনে খাওয়ার মতো টাকাও নেই। খুব কষ্টে আছি।’

Advertisement

শিশু হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

জাহানারা বেগম বলেন, সাধারণ ওয়ার্ডে রোগীদের তুলনায় কেবিনের রোগীদের যত্ন নেয়া হয় বেশি।

জাহানারা বেগমের সঙ্গে একমত নাজমুন নাহারও। বলেন, ‘সারাদিনে ওয়ার্ডের রোগীদের ব্লাড প্রেসার মাপা হয় দুবার। আর কেবিনের রোগীদের মাপা হয় ঘণ্টায় দুবার। এখানে টাকা দিলে সেবা পাওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, প্রথম তিনদিনে ৩ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়ায় কেবিনে ছিলাম আমরা। কিন্তু আর কুলাতে না পেরে ৫০০ টাকা ভাড়ায় ওয়ার্ডের বিছানায় এসেছি।

চার বছরের ছেলে জুবায়ের রহমানকে হাসপাতালের বিছানায় বসে ফল খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন ফার্মগেটের বাসিন্দা খাদিজা বেগম। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘চার সন্তানের একজনকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। দুশ্চিন্তায় আছি বাকিদের নিয়েও।’

সবচেয়ে ছোট আড়াই বছরের বাচ্চাসহ বাকি তিন সন্তানকে আত্মীয়ের বাসায় রেখে এসেছেন তিনি।

খাদিজা বেগম বলেন, ‘শিশু হাসপাতালে সিট পেয়েছি- এটাই বিরাট ব্যাপার। না হলে অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় যেতাম জানি না।’

হাসপাতালের নার্সরা জানান, এমন কোনো ওয়ার্ড নেই যেখানে ডেঙ্গু রোগী নেই।

বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে মেলে এ কথার সত্যতা। বিছানায় বিছনায় কাতরাচ্ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোমলমতি শিশুরা। কেউ কেউ জ্বরের প্রকোপে বমিও করছে।

স্বজনরা বলছেন, সবচেয়ে ভয় কখন ব্লাড প্রেসার কমে যায়। আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা জয়তুন খাতুন বলেন, ‘গতকাল রাতে আমার ছেলের প্রেসার একেবারেই কমে গিয়েছিল। ভয় পেয়েছিলাম। আজ অবশ্য ভালো আছে।’

ছয়দিন ধরে হাসপাতালই ঘর হয়ে উঠেছে এ পরিবারের। আশপাশের বিছানাগুলোতে মশারি দেখা না গেলেও জয়তুন পাঁচ বছরের ছেলে মেজবাউল হাসানকে শুইয়ে রেখেছেন মশারির ভেতর।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘কী ভয়ঙ্কর এক একটা রাত কাটছে কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।’

এদিকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পাশাপাশি বহির্বিভাগেও দেখা গেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত বা ডেঙ্গু সন্দেহে এমন রোগীর চাপ।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আনিসুল হক তার দেড় বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বহির্বিভাগে।

তিনি বলেন, ‘গতকাল থেকে তীব্র জ্বর। দেরি না করে আজই ডাক্তারের কাছে আনলাম। কিন্তু এত রোগীর চাপ যে ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আমার সিরিয়াল আসেনি।’

হাসপাতালে সিট না পাওয়া নিয়েও হতাশা প্রকাশ করলেন অনেকে।

জেপি/এনডিএস/এমকেএইচ