আন্তর্জাতিক

ডারউইনের আগে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দিয়েছেন যে মুসলিম দার্শনিক

আধুনিক বিজ্ঞানের যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার তার অন্যতম ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। তার এই তত্ত্বে দেখানো হয়েছে প্রাণিরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বটি আমাদের পৃথিবীর পশুপাখি ও উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে বুঝতে বড়ো ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এই প্রক্রিয়াকে ইংরেজিতে বলা হয় ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন যার মাধ্যমে একটি প্রাণীর জনগোষ্ঠী থেকে নতুন প্রজাতির উদয় ঘটে। এই থিওরি বিজ্ঞানের জগতে বৈপ্লবিক তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত।

Advertisement

‘অন দ্য অরিজিন অব স্পেশিস’ নামে চার্লস ডারউইনের এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। তার এই গ্রন্থে তিনি বিবর্তনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো প্রাণি ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্যে বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন একটি প্রাণিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু চার্লস ডারউইনের আগে ইসলামিক বিশ্বেও বিবর্তনবাদ তত্ত্বের আরও একজন প্রবক্তা ছিলেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, চার্লস ডারউইনের প্রায় এক হাজার বছর আগে ইরাকে একজন মুসলিম দার্শনিক ছিলেন যিনি প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণিকূলের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার ওপর একটি বই লিখেছিলেন। এই দার্শনিকের নাম ছিল আল-জাহিজ। যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’।

তার আসল নাম ছিল আবু উসমান আমর বাহার আলকানানি আল-বাসরি, তবে ইতিহাসে তিনি ‘আল জাহিজ’ নামেই বেশি পরিচিত। তার এই নামের অর্থ এমন একজন ব্যক্তি যার চোখের মণি বেরিয়ে আসছে। আল-জাহিজ নামটি বিখ্যাত হয়ে আছে তারই লেখা প্রজনন-সংক্রান্ত একটি বইয়ের কারণে। গ্রন্থটির নাম কিতাব আল-হায়ওয়ান অর্থাৎ প্রাণিদের বিষয়ে বই।

Advertisement

তার জন্ম হয়েছিল ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে, দক্ষিণ ইরাকের বাসরা শহরে, মুতাজিলাহ আন্দোলনের সময়। এ সময় ধর্মতাত্ত্বিক কিছু মতবাদ জনপ্রিয় হচ্ছিল যেখানে মানুষের যুক্তির চর্চার ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল। তখন ছিল আব্বাসীয় খেলাফত বা শাসনের চরম সময়। সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক বই গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হতো। জোরালো বিতর্ক হতো ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে। এসবের কেন্দ্র ছিল বাসরা শহর। এসব আলোচনা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল আল-জাহিজের চিন্তাধারা।

চীনা বণিকেরা ততদিনে ইরাকে কাগজের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন তত্ত্ব লিখিত আকারে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তরুণ আল-জাহিজ তখন নানা বিষয়ে লেখালেখি করতে শুরু করেন। যেসব বিষয়ে তার খুব বেশি আগ্রহী ছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, আরবি ব্যাকরণ এবং সাহিত্য। ধারণা করা হয়, তার জীবদ্দশাতেই তিনি দুশোর মতো বই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ এই আধুনিক কাল পর্যন্তও টিকে রয়েছে।

তার রচিত বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘দ্য বুক অব অ্যানিমেলস’ বা প্রাণিবিষয়ক বইটি। এটি একটি এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো যাতে সাড়ে তিনশো প্রাণির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটিতে তিনি এমন কিছু ধারণা তুলে ধরেছেন যার সঙ্গে আধুনিককালের বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদে তত্ত্বের চমকপ্রদ অনেক মিল পাওয়া যায়।

আল-জাহিজ তার বইতে লিখেছেন, ‘টিকে থাকার জন্যে প্রাণিদেরকে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের খাদ্যের জন্যেও এবং তারা নিজেরাই যাতে অপরের খাদ্য না হয়ে যায়-সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এমনকি প্রজননের জন্যেও তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়। নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণিরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।’

Advertisement

তিনি আরও লিখেছেন, ‘যেসব প্রাণি প্রজনন ঘটাতে টিকে থাকতে পারে তারা তাদের সফল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে।’

আল-জাহিজের কাছে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল যে এসব প্রাণিকূলকে টিকে থাকার জন্যে অনবরত সংগ্রাম করতে হয় এবং একটি প্রজাতি সবসময়ই আরেকটি প্রজাতির চেয়ে শক্তিশালী। টিকে থাকার জন্য খাবার সংগ্রহের লড়াই-এ প্রাণিদের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। অন্যের খাবার হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং সন্তান জন্মদান করতেও তাদের সংগ্রাম করতে হয়। এসব কারণে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে রূপান্তর ঘটাতে বাধ্য হয়।

আল-জাহিজের এসব ধারণা তার পরবর্তী অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবি, আল-আরাবি, আল বিরুনী এবং ইবনে খালদুন। পাকিস্তানের ‘আধ্যাত্মিক পিতা’ মোহাম্মদ ইকবাল, যিনি আল্লামা ইকবাল নামেই অনেক বেশি পরিচিত তিনিও আল-জাহিজের এসব তত্ত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত তার বক্তব্যের একটি সঙ্কলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আল-জাহিজ দেখিয়ে দিয়েছেন অভিবাসন এবং পরিবেশে পরিবর্তনের কারণে প্রাণিদের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে।’

বিবর্তনবাদের ধারণায় মুসলিম বিশ্বের অবদান বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে গোপনীয় কোনো বিষয় নয়। এমনকি চার্লস ডারউইনের একজন সমসাময়িক বিজ্ঞানী উইলিয়াম ড্রেপার ১৮৭৮ সালে ‘বিবর্তনবাদের মোহাম্মদীয় তত্ত্ব’ নিয়ে কথা বলেছিলেন। তবে যাই হোক, চার্লস ডারউইন মুসলিম বিজ্ঞানী আল-জাহিজের চিন্তাধারা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা কিংবা তিনি আরবি বুঝতেন কিনা তার পক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।

বিবিসি রেডিওর জন্য ‘ইসলাম ও বিজ্ঞান’ নামের একটি ধারাবাহিক তথ্যচিত্রের নির্মাতা বিজ্ঞানবিষয়ক সাংবাদিক এহসান মাসুদ বলেছেন, ‘বিবর্তনবাদের ধারণা তৈরিতে আরও যারা অবদান রেখেছেন তাদেরকে স্মরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘দশম শতাব্দীর ইরাকে, যখন বাসরা ও বাগদাদ ইসলামিক সভ্যতা ও শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তখনও ক্রিয়েশনিজমের ধারণা খুব একটা জোরালো ছিল না।’

ক্রিয়েশনিজম হচ্ছে এমন এক ধর্মীয় বিশ্বাস যাতে মনে করা হয় ‘ঐশ্বরিক কোনো ঘটনা থেকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও প্রাণের সৃষ্টি’ হয়েছিল যা প্রকৃতির বিবর্তনবাদের ধারণার বিরোধী।

এহসান মাসুদ ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বিজ্ঞানীরা তখন নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করার লক্ষ্যে বাইরে বের হয়ে পড়তেন।’ এই জ্ঞানের অন্বেষণ করতে গিয়েই মুসলিম দার্শনিক আল-জাহিজের মৃত্যু হয়েছিল।

বলা হয়ে থাকে ৯২ বছর বয়সী আল-জাহিজ যখন একটি আলমারি থেকে বই নামাতে গিয়েছিলেন তখন আলমারিটি তার গায়ের ওপরে পড়ে গেলে তিনি মারা যান।

এসআর/এমকেএইচ