অর্থনীতি

ভোটের পর শেয়ার ক্রয়ে বিদেশিরা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে সরকার গঠন করেছে ক্ষমসীন দল আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারের ওপর সব শ্রেণি-পেশার বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।

Advertisement

বাজারে অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ানো বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিক্রির বদলে শেয়ার ক্রয়ে মনোযোগী হয়েছেন। সদ্য সমাপ্ত জানুয়ারি মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের চিত্র তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

জানুয়ারিতে (২০১৯ সাল) বিদেশিরা যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করেছে বাজার থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্রয় করেছে। অথচ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় টানা তিনমাস বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় করার চেয়ে বিক্রির রেকর্ড বেশি ছিল। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমগ্র শেয়ারবাজারে, দেখা দেয় টানা দরপতনও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত ছাড়াই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় ছিল সেই দলই আবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে সবাই ধরে নিচ্ছেন সব ধরনের বিনিয়োগে কিছুটা হলেও গতি আসবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যে কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার ক্রয়ে মনোযোগী হয়েছেন।

Advertisement

তারা বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছিল তাতে সবারই ধারণা ছিল বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘত দেখা দিতে পারে। নির্বাচনের ১৫ দিন আগেও কেউ ধারণা করতে পারেননি এতটা শান্তিপূর্ণভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় নির্বাচনের আগে শেয়ার বিক্রি করে সেভ জোনে (নিরাপদ স্থান) চলে যাওয়ার চেষ্টা চালায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তবে ভোটের পর অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ায় তারা আবারও শেয়ার ক্রয়ে ফিরেছেন।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের পর বা ২০১৯ সালের প্রথম মাস জানুয়ারি জুড়ে বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে ৪৯৫ কোটি ১৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকার শেয়ার ক্রয় করেছেন। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৩১৯ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার টাকার শেয়ার। অর্থাৎ মাসটিতে বিদেশিরা বিক্রির থেকে ১৭৫ কোটি ২৯ লাখ ২৮ হাজার টাকার শেয়ার বেশি ক্রয় করেছেন।

অথচ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সাল জুড়েই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা যায়। বছরের বেশিরভাগ সময় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রাখে। বছরটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় এপ্রিল মাস থেকে।

এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচমাস বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেছেন। এর মধ্যে এপ্রিলে শেয়ার ক্রয় থেকে ২৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বেশি বিক্রি করেন। পরের মাস মে-তে ২৮২ কোটি ৩৪ লাখ, জুনে ২০৬ কোটি ৭১ লাখ, জুলাইতে ৩২ কোটি ৭১ লাখ এবং আগস্টে ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল বিদেশিদের।

Advertisement

টানা পাঁচ মাস শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ানোর পর সেপ্টেম্বরে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ান। মাসটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার শেয়ার বেশি ক্রয় করেন। তবে নির্বাচনের ডামাডোলের ভেতর অক্টোবরে আবার সেই দৃশ্য পাল্টে যায়। মাসটিতে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ২০১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির সেই চাপ ভোটের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ফলে নভেম্বরে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি দাঁড়ায় ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় করার চেয়ে ১০১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার শেয়ার বেশি বিক্রি করেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের আগে সবার মধ্যেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। ফলে সে সময় দেশি বিনিয়োগকারীরাও খুব একটা বিনিয়োগ করছিল না। ওই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে নেবেন এটাই স্বাভাবিক।

তিনি আরও বলেন, অনিশ্চয়তা থাকলেও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়বে। সকলেই ধারণা করছেন বিনিয়োগে গতি আসবে। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, নির্বাচনের আগে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ছিল। যে কারণে নির্বাচনের আগে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির একটা চাপ ছিল। তবে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। এতে বিদেশিরাও শেয়ার ক্রয় বাড়িয়েছেন। বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ার কারণেই ভোটের পর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আমার ধারণা, বিদেশিদের বিনিয়োগ সামনে আরও বাড়বে। কারণ, অনেক ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম এখনো বেশ কম।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক এই সভাপতি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে সবাই ধরে নেয় পলিসিগুলো ঠিক থাকবে। এতে আশা করা যায় সব ধরনের বিনিয়োগে গতি বাড়বে। আর বিনিয়োগ গতি আসলে স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারবাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এমএএস/আরএস/এমএস