মতামত

কোথায় হাঁটবো মাননীয় মেয়র?

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গত ৭ জুলাই গাবতলী থেকে আজিমপুর, সায়েন্সল্যাব থেকে শাহবাগ এবং কুড়িল থেকে বাড্ডা ও রামপুরা হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশা বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগের দূরত্ব সামান্য হলেও কুড়িল থেকে সায়েদাবাদ এবং গাবতলি থেকে আজিমপুরের দূরত্ব অনেক।

Advertisement

গুগল ম্যাপের হিসাবে গাবতলি থেকে আজিমপুরের দূরত্ব (কল্যাণপুর ও আসাদগেট হয়ে) প্রায় ৯ কিলোমিটার আর কুড়িল থেকে সায়েদাবাদ প্রায় ১৪ কিলোমিটার। এই পথে বাড্ডা-রামপুরা এলাকারমানুষের একটা বড় অংশই রিকশার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন এই দীর্ঘ থেকে রিকশা বন্ধ করে দেয়ায় সেই মানুষগুলো কীভাবে অল্প ও মাঝারি দূরত্বে যাবেন, সেটি একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশু, বয়স্ক এবং নারীরা। দ্বিতীয়ত এইসব রুটে যারা রিকশা চালাতেন তারাও নিজেদের জীবিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তারা রাস্তায় নেমে সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন অবশ্য অল্প দূরত্বে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমাদের দেখা দরকার রাজধানীতে গণপরিবহন বলতে আসলে কী আছে সেগুলো কতটা জনবান্ধব এবং সেইসাথে কতটা সহজলভ্য? রাজধানীর প্রধান গণপরিবহন পাবলিক বাস। এর মধ্যে অধিকাংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং সামান্য কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিআরটিসি। এই মহানগরীর পাবলিক পরিবহন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের পারসেপশন এবং বাস্তবতা এরকম:

১. যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা যথেষ্ট কম। ফলে সকালে অফিসে যাওয়া এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় বিভিন্ন স্পটে বিশেষ করে মিরপুর, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিল, শ্যামলি, মোহাম্মদপুর, রামপুরা এলাকায় বাসের জন্য মানুষকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সবার পক্ষে ঠেলাঠেলি করে বাসে ওঠা সম্ভব হয় না। অনেক একটি বা দুটি স্টপেজ হেঁটে পরের স্টপেজ থেকে ওঠার চেষ্টা করেন। অনেক সময় সেটিও ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে বয়স্ক এবং নারীদের কষ্টের সীমা থাকে না।

Advertisement

২. পাবলিক বাসে পুরুষ যাত্রীদের দ্বারা নারীদের হয়রানি, হেল্পার-কন্ডাক্টরদের অশালীন আচরণ, ভাড়া এবং ঘন ঘন স্টপেজ নিয়ে যাত্রীদের সাথে তাদের বচসা; ইচ্ছা করে সিগন্যালের কাছে গিয়ে গতি কমিয়ে পরের সিগন্যাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাতে আরও কিছু যাত্রী গাদাগাদি করে নেয়া যায়; একই রুটের বাসের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা; লাইসেন্সবিহীন চালক এবং আনফিট বাস ইত্যাদি অভিযোগ রাজধানীর পাবলিক বাসের বিরুদ্ধে বহু পুরনো।

৩. রাজধানীর ট্র্র্যাফিক জ্যামের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ অফিসগামী সেই ভদ্রলোকের মতো, যিনি বাস থেকে নেমে দৌড় শুরু করেছিলেন। তখন উৎসুক লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন ভাই দৌড়াচ্ছেন কেন? তখন ওই ভদ্রলোক জানান, তার তাড়া আছে তাই বাস থেকে নেমে দৌড় দিয়েছেন। অর্থাৎ দ্রুত যাওয়ার জন্য এই শহরে এখন পাবলিক পরিবহনের ওপর ভরসা করার কোনো সুযোগ নেই। বরং মানুষ হেঁটে গেলেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আগে পৌঁছাতে পারে।

৪. ঢাকা শহরের গণপরিবহনের আরেকটি বিকল্প সিএনজি অটোরিকশা। আর দশটি জিনিসের মতো এটিরও শুরুটা ভালোই ছিল। নির্দিষ্ট গন্তব্য জেনে চালকরা মিটার চালু করতেন এবং গন্তব্যে নামার পর মিটারে ওঠা বিল পরিশোধ করতেন। কিন্তু সেটি এখন অতীত। রাজধানীরকোনো অটোরিকশা মিটারে চলে না। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নিজে একাধিকবার এই সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছেন, তাতে পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে যারা ভোরে সদরঘাট থেকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশার সাথে দরদামকরেন, সেই অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন, ভোরবেলা সেখানে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

মিটারে এলে কিংবা স্বাভাবিক হিসাবে যে পথের ভাড়া বড়জোর দুইশো টাকা, সেখানে সদরঘাট থেকে সিএনজি অটো চালকরা ছয়-সাতশো টাকা ভাড়া হাঁকেন। সবার পক্ষেভারি ব্যাগ ও শিশুদের নিয়ে বাসে ওঠা সম্ভব হয় না। আবার সবাই এত টাকা ভাড়া দিয়ে অটোরিকশায়ও উঠতে পারেন না। ফলে ভোরে সদরঘাট থেকে কোথাও যাওয়া এবং বিকালের পরে সদরঘাটে যাওয়ার সময় সিএনজি অটোরিকশা পেতে গিয়ে এই মহানগরীর মানুষকে কী দুর্দশায় পড়তে হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে আন্দাজ করাও কঠিন।

Advertisement

৫. রাজধানীর বিভিন্ন রুটে লেগুনা নামে এক ধরনের পাবলিক পরিবহন চলে যেগুলো স্বল্প দূরত্বে যাত্রী আনা-নেয়া করে। এর ভাড়াও তুলনামূলক কম। কিন্তু সম্ভবত রাজধানীর সবচেয়ে বেপরোয়া বাহন এই লেগুনা। এই বাহনে যাদের চড়ার অভিজ্ঞতা আছে বা যারা এর গতিবিধি খেয়াল করেন, দেখবেন এরা ভিড়ের মধ্যেও সব ভেঙেচুরে চলে যেতে চায়। রিকশাকে ধাক্কা দেয়া, সাইড না দিলে চালকদের অকথ্য গালাগাল পরিচিত দৃশ্য। তাছাড়া এগুলোয় বসার যে আয়োজন, তাও অত্যন্ত অমানবিক, অসম্মানজনক।

লেগুনার কোনো নিবন্ধন কিংবা এর চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না তাও সন্দেহ। আবার লেগুনার একটা বড় অংশই চালায় বয়সে কিশোর-তরুণরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তখন রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলা এই লেগুনাকে অবৈধ উল্লেখ করে সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু পরে সেটি কীভাবে বৈধ হলো তা পরিস্কার নয়। শোন যায়, রাজধানীর এই লেগুনা সার্ভিসের সাথে অত্যন্ত প্রভাবশালীরা জড়িত। সুতরাং চাইলেই এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আবার যেসব রুটে লেগুনা চলে, সেখানে এর উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা না করে এটি বন্ধ করাও কোনো সমাধান নয়। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

৬. পাবলিক বাস ও সিএনজি অটোরিকশার এই দৌরাত্ম্যের দিন বুঝি শেষ হয়ে এসেছিল যখন পৃথিবীর নানা দেশের মতো ঢাকায়ও রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা চালু হলো। বিশ্বব্যাপী পরিচিত উবারের পাশাপাশি সেই তালিকায় নাম লেখালো পাঠাও, ও ভাইসহ নানা সার্ভিস। এসবরাইড শেয়ারিং জনপ্রিয় হচ্ছিলো। কিন্তু এখন মাঝেমধ্যেই এই সার্ভিসের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ উঠছে।

পদ্ধতিটা হলো কেউ একজন তার ব্যক্তিগত গাড়িতে অফিসে বা বাসায় যাওয়ার পথে আরেকজনকে নিয়ে যাবেন। এর দ্বারা চালকের নিজের যেমন লাভ, তেমনি যিনি যাবেন তারও লাভ। এ কারণেই বলা হয় রাইড শেয়ারিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই শেয়ারিংয়ের সুযোগ গিয়ে কিছু লোক এটাকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে গিয়ে শুধু এই সার্ভিসের জন্যই প্রাইভেট কার নামালেন। সেখানে তারা আর শেয়ারিংয়ের আইডিয়ায় না থেকে এটাকে আরেকটা সিএনজি অটোরিকশা সার্ভিসে পরিণত করেছেন। অনেক সময়ই যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের অশালীন আচরণ এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নটি সামনে এসেছে। আবার উবার চালককে খুন করে গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে।

রাজধানীর গণপরিবহনের এই যখন দশা, তখন মেয়র সাঈদ খোকনের কথাই ঠিক যে, অল্প দূরত্বে হাঁটুন। এটা যুক্তিপূর্ণ কথা। এক-দুই কিলোমিটার তো হাঁটাই যায়। কিন্তু যিনি মিরপুর থেকে মতিঝিল যাবেন তিার কী হবে? আবার শিশু-বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধী মানুষেরা কী করবেন?তাদের জন্য মেয়র মহোদয়ের পরামর্শ কী? তারপরও তর্কের খাতিয়ে ধরে নিচ্ছি যে সবাই হাঁটবেন। হাঁটলে শরীরও সুস্থ থাকে। কিন্তু নাগরিকরা কোথায় হাঁটবে পুরো রাজধানীতে সংসদ ভবনের চারপাশ ছাড়া আর কোথাও হাঁটার জন্য এরকম সুন্দর ফুটপাত আছে? হাঁটার জায়গাতো দূরে থাক, অনেক জায়গায় রাস্তার পাশে যে ফুটপাত আছে সেটি বুঝতে গেলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে।

কোথাও কোথাও স্থানীয় প্রভাবশালীরা এমনভাবে স্থাপনা তৈরি করে রেখেছেন যে, মেয়র মহোদয় সেগুলো ভাঙতে গেলে উল্টো ফাপরে পড়বেন। এটি হলো ফুটপাতের একটিবাস্তবতা। অন্য বাস্তবতা হলো, প্রায় ১৭ কোটি লোকের ঘনবসতিপূর্ণ দেশে গরিব মানুষ নানারকম কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে। ফুটপাতে ছোট দোকান দিয়ে অসংখ্য মানুষের সংসার চলে। অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলে ‘ইনফরমাল ইকোনমি’— সামগ্রিক অর্থনীতিতে যেটিরও গুরুত্ব আছে। সুতরাং ফুটপাতে থেকে হকার ও দোকান উচ্ছেদ করলে নাগরিকের পথচলা স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে বটে, তাতে অসংখ্য মানুষের পেটেও লাথি পড়বে। ফলে এই কন্ট্রাডিকশনও মাথায় রাখতে হয়।

তাহলে রাজধানীর মানুষ কী করবে? একটা প্রবাদ আছে: ‘আপনি কেমনও করতে পারবেন না’। অর্থাৎ এই মহানগরীর মানুষ এত বেশি সমস্যায় জর্জরিত যে, এখানে যেকোনো ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন, তার নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়। একটি পক্ষের সুবিধার জন্য একটিব্যবস্থা নেয়া হলে সেটি আরেকটি পক্ষের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে। এখানেই নীতিনির্ধারকদের মুন্সিয়ানার পরীক্ষা। তাদের এমন ব্যবস্থা নিতে হয় যাতে সাপ মরে এবং লাঠিও না ভাঙে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের উন্নয়নপরিকল্পনায় শুধু সাপ মারার ব্যবস্থাই করা হয়, কিন্তু ততক্ষণে লাঠিটা আর অক্ষত থাকে না।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এইচআর/জেআইএম