‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ঠ’- পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের এমন স্লোগানের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই বললেই চলে। দম্পতিদের প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব ও প্রান্তিক পর্যায়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কুসংস্কারের কারণে দেশের জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আবার দম্পতিদের কেউ ছেলে সন্তান ও কেউ মেয়ে সন্তানের আশায় একাধিক সন্তান নিয়ে পরিবার বড় করছেন। আর এর প্রভাব পড়ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে।
Advertisement
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার নাটাই (উত্তর) ইউনিয়নের ছায়া সুনিবিড় গ্রাম ‘ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া’। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামটিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই! পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে মাঠ কর্মীরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পরিবার ছোট রাখতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেয়ার কথা বললেও কোনো কাজ হচ্ছে না। গ্রামের প্রতিটি ঘরেই তিন থেকে পাঁচজন করে শিশু রয়েছে।
নারীদের কেউ কেউ পরিবার ছোট রাখার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়ান পুরুষরা। নানা কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেন না তারা। এর ফলে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় গ্রামের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছরই কোনো না কোনো ঘরে যোগ হচ্ছে নতুন শিশুর মুখ।
ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রামের গৃহবধূ সুফিয়া বেগম। ২৭ বছর বয়সী এই নারী ১৭ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। প্রথম বছরেই ঝুঁকি নিয়ে মেয়ে সন্তান প্রসব করেন তিনি। তবে স্বামী সেলিম মিয়া চান ছেলে সন্তান। দুই বছরের মধ্যে আবারও মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন সুফিয়া। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সুফিয়া আর সন্তান নিতে চাননি। কিন্তু স্বামীর ইচ্ছায় ছেলে সন্তানের জন্য আবার গর্ভধারণ করেন সুফিয়া। এবার একবছর পর ছেলে সন্তান জন্ম নেয় সেলিম-সুফিয়ার ঘরে।
Advertisement
সুফিয়া বেগম জানান, প্রথম দুই মেয়ে ও পরে এক ছেলে জন্ম নেয়ার পর আবারও আরেকটি ছেলে সন্তানের জন্য চাপ দিতে থাকেন স্বামী। বছর তিনেক বিরতি দিয়ে আবারও মেয়ে সন্তান প্রসব করেন তিনি। তাই এতে খুশি হতে পারেননি সেলিম। আবারও সন্তান নিতে বলেন সুফিয়াকে। কিন্তু তিনি সাড়া না দিয়ে স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে চান। এতে বাধা দেন সেলিম। পরবর্তীতে সেলিম কিছুদিনের জন্য বাড়ির বাইরে গেলে সুফিয়া ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতি গ্রহণ করেন। বিষয়টি পরে জানতে পেরে সুফিয়ার উপর রাগ করেন সেলিম।
একই গ্রামের আরেক গৃহবধূ আসমা বেগম তিন ছেলে ও এক মেয়ের মা। প্রথম ছেলে সন্তান হওয়ার পর স্বামী আক্তার হোসেন একটি মেয়ে সন্তান চাইছিলেন। সেজন্য আবার গর্ভধারণ করেন তিনি। এবার পরপর দুইবার ছেলে সন্তান প্রসব করেন তিনি। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। এবার মেয়ে সন্তানই জন্ম দেন তিনি। তাই স্বামীও খুব খুশি। তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে ভয় আছে জানিয়ে আসমাকে তা করতে দেননি। এখন তিনি অস্থায়ী জন্ম নিরোধক হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের দেয়া বড়ি সেবন করেন।
ওই গ্রামেরই পাঁচ সন্তানের জননী মমতাজ বেগমের বয়স এখন ৩৫ বছর। প্রথমবার ছেলে সন্তান জন্ম দেয়ার পর অটোরিকশা চালক স্বামী নাসির মিয়া মেয়ের জন্য আবার সন্তান নিতে বলেন। কিন্তু পরপর চারটি ছেলে সন্তান জন্ম দেন তিনি। এরপর আবার মেয়ের জন্য স্বামীর ইচ্ছায় গর্ভধারণ করেন। এবার তিনি মেয়ে সন্তান প্রসব করেন। খুশি হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুইজনই আর সন্তান নেবেন না বলে ঠিক করেন। তবে ভয়ের কারণ দেখিয়ে মমতাজকে স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে দেননি নাসির।
মমতাজ জানান, জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে তিনি লাইগেশন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অপারেশনের ভয়ে নাসির সেটি করতে দেননি। এরপর ইনজেকশন নিতে চাইলে সেটিতেও ভয় আছে জানিয়ে নিতে দেননি। তাই এখন অস্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে প্রতিদিন রাতে বড়ি সেবন করেন মমতাজ। তবে নাসির নিজের জন্য কোনো পদ্ধতিই গ্রহণ করছেন না।
Advertisement
সুফিয়া, আসমা ও মমতাজের মতো ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রামের আরও অনেক নারী তাদের পরিবার ছোট রাখার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাইলেও পুরুষদের কারণে সেটি পারছেন না। ছেলে-মেয়ের আশায় এভাবে পরিবার বড় করার বিষয়ে পুরুষরাও খোলাখুলি করে কিছু বলতে চান না।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, নারী-পুরুষের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে অস্থায়ী ও স্থায়ী বেশ কয়েকটি পদ্ধতি চলমান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে খাবার বড়ি, ইনজেকশন, কনডম, ভ্যাসকেটমি, এনএসভি, ইমপ্ল্যান্ট ও লাইগেশন অন্যতম। সবগুলো পদ্ধতিই পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাধ্যমে বিনামূল্যে গ্রহণ করা যায়। এগুলোর মধ্যে কেউ কেউ খাবার বড়ি ও কনডম নিলেও বাকি পদ্ধতিগুলো কেউই নিতে চান না। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কুসংস্কারই এর মূল কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও পল্লী চিকিৎসক সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গ্রামে জনশ্রুতি রয়েছে ১০/১২ বছর আগে হানিফ মিয়া নামে এক ব্যক্তি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে ভ্যাসেকটমি গ্রহণ করেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি মারা যান। এরপর থেকে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের কারণেই হানিফ মারা গেছেন। এজন্য কেউ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান না। তবে এই ধারণা ভাঙতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরকেই কিছু একটা করতে হবে। নিয়মিত সভা-সেমিনার করে দম্পতিদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন ও গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের পক্ষে মত দেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আকিব উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে দম্পতিদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কুসংস্কার রোধ করে পুরুষদেরকে আরও সচেতন করার জন্য ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বড় আকারে একটি সচেতনতামূলক সেমিনার করা হবে বলে জানান তিনি।
আজিজুল সঞ্চয়/এফএ/জেআইএম