মতামত

ক্রিকেট মানেই দেশপ্রেম জার্সি মানেই লাল-সবুজ

ঠিক এক মাস পর ইংল্যান্ড-ওয়েলসে বসছে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ। দেড় মাসের এই আয়োজন নিয়ে এখন সাজ সাজ রব। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ এখনই তৈরি হচ্ছে বিশ্বকাপ উত্তেজনায় শামিল হতে।

Advertisement

গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে আমাদের প্রত্যাশার সীমানাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে প্রত্যাশার সীমা সেমিফাইনাল ছুঁয়েছে। তবে অধিনায়ক মাশরাফির প্রত্যাশার সীমা আকাশ। তিনি বলেছেন, বিশ্বকাপ জয় কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমিও বিশ্বাস করি, বিশ্বকাপ জয় অসম্ভব নয়।

তবুও আমি প্রত্যাশা দিয়ে দলের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। আমি খোলা মন নিয়ে খেলা দেখবো। আমি খালি দেখতে চাইবো বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা মন-প্রাণ উজাড় করে খেলছে। জয় পরাজয় যাই আসুক, তাতেই আমি সন্তুষ্ট থাকবো।

তবে এবার খেলা শুরুর আগেই নানা বিতর্কে বিশ্বকাপ অভিযান। নীতিনির্ধারকদের খুব দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে। প্রথম বিতর্ক দল নিয়ে। তবে দল নিয়ে বিতর্ক খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ১৬ কোটি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ আছেন এবং সবার একটি করে দল আছে। তাই বিতর্কমুক্ত দল গড়া কখনোই সম্ভব নয়। তবে দ্বিধাটা হলো বিশ্বকাপের জন্য ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করা হলেও আয়ারল্যান্ড সফরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ১৭ সদস্যের দল। বিশ্বকাপের স্কোয়াডের বাইরে থাকা নাইম হাসান আর ইয়াসির রাব্বী আছেন আয়ারল্যান্ড দলে।

Advertisement

তখনই নির্বাচকরা বলে দিলেন, বিশ্বকাপ স্কোয়াডের বাইরে থাকা দুজনের কেউ খুব ভালো করলে তারা বিশ্বকাপে সুযোগ পেতেও পারেন। তার মানে যে ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়েছে, তা চূড়ান্ত নয়। নতুন কেউ ঢুকতে পারেন, কেউ বাদও পড়তে পারেন।

বিশ্বকাপ স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের এমন অনিশ্চয়তায় রাখা তাদের মনোবলের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণার পরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। বিতর্ক ছিল ইমরুল কায়েস ও ফরহাদ রেজার বাদ পড়া নিয়েও। কিন্তু সেই বিতর্কে যে নির্বাচক কমিটিও ভেঙে পড়বে, তা বুঝিনি। আয়ারল্যান্ড যাওয়ার দুদিন আগে তাসকিন আর ফরহাদ রেজাকে দলে নেয়া হয়েছে।

তার মানে ১৯ জনের দল নিয়ে আয়ারল্যান্ড যাচ্ছে বাংলাদেশ দল। এটিই আসলে বৃহৎ বিশ্বকাপ দল। আয়ারল্যান্ড সফরের পারফরম্যান্স দিয়েই চূড়ান্ত হবে বিশ্বকাপ স্কোয়াড। তার মানে ১৫ সদস্যের বিশ্বকাপ দলের ওপর চাপ আরো বাড়লো। অথচ বিশ্বকাপের আগে তাদের নির্ভার রাখার দায়িত্ব ছিল বিসিবির।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান। আবার বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ক্রিকেটারের নামও সাকিব আল হাসান। তিনি বিশ্বের এক নাম্বার অলরাউন্ডার। সাকিব সত্যিই বিশ্বমানের খেলোয়াড়, খেলেনও বিশ্বজুড়ে। কিন্তু তাই বলে তিনি তো বাংলাদেশের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু বিভিন্ন সময় তার আচরণে মনে হয়, বাংলাদেশ তার কাছে প্রায়োরিটি নয়।

Advertisement

একবার জাতীয় দলে না খেলার হুমকি দিয়েছিলেন। বিশ্রামের কথা বলে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না গিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। স্টেডিয়ামে সমর্থককে পিটিয়েছেন। ক্যামেরায় অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছেন। তার কেলেঙ্কারির তালিকা বড় লম্বা। ব্যক্তিগত বেয়াদবির অনেক উদাহরণ ক্রিকেটপাড়ায়। এত বড় পারফরমার হলেও তাকে বিসিবি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এত ঘটনা থেকেও কোনো শিক্ষাই নেননি এই অলরাউন্ডার।

আইপিএল খেলার জন্য বিশ্বকাপ ক্যাম্পে যোগ দেননি। বিসিবিও সাকিবকে অনেক ছাড় দেয়। তারপরও তিনি প্রায়শই সীমা লঙ্ঘন করেন। সোমবার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডের সদস্যরা। অধিনায়ক মাশরাফির সংবাদ সম্মেলন, বিশ্বকাপের জার্সি উন্মোচন, অফিশিয়াল ফটোসেশন, বিসিবির সভাপতি ও পরিচালকদের সাথে মধ্যাহ্নভোজ এবং পৃষ্ঠপোষকদের বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং।

এত কিছু হলেও বিশ্বকাপের সহ-অধিনায়ক সাকিব আল হাসান কোনোটাতেই নেই। অথচ তিনি আগের দিন বিকেলে বাংলাদেশে এসেছেন। সকালে একবার মিরপুর এসেছিলেনও। কিন্তু চলেও গেছেন নিজের মতো। বিসিবি সভাপতি সাকিব আল হাসানের এই আচরণকে দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেছেন। তবে শুধু ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেই সাকিবের এ আচরণকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। সহ-অধিনায়ক দূরে দূরে থাকলে দলের মনোবল চাঙা হবে কীভাবে?

তবে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে গেছে, জার্সি বিতর্ক। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে জার্সি উন্মোচন করা হলেও দুদিন আগেই তা ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। সাথে সাথেই তুমুল বিতর্ক। জার্সি আসলে কারোই পছন্দ হয়নি। ফেসবুকে আমি কাউকে এর পক্ষে বলতে শুনিনি। এতদিন বাংলাদেশের জার্সি মানেই ছিল লাল-সবুজ। এবার দুটি জার্সি করা হয়েছে- একটি সবুজ, একটি লাল। যে সবুজ জার্সি পরে অফিশিয়াল ফটোসেশন হয়েছে, সেটা সবুজ। তাতে লালের কোনো ছোঁয়া নেই।

আর সবুজও জাতীয় পতাকার মত গাঢ় সবুজ নয়। বাংলাদেশের জার্সির এই হালকা সবুজের সাথে অনেকেই পাকিস্তানের জার্সির মিল খুঁজে পেয়েছেন। এই মিল সেই সমালোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে। এবারের জার্সি বাংলাদেশের মানুষের অভ্যস্ততায় বড় থাক্কা দিয়েছে। আমারও ভালো লাগেনি। আমি জানি, আমার বা ফেসবুকারদের ভালো লাগা না লাগা দিয়ে জার্সির রঙ ঠিক হবে না। এটা নিয়ে গণভোটও হবে না। কিন্তু চূড়ান্ত করার আগে বোর্ড ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটা গোপন জরিপ করতে পারতেন।

মুহূর্তের মধ্যেই ফেসবুক যে জার্সিটি এক বাক্যে প্রত্যাখ্যান করলো, এমন একটি জার্সি অনুমোদন করলো কারা? জন আবেগের সাথে দেখছি বোর্ড কর্তাদের আবেগের যোজন যোজন ফারাক। বিশ্বকাপের জার্সি ইচ্ছামতো করার সুযোগ নেই। আইসিসির অনুমোদন নিতে হয়। সেটা নেয়া হয়েছেও। কিন্তু বিসিবি সভাপতি বলছেন, উন্মোচনের আগে তিনি জার্সিটি দেখার সময় পাননি। কী ভয়ঙ্কর কথা। বিসিবি সভাপতি দেখার আগেই আইসিসিতে চলে গেল জার্সি!

নাজমুল হাসান পাপন বলছেন, তিনি না দেখলেও ক্রিকেটাররা আগে দেখেছে জার্সি। কিন্তু ক্রিকেটারদের নিশ্চয়ই জার্সি পছন্দ করার সুযোগ নেই। ফেসবুকে সমালোচনার ঝড়ে অবশ্য একদিনেই কুপোকাত বিসিবি। এখন নাজমুল হাসান পাপন বলছেন, জার্সি বদলানো হবে। তবে সেটা করতেও আইসিসির অনুমোদন লাগবে।

বাংলাদেশে ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট আসলে নিছক খেলা নয়, আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। অন্যসব বিষয়ে বিরোধ থাকলেও ক্রিকেট আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। আমরা যে জানপ্রাণ দিয়ে খেলা দেখি; হারলে দুঃখে কাঁদি, জিতলে সুখে কাঁদি; সেটা কিন্তু নিছক ক্রিকেটের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্য।

জাতীয় দলের খেলার সময় আমরা যতটা আবেগী, স্টেডিয়ামে উপচেপড়া ভিড়, ঘরোয়া ক্রিকেটে কিন্তু ততটা নয়। ক্রিকেট উন্মাদনা আসলে দেশপ্রেমের প্রকাশ। ক্রিকেট যেহেতু বিশ্বে আমাদের মর্যাদা তুলে ধরেছে উচ্চে, তাই আমরা ক্রিকেটেই খুঁজি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান একাত্তরের মার্চে খেলতে নেমেছিলেন ব্যাটে জয়বাংলা লিখে। ক্রিকেট থেকে তাই রাজনীতি, দেশ, আবেগ আলাদা করার সুযোগ নেই। এই আবেগটুকু না থাকলে, ক্রিকেট একটি যে কোনো খেলা হয়ে উঠবে। তাই ক্রিকেটে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মানুষের আবেগের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। এই আবেগই ক্রিকেটের শক্তি, আমাদের দেশপ্রেম।

এইচআর/পিআর