জাতীয়

একাত্তরে লড়েছেন, এবার প্রাণের টানে ছুটে এলেন বাংলাদেশে

‘৪৭-এ দেশভাগের সময় অনেকেই দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে। তাদের অনেকেই আবার যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। কিন্তু জন্মভূমির প্রতি একটা টান থেকেই যায়। যে দেশে জন্মেছেন সে দেশকে স্বাধীন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পেয়ে বসেছিল এমনই এক তরুণ সৈন্যের। তিনি যখন শুনলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে কাজ করবেন তখন আর এক মুহূর্তও চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে। বলছিলাম একাত্তরের ভারতীয় বীর সেনানী সুকৃতি কর্মকারের কথা। সুকৃতি কর্মকারের জীবনের গল্প লিখেছেন রিফাত কান্তি সেন -

Advertisement

একাত্তরে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি দামাল ছেলেরা শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই মহান মুক্তিসংগ্রামে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। মিত্রবাহিনী হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন ভারতীয় অনেক সৈন্য। নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সেদিন তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্য ছিলেন সুকৃতি কর্মকার। যুদ্ধের শেষ দিকে ৬ ডিসেম্বর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন রনাঙ্গণে যুদ্ধ করেছেন। একের পর এক শত্রুকে পরাস্ত করে সামনে এগিয়ে গেছেন মিত্রবাহিনীর সদস্যরা।

মিত্রবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য সৃকুতি কর্মকার। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময়টা আমার কাছে বেশ স্মরণীয়। আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করলেও মনটা কিন্তু মাতৃভূমির প্রতিই ছিল। দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে সে চিন্তা থেকেই যখন শুনলাম যুদ্ধে যেতে হবে তখন আর একটি মুহূর্তও দেরি করিনি।’

তিনি মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছত্রীসেনা (প্যারাট্রুপার) ছিলেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা করে রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পৌঁছান ১৬ ডিসেস্বর ভোরে। ওই দিন পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখানে আত্মসমর্পণ করে। একথা স্মরণ করতে গিয়ে সৃকুতি কর্মকার বলেন, ‘এ দৃশ্য সত্যি আনন্দের। শত্রুরা আত্মসমর্পণ করছে। একে একে আর আমরা বাঙালি মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে পেরে বেশ আনন্দে ছিলাম। এ যেন- দুঃখের পরেই সুখের পরশ।’

Advertisement

কে এই সুকৃতি কর্মকার?

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করলেও সৃকুতি কর্মকার ছিলেন মেঘনাপাড়ের সন্তান। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল চাঁদপুর জেলায়। তার বাবার নাম মনোরঞ্জন কর্মকার এবং মা হরপ্রিয়া কর্মকার। ’৪৭-এ দেশভাগের সময় তারা সপরিবারে চলে যান ভারতের আসানসোলে। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে সুকৃতি কর্মকার সবার ছোট।

এই পরিণত বয়সে প্রাণের টানে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। তিন সন্তানের বাবা সুকৃতি কর্মকার স্ত্রী কনিকা কর্মকারকে নিয়ে ঘুরে দেখেন প্রিয় জন্মস্থান চাঁদপুর শহর। রোববার (২১ এপ্রিল) বিকেলে চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন এলাকার তিন নদীর মোহনা ঘুরে দেখেন তিনি। এ সময় কথা প্রসঙ্গে ফিরে যান ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে। বাংলাদেশের এত উন্নতি দেখেও বেশ অভিভূত তিনি।

অন্যদিকে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন একজন বিদেশি সেনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি শুনে ভালো লাগার কথা জানালেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিজানুর রহমানও।

Advertisement

সুকৃতি কর্মকারের প্রত্যাশা :

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখলেও তার কন্যা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখা হয়নি সুকৃতি কর্মকারের। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশটাকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সে দৃশ্যপট নিজ চোখে দেখে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে যখন বাংলাদেশে আসি তখনকার দৃশ্য আর এখনকার দৃশ্য যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কী ছিল বাংলাদেশ, আর এখন কী হয়েছে। এতটাই উন্নতি করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা যে, সেকথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। খুব ইচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যার সঙ্গে দেখা করার। এ দেশটাকে স্বাধীন করেছি তারই পিতার ডাকে। যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরি কে কাছ থেকে দেখতে কার না ইচ্ছা জাগে বলুন। যদি সুযোগ থাকতো তবে দেখা করতাম ওনার সঙ্গে।’

বড় কোনো পুরস্কার পাননি তিনি :

সুকৃতি কর্মকার চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধারা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা সেসব সুবিধা পান না। তবে এতে তার কোনো আক্ষেপও নেই। যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ওয়্যার মেডেল পেয়েছিলেন এই যোদ্ধা। এছাড়া আর কোনো সম্মাননা পাননি তিনি।

এমবিআর/এমকেএইচ