কৃষি ও প্রকৃতি

১৮৭২ সালে ‘বেগম’ বন্দি হয় লন্ডনে

আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে গন্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে বুনো পরিবেশে পাঁচ প্রজাতির গন্ডারের বাস। যার দু’টি ছিল আফ্রিকায় ও তিনটি ছিল এশিয়ায়। এশিয়ার তিনটি গন্ডার প্রজাতির সবই ছিল বাংলাদেশে। কালের বিবর্তনে বসতি হারিয়ে, শিকারির শিকার হয়ে সব গন্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

Advertisement

অতীত নথিপত্র, জেলাভিত্তিক গেজেটিয়ার, ব্রিটিশ শাসনামলের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তরে তিস্তা অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তিন প্রজাতির গন্ডারের বসতি। সর্বশেষ জীবিত গন্ডারটিকে অর্থের লোভে তৎকালীন বৃটিশ সরকার পাঁচ হাজার পাউন্ডে লন্ডন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয় ১৮৭২ সালে।

গন্ডার একপ্রকার স্তন্যপায়ী তৃণভোজী প্রাণী। এটি রাইনোসেরোটিডি পরিবারের অন্তর্গত। বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত তিন প্রজাতির গন্ডারের বসতির বিস্তৃতি ছিল যথাক্রমে: একশিঙ্গি বড় গন্ডার নেপাল সিকিম থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। সুন্দরবন, যশোর থেকে বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। সুন্দরবন ও যশোর থেকে শিকার করা এমন ১১টি একশিঙ্গি ছোট গন্ডার কলকাতা, বার্লিন ও লন্ডন জাদুঘরে তখন নিয়ে যাওয়া হয়। দুইশিঙ্গি গন্ডারের আবাস কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ছিল।

আরও পড়ুন- সড়ক ও রেলপথে হুমকির মুখে বন্যপ্রাণী

Advertisement

সুন্দরবনে আদি সভ্যতার প্রত্নস্থলের আবিষ্কারক ইসমে আজম ঋজু গন্ডারের বিলুপ্তি এবং তার সর্বশেষ বসবাসের অবস্থান নিয়ে জাগো নিউজকে জানান, ১৮৭৬ সালে কুমিল্লায় একটি দুইশিঙ্গি গন্ডার গুলি করে মারা হয়। ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম থেকে একটি গন্ডার ধরা হয়। যেটি ছিল দুইশিঙ্গি গন্ডার। এটি বাংলাদেশের শেষ জীবিত গন্ডার ‘বেগম’। ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের দক্ষিণের কোন একস্থানে এটি মানুষের হাতে বন্দি হয়। চোরাবালিতে আটকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল গন্ডারটি। স্থানীয় লোকজন গন্ডারটিকে চোরাবালি থেকে তুলে আটকে রেখে প্রশাসনকে জানায়। ব্রিটিশ সরকারের ক্যাপ্টেন হুড ও মি. উইকস আটটি হাতি নিয়ে ১৬ ঘণ্টা কঠোর চেষ্টার পর এটিকে বন্দি করে। অর্থের লোভ সামলাতে পারেনি ব্রিটিশ কর্মকর্তা। ১৮৭২ সালে বাংলাদেশের জীবিত শেষ গন্ডারটিকে ৫ হাজার পাউন্ডে কিনে লন্ডন চিড়িয়াখানা বিক্রি করেন। নিজ বসতভিটা ছেড়ে বেগম বন্দি হলো লন্ডনের খাঁচায়। এই গন্ডারের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের গন্ডার প্রজাতি।

গবেষক ইসমে আজম ঋজু আফসোস করে বলেন, ‘এত বড় বাংলায় আমরা ‘বেগমের’ জন্য একটু জায়গা করে দিতে পারিনি। আমাদের লোভ, প্রভুদের খেতাব পাওয়ার আশা হয়তো সেদিন ভিজেছিল ‘বেগমের’ চোখের পানিতে। আজও সে লোভ-নিষ্ঠুরতা ভিজে ধুয়ে যেতে পারেনি হাজারও বন্যপ্রাণীর চোখের পানিতে।’

লন্ডন চিড়িয়াখানায় তার নাম দেওয়া হল ‘বেগম’। লন্ডনে মি. কিউলমান নামের এক আঁকিয়ে আঁকলেন মানুষের নজরে আসা বাংলাদেশের জীবিত শেষ গন্ডারের ছবিটি।

আরও পড়ুন- ধ্বংস হচ্ছে জাবি’র জীববৈচিত্র

Advertisement

জীবিত গন্ডারের ছবিটি আসাম থেকে তোলা

‘বেগম’কে বাংলাদেশের শেষ গন্ডার উল্লেখ করলেও গবেষক ইসমে আজম ঋজু সুন্দরবনে গবেষণা করে পেয়েছেন আরও কিছু তথ্য। সেই তথ্য অনুসারে, ১৮৬৮ সালের দিকে বাংলাদেশের শেষ গন্ডারের কথা বলা হলেও সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০০ সালের শেষ দিকে বা ১৯০০ সালের প্রথম দিকে সুন্দরবনের নলিয়ান থেকে একটি গন্ডার শিকার করের কালাচাঁদ নামের এক শিকারি। খুলনার রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী শেষ ১৮৮৫ সালে সুন্দরবনে গন্ডারের পায়ের চিহ্ন দেখেছিলেন। তারপর সুন্দরবনে বা বাংলাদেশের কোথাও গন্ডারের উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমের সুবাদে সমগ্র সুন্দরবন ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ সালে বাঘবিষয়ক একটি গবেষণা কার্যক্রমের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়। মাঠপর্যায়ের সেই গবেষণাকালে আমার দলের নাম দিয়েছিলাম টিম রাইন (গন্ডারের দল)। এই নামের উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবন থেকে গন্ডারের মতো প্রাণীর বিলুপ্তির কথা মনে রেখে বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে চলা। সেইসঙ্গে এত বড় একটি বনে বাঘের স্থান হলেও গন্ডারের বিলুপ্তির কারণ যাচাই করা। বনভূমি ও ইতিহাস অনুসন্ধানে বুঝেছিলাম, সম্ভবত সুন্দরবনে তৃণাঞ্চলের ঘাটতি ও অবাধ শিকারই গন্ডার বিলুপ্তির কারণ।

ইতিহাস ও সদ্য আবিষ্কৃত প্রত্নস্থল ঘেঁটে তার সত্যতাও পেয়েছিলাম। একসময় সুন্দরবনে চামড়া, শিং ও মাংসের জন্য ব্যাপক আকারে গন্ডার শিকার করা হতো। প্রাচীনকালে সুন্দরবন অঞ্চলের আদিবাসীরা গন্ডারের মাংস খেত। সুন্দরবনের প্রাচীন প্রত্নস্থলে তারই নমুনাস্বরূপ একটি গন্ডারের দাঁতের জীবাশ্ম-প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি অবশ্য অন্যান্য প্রাণীর হাড়ের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। অন্য আরেক প্রত্নস্থলে পাওয়া যায় পায়ের হাড়, যা দেখে অনুমান করা যায় হাড়ের ভেতরের মজ্জা বের করার জন্য ভাঙা হয়েছিল হাড়টি।

আরও পড়ুন- ঘড়িয়াল বিলুপ্তির গবেষণা সঠিক নয়

জীবিত গন্ডারের ছবিটি আসাম থেকে তোলা

সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সেকেন্দার ডাক্তার তাঁর জীবদ্দশায় একটি পুকুর খননের সময় মাটির গভীরে দুটি গন্ডারের কঙ্কাল পান। এছাড়া সুন্দরবনসংলগ্ন হরিণগড় গ্রামে এফাজতুল্লা সরদার পুকুর খননের সময় একটি গন্ডারের কঙ্কাল, ধূমঘাট দিঘি খননের সময় ছয়টি গন্ডারের কঙ্কাল ও ঈশ্বরীপুর মাখন লাল অধিকারীর বাড়িতে ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক এ এফ এম আবদুল জলিল ছয়টি গন্ডারের কঙ্কাল দেখেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রায় একশত বৎসর পূর্বে বৃদ্ধ লোকেরা শ্রীফলাকাঠি ও খেগড়াঘাটের জঙ্গলে স্বচক্ষে গন্ডার দেখিয়াছেন।’

সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসরত ঢালী পদবির লোকজন সুন্দরবনে গন্ডার শিকার করে তার চামড়া দিয়ে যুদ্ধের জন্য ঢাল প্রস্তুত করত। ঢাল থেকে পেশাগত কারণে ঢালী পদবির উৎপত্তি। এই ঢালীরা মহারাজ প্রতাপাদিত্যর হয়ে যুদ্ধ করত। পরবর্তী যুগে এসে ইংরেজ শিকারিদের ব্যাপক শিকারের ফলে অবশিষ্ট গন্ডার সুন্দরবন থেকে বিলীন হয়ে যায়।

এসইউ/এমকেএইচ