ফিচার

গ্রামের মাঠ থেকে উঠে আসে ক্রিকেটার

ক্রিকেট শব্দের অর্থ ঝিঁঝি পোকা। কিন্তু ক্রিকেট অর্থে এখন কেউ এমনটা বোঝেন না। শুধু ‘চার-ছক্কা হইহই, বল গড়াইয়া গেল কই?’- এমন উত্তেজনাকর, উত্তপ্ত অবস্থাকে এখন মানুষ ক্রিকেট হিসেবে চেনেন। এ ক্রিকেট মানে একটি খেলা। যার শুরুটা ইংল্যান্ডে হলেও বাংলাদেশের শহুরে পরিবেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছুঁয়েছে গ্রামের দিগন্তকে।

Advertisement

আগে দেখা যেত, জাতীয় দলে যেসব ক্রিকেট তারকার জায়গা হতো; তাদের শতভাগ শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা। কিন্তু এখনকার সময়টা একদম বদলেছে। একেবারে অজপাড়াগা, প্রান্তিক গ্রাম থেকে কেউ যদি ভালো খেলে তার লাগাম ধরে রাখা যায় না। গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, সেখান থেকে উপজেলা, এরপর জেলা, তারপর বিভাগীয় পর্যায়, সবশেষে মূলধারার ক্রিকেটাঙ্গনে খেলার সুযোগ মেলে অনেকের।

পর্যায়ক্রমে জাতীয় পর্যায়ের সবগুলো ধাপ পেরিয়ে জাতীয় ক্রিকেট টিমে জায়গা হয় অনেকের। এমন একজনের উদাহরণ টানলে চোখে ভেসে আসে দেশ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনের জনপ্রিয় তারকা মোস্তাফিজুর রহমানের নাম। যার বাড়ি পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা অঞ্চলের একদম প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। জাতীয় পর্যায়ে চান্স পাওয়ার আলোচনায় আসে তাঁর বাড়িতে বিদ্যুতের আলো নেই। মোস্তাফিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরলে গরমে তাঁর শরীর ঘামে ভিজে যেত। পরে অবশ্য সরকার তাঁর সুবাদে ওই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়।

Advertisement

> আরও পড়ুন- অন্ধ জাহিদুলের প্রতিবন্ধকতা জয়! 

আজকের এ মোস্তাফিজ গ্রামের মাঠে ক্রিকেট খেলে উঠে আসা তারকা। ধান কাটার পর গ্রামের একদল কিশোর-তরুণ বেশ তাড়াহুড়া করেই কোদাল দিয়ে ধান ক্ষেতকে স্টেডিয়ামের মত বানিয়ে ফেলে। ঠিক বাইশ ব্যাট দূরত্ব নিয়ে পিচ আর বল, ব্যাট, স্ট্যাম্প নিয়ে শুরু হয় খেলার আয়োজন। বোলার বল করেন বেশ গতি নিয়ে। আর ব্যাটসম্যান দারুণভাবেই বোলারের বলকে মোকাবেলা করেন। বাউন্ডারি হিসেবে ধরা হয় আইলকে। সে আইলে বসেন দর্শকরা।

দর্শক সারি থেকে মনছোঁয়া হাততালি, খেলোয়াড়দের খেলাকে আরো শক্তিশালী করে। মাঠের চারপাশে কাণায় কাণায় দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এ যেন এক স্টেডিয়াম। এ স্টেডিয়াম অস্থায়ী। কৃষকের হাল পড়লেই স্টেডিয়ামের মেয়াদ শেষ। তবে সক্রিয় কিছু ক্রিকেটপ্রেমী তরুণদের উদ্যোগে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। যেখানে কয়েক মাস সময়ের জন্য কৃষি ক্ষেতকে বন্ধক রাখা হয়, কৃষককে কিছু টাকা দিয়ে।

গ্রামের এমন একটি স্মৃতি জাগানো ক্রিকেট টুর্নামেন্টের নাম এইচপিএল। যার পূর্ণরূপ হাজিগঞ্জ প্রিমিয়ার লীগ। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের পশ্চিম চর লরেন্স হাজিগঞ্জ মেঘনাপাড়ে এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টটির আয়োজন করে একদল কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ। ওই টুর্নামেন্টে প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যক দর্শক খেলা দেখতে আসেন। এমনকি দর্শক হিসেবে টিকিটের বিনিময়ে ছিল আসন ব্যবস্থা। কিন্তু দুর্ভাগ্য। নদীভাঙনের কারণে এমন আয়োজন স্থায়ী হয়নি।

Advertisement

> আরও পড়ুন- পত্রিকা বিক্রি করেই সংসার চলে বৃদ্ধ রাখালের 

আয়োজকদের একজন লক্ষ্মীপুর জজ কোর্টের শিক্ষানবীশ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফখরুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলছিলেন, ‘এইচপিএল শুরুর আগে আমরা বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে গ্রামের এসব মাঠেই টিম ধরে ক্রিকেট খেলতাম। ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে হলেও আমরা খেলতে যেতাম বা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা খেলতে আসতো। সে চিন্তা থেকেই এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করি। সেই টুর্নামেন্টে কেবল মাঠ কাঁপেনি, পুরো এলাকা কেঁপেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড় হতো। এমনকি নারী দর্শকরাও খেলা দেখতে আসতো। আমাদের এখানে যারা খেলেছে, তাদের কেউ কেউ বিকেএসপি বা রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে।’

খেলা সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রকাশ করলেন ঢাকা জজ কোর্টের শিক্ষানবীশ আইনজীবী ও গ্রীন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রানা হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘আমি গ্রামে ফিরে ছোটদের সাথে খেলতাম। গ্রামের মাঠে ক্রিকেট খেলাকে এখন বেশ মিস করি। ক্রিকেট নিয়ে আমার স্মরণীয় কিছু ঘটনা আছে। তখন বেশ ভালোই খেলতাম। ছিলাম অলরাউন্ডার। ১ থেকে শুরু করে ১১ নাম্বারে ব্যাট করার অভিজ্ঞতা আছে। গ্রামে যারা ক্রিকেট খেলেননি তাদের খেলাধুলার জীবন বৃথা। শিক্ষা, খেলাধুলা যে কোন বয়সে করা যায়।’

বিসিবির নিয়োগপ্রাপ্ত লক্ষ্মীপুর জেলা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট কোচ মনির হোসেন বলেন, ‘গ্রামের মাঠ থেকে খেলে আমাদের এখানে অনেকেই উঠে এসেছে। তাদের কেউ কেউ অনূর্ধ্ব-১৬ তে খেলে বিভাগীয় পর্যায়ে বেশ দারুণ খেলছে। তাদের ভবিষ্যত বেশ সম্ভাবনাময়। আমরা চেষ্টা করি, গ্রামে যারা ভালো খেলে তাদের তুলে আনার জন্য। সেক্ষেত্রে যদি গ্রামের স্কুলগুলোর মাঠে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার প্রতি মনযোগ দেয়া হয়, তাহলে আমরা তাদের তুলে আনতে পারি। কারণ এখানে একটা সংযোগ কাজ করে।’

এসইউ/এমকেএইচ