বিশেষ প্রতিবেদন

গ্যাসের সংকট বাড়াতেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে বাপেক্সকে

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সকল প্রকার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। দীর্ঘ আলোচনায় অর্থনীতি, জ্বালানি ও উন্নয়নের নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।

Advertisement

জাগো নিউজ : ফের বাড়ছে গ্যাসের দাম। গত ১০ বছরে সাতবার বাড়ানো হলো গ্যাসের মূল্য। বেড়েছে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য জ্বালানির মূল্যও। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিবাদও করছেন বারবার। এবারে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

আরও পড়ুন >> উন্নতি চাইলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিতে হবে

আনু মুহাম্মদ : আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি’র মতো যেসব সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত তাদের নীতি-কাঠামোর মধ্যেই সেবা খাতের দাম বাড়ানোর কথা বলা আছে। এটা অনেক অর্থনীতির বিশ্লেষকই হয়ত বুঝতে পারেন না। বাংলাদেশে যে শাসক-শ্রেণি দেশ চালাচ্ছে এবং যে কোটিপতিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তাদের জন্য এ নীতি-কাঠামো একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং দেশীয় ধনিক শ্রেণির স্বার্থটা একই ফ্রেমে চলে এসেছে। এরা সবাই চায় সেবা খাতে দাম বাড়ুক এবং বেসরকারিকরণ হয়ে যাক।

Advertisement

জাগো নিউজ : সরকার তো জনগণের কথা বলতে চায়। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আসলে সরকারের এজেন্ডা কী?

আনু মুহাম্মদ : আইএমএফ-এর কাছ থেকে অপ্রয়োজনীয় ঋণ নেয়া হয়েছে, যেখানে শর্তই ছিল গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। বরাবর তা-ই হয়ে আসছে। দাতা সংস্থাগুলোর শর্ত একটাই, তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়।

জ্বালানি খাত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এবং এখানে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকার কথা। এ খাতকে আগে লাভজনক খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে জ্বালানি খাতে মুনাফার ভাবনা আসতে থাকে এবং বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অর্থাৎ সরকারি মালিকানা থেকে ব্যক্তি-মালিকানায় দিয়ে মুনাফা লাভকেই মুখ্য করে তোলা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি মুনাফালোভীদের স্বার্থ নিশ্চিত করতেই জ্বালানির নীতি-কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন >> গ্যাসের দাম বাড়ানোয় জনগণ হতাশ : সংসদে মেনন

Advertisement

ছয় বছর আগেও আমরা ধারণা করেছিলাম, সরকার গ্যাসের দাম বাড়াতেই থাকবে। বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আগে থেকেই নীতিগ্রহণ করে রেখেছে জ্বালানির দাম বাড়ানোর। আমি এ নিয়ে বহু লিখেছি। জাগো নিউজ : দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দিয়ে সুদ নেবে এবং সেটা যেকোনো উপায়েই সরকারগুলো পরিশোধ করতে বাধ্য। কিন্তু জ্বালানির দাম বাড়ানোর শর্ত...

আনু মুহাম্মদ : দাতা সংস্থাগুলো মূলত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চায় মুনাফা-নির্ভর বহুজাতিক কোম্পানির বিস্তার ঘটুক সর্বত্রই। এ কারণেই এসব দাতা সংস্থা রাষ্ট্রীয় সার্ভিসের পরিবর্তে ব্যক্তিমালিকানায় সেবা খাতকে দিয়ে দিতে তৎপর থাকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানির সেবা নিশ্চিত থাকলে মুনাফা মুখ্য হবে না। তারা চায় সব খাত বেসরকারিকরণ হোক, যাতে মুনাফা নিশ্চিত থাকে।

গ্যাসের দাম না বাড়ালে তো যারা এখানে বিনিয়োগ করবে, তাদের জন্য লাভজনক হবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি- সবই তো বেসরকারি খাতে চলে যাচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলো প্রতিনিধি হয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। বৈশ্বিক ধারণা থেকে যে কেউ এটা পরিষ্কার বুঝতে পারেন।

জাগো নিউজ : এবারের গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কি সেই ছকেই?

আনু মুহাম্মদ : এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা শুনে আসছি আমরা আগে থেকেই। এলএনজি আমদানি করা হয়নি, অথচ আমরা কয়েক দফা গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেতে দেখলাম। তার মানে, সরকারের পরিকল্পনার মধ্যেই এটা ছিল।

আরও পড়ুন >> গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি কার স্বার্থে?

এলএনজির সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় কোম্পানি, দেশীয় ভাগিদাররাও আছে। তারা সবাই মিলে জোট করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে ব্যবসা করবে। অথচ, আমাদের পরামর্শ নিলে সেটা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। জাগো নিউজ : কী পরামর্শ? আনু মুহাম্মদ : আমরা দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস ও তেলের অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে আসছি। সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলছি। সরকার আমাদের কথা শুনলে এলএনজি আমদানির দরকার পড়ত না। গ্যাস বা জ্বালানির দামও বাড়ানো দারকার হতো না।

গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম চালালে আমরা অনেক কম খরচে নিজেদের গ্যাস ব্যবহার করতে পারতাম। ২০০৯ সালে আমরা যখন কনোকো ফিলিপস’র সঙ্গে চুক্তি বাতিলের দাবি করলাম, তখন আমাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হলো। সেই কনোকো ফিলিপস শেয়ারের দাম বাড়িয়ে চলে গেল। তারা কোনো অনুসন্ধান ঠিক মতো করেনি।

জাগো নিউজ : আপনারা কী চেয়েছিলেন?

আনু মুহাম্মদ : আমরা বলেছিলাম, প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসে আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান টিমের সক্ষমতা বাড়ানো হোক। সরকার সে পথে যায়নি।

জাগো নিউজ : সরকার কি সে পথে হাঁটছে না?

আনু মুহাম্মদ : পরিকল্পিতভাবে সরকার জ্বালানি অনুসন্ধানে সক্ষমতা অর্জন করছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, সমুদ্রের গ্যাস ব্লকগুলো বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে রফতানিমুখী চুক্তি ছিল সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা এর বিরোধিতা করেছি। বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার চুক্তিগুলো করে ফেলল। আমরা দেখেছি, মার্কিন যে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তাদের শেয়ারের দাম রাতারাতি বেড়ে গেল। মুনাফার পাহাড় গড়ে নিল। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম কমে গেল, তখন তারা চলে গেল। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম কমল কী বাড়ল, তা তো আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের দরকার গ্যাসের।

আরও পড়ুন >> ‘গ্যাস পাচ্ছে, এটাই ভোক্তাদের বড় সুবিধা’

এ কারণে জ্বালানির ওপর আমরা জাতীয় মালিকানার বিষয়টি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে আসছি। এটা জরুরি এ কারণে যে, বিদেশি কোম্পানি লাভ-লোকসানের হিসাব নিয়ে গ্যাসের অনুসন্ধন করবে, উত্তোলন করবে। আর মুনাফা না থাকলে তারা করবে না। কিন্তু জাতীয় মালিকানা থাকলে আমরা ধীরে ধীরে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাসের শতভাগ ব্যবহার করতে পারব।

সরকার আমাদের কথা না শুনে কনোকো ফিলিপসকে ডেকে আনল। আর ওই কোম্পানির লবিস্ট ছিল জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের লোকেরাই। যখন এটা ব্যর্থ হলো, তখন এলএনজি ও এলপিজি গ্যাস আমদানির দিকে গেল সরকার। মূলত, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে এ সিদ্ধান্ত। অথচ, এর আগে সরকার গ্যাস রফতানির চুক্তি করেছিল। অর্থাৎ কমিশন খেয়ে দুই পক্ষই লাভবান হয়ে চুক্তি করল, অথচ প্রজেক্ট আটকে যাওয়ায় বাংলাদেশ কিছুই পেল না।

জাগো নিউজ : এলএনজি বা এলপিজি আমদানি হতেই পারে। এর সঙ্গে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সম্পর্ক কী?

আনু মুহাম্মদ : দেশে নিজস্ব গ্যাসের সরবরাহ থাকলে অথবা দাম কম থাকলে এলএনজি তো আমদানি করে কোনো লাভ হবে না। গ্যাসের সংকট বাড়াতেই বাপেক্সকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। বাপেক্স নিষ্ক্রিয় রেখে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েক গুণ বেশি খরচে চুক্তি করা হলো। এতে যেমন খরচ বাড়ছে, গ্যাসের দামও বাড়ছে। অথচ গ্যাজপ্রম কোনো কাজ-ই করেনি। গ্যাজপ্রমের লবিস্টরাও খুব শক্তিশালী। চুক্তি নিয়ে যাতে লেখালেখি না হয়, সেজন্য ফাইল গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। গ্যাজপ্রমের বিরুদ্ধে বাপেক্সের যে কর্মকর্তারা কথা বলছেন, তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন >> রশিদপুরের দুই কূপে মেলেনি গ্যাস

বাপেক্সকে কাজ করতে না দিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বহু আগে থেকে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, যমুনার মতো শক্তিশালী কোম্পানির হয়ে এলপিজি আমদানির কথা বলে আসছেন। এলপিজি ব্যবসার প্রধান বাজার হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর। গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং দাম বাড়ালেই এলএনজি ও এলপিজি ব্যবসা রমরমা হবে। দাম বাড়লে পাইপ লাইনে গ্যাসের ওপর এমনিতেই মানুষ ভরসা রাখবে না।

জাগো নিউজ : পাইপ লাইনে গ্যাস তো সারাদেশের মানুষ ব্যবহার করছে না। অন্তত সরকারের লোকজন তা-ই বোঝাতে চাচ্ছেন…

আনু মুহাম্মদ : এটা তাদের বানোয়াট কথা। গ্যাসের দাম বাড়ালে অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, তাতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে গ্যাস ব্যবহার করে না, তাকেও মাশুল দিতে হবে। কারণ, গ্যাসের ব্যবহার তো শুধু রান্নার কাজে নয়। কাঁচামাল হিসেবে গ্যাসের নানামুখী ব্যবহার হয়।

গ্যাসের দাম বাড়লে কল-কারখানা, শিল্প, বিদ্যুতের ওপর এমনিতেই চাপ বাড়বে। যে বাড়িতে গ্যাস কোনোদিন ব্যবহারই হয়নি, সে বাড়িতেও ভাড়া বাড়ানো হবে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সীমিত আয়ের মানুষ। আর উৎপাদনশীল শিল্পের ওপর সরাসরি চাপ পড়বে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে খরচের ব্যবধান বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতির ওপর।

এএসএস/এমএআর/এমআরএম