দেশজুড়ে

মাছ চাষে কোটিপতি রশিদ, প্রতিবছর সঞ্চয় ২০-২৫ লাখ টাকা

মাছ চাষে কোটিপতি রশিদ, প্রতিবছর সঞ্চয় ২০-২৫ লাখ টাকা

বিটিভির বিজ্ঞাপন দেখে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রায় দুই দশক আগে মাছের রেণু পোনা উৎপাদনে নামেন পাবনার বেড়া উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রশিদ। এতেই পেয়েছেন সফলতা। গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। একসময় ক্ষেত-খামারে কাজ ও ঝাকি (পাত্র) মাথায় মাছ বিক্রি করেও ঠিকমতো সংসার চলতো না। এখন সুখ ও সমৃদ্ধির জীবন তার।

Advertisement

আব্দুর রশিদ উপজেলার হাটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা মৃত আজাহার শেখ। পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে সংসার তার।

‘আগে রশিদের অবস্থা এরকম ছিল না। দিনরাত খেটেখুটে এতদূর এসেছেন। জমিজমা ও গোয়ালে গরুসহ এখন কি নেই তার! পরিশ্রম যে বৃথা যায় না, আব্দুর রশিদ তার প্রমাণ। তাকে দেখে অনেকেই মাছের পোনা চাষে নামছেন। অনেকেই তার কাছে পরামর্শ নিতে আসেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিয়ের এক বছরের মাথায় আব্দুর রশিদের ঘরে এক ছেলেসন্তান জন্ম হয়। পাঁচটি টিনের একটি ছাপরা ঘরে স্ত্রী নিয়ে কোনোমতে বাস করলেও সন্তানের দুধ কেনার উপায় ছিল না তার। সেসময় গ্রামে তেমন টিভি ছিল না। ২০০৭ সালে বিটিভিতে মাছ ও পোনা চাষ বিষয়ক একটি বিজ্ঞাপন দেখেন তিনি। এ থেকে উৎসাহ নিয়ে রেণু পোনা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন রশিদ।

Advertisement

১৫০০ টাকায় নিজ এলাকার জগন্নাথপুর গ্রামের ইসলাম হাজির ৮ শতাংশ পুকুর লিজ নেন। তবে ডিমপোনা কেনা ও চাষের খরচ নিয়ে বিপাকে পড়েন। এরপর তিন হাজার টাকায় তার বাবার দেওয়া গরুর বকনা বাছুরটি বিক্রি ও ধারদেনা করে পুকুরে ডিমপোনা ছাড়েন তিনি। এর একমাস পর থেকেই এ পোনা বিক্রি শুরু হয়। পাঁচমাসে কয়েক দফায় এ পোনা বিক্রিতে সেসময় প্রায় ২০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেন। এর বিপরীতে পাঁচ মাসে এ পোনা উৎপাদন বাবদ মোট ব্যয় হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা।

আরও পড়ুন কেঁচো সারে স্বাবলম্বী মাদারীপুরের রাশিদা ঝিনাইদহে বিদেশি ফল চাষে সম্ভাবনা, আগ্রহী কৃষকেরা ধান-গমের জমিতে চাষ হচ্ছে আম-লিচু-ড্রাগন

লাভের টাকায় ওই বছরেই আরও তিনটি পুকুর করেন রশিদ। এর ছয় মাস পর খরচ বাদে ৫৫ হাজার টাকা লাভ হয় তার। স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা প্রোগ্রামস ফর পিপলস ডেভেলপমেন্টের (পিপিডি) পরামর্শ ও সহযোগিতায় এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। এখন লাভের টাকায় দিন বদলেছে তার। টিনের ছাপরা ঘর ভেঙে তুলেছেন টিনশেডের পাঁকা বাড়ি। বাড়িয়েছেন জমিজিরাত। ছয় বিঘার তিনটি পুকুর ও ১৫ বিঘা জমি কিনেছেন। সবমিলিয়ে কমপক্ষে তিন কোটি টাকার টাকার সম্পদ গড়েছেন আব্দুর রশিদ। এখন ২৫টি (নিজ মালিকানার তিনটিসহ) পুকুরে পোনা চাষ করছেন তিনি।

এ বিষয়ে আব্দুর রশিদের বড় ছেলে নাজমুল ও সেলিম জাগো নিউজকে বলেন,‌ ‘আগে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ভালোমন্দ খেতে পাওয়াই কঠিন ছিল। কিন্তু পোনা চাষে আমাদের ভাগ্য বদলেছে। বাবার সঙ্গে আমরাও পুকুরের সব কাজ করি। এখন আমরা খুব ভালো আছি।’

‘সাধারণত পুকুরে ছাড়া পোনার ২০-২৫ শতাংশ বিভিন্নভাবে মারা যায়। কখনো কখনো এরচেয়ে বেশি মারা গেলেও আল্লাহ অন্যভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে আজ এই পর্যন্ত এসেছি। প্রায় প্রতিবছরই গড়ে ২০ লাখ টাকার জমি কিনতে পারছি। তবে গতবছর আমার বেশি লাভ হয়েছে। এ কারণে ৪৭ লাখ টাকার জমি কিনেছি।’

Advertisement

প্রতিবেশী আহমাদুল্লাহ, আব্দুল আওয়াল ও আলামিন বলেন, ‘আগে রশিদের অবস্থা এরকম ছিল না। দিনরাত খেটেখুটে এতদূর এসেছেন। জমিজমা ও গোয়ালে গরুসহ এখন কি নেই তার! পরিশ্রম যে বৃথা যায় না, আব্দুর রশিদ তার প্রমাণ। তাকে দেখে অনেকেই মাছের পোনা চাষে নামছেন। অনেকেই তার কাছে পরামর্শ নিতে আসেন।’

আব্দুর রশিদ জানান, সবার বড় ও ছোট ছেলেকে নিয়ে কার্প জাতীয় রেণু পোনার চাষ করেন তিনি। খামারের নাম দিয়েছেন ‘নাজমুল মৎস্য খামার’। ২৫টি পুকুরে ৫-৭ দফায় প্রতিবছর ৪০০-৪৫০ কেজি ডিমপোনা ছাড়েন। ব্র‍্যাক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের এসব পোনার মূল্য প্রতিকেজি ৫-৭ হাজার টাকা। এ পোনাগুলো ছাড়ার একমাস পরই সাইজ হয় আধা আঙুল। এসময় থেকেই সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতাদের কাছে সাইজভেদে বিভিন্ন দামে পোনা বিক্রি শুরু করেন।

আরও পড়ুন মেহেরপুরে মিয়াজাকি আম চাষ, বিশ্বে কেজি ২ লাখ টাকা খেজুরের বীজ থেকে শাহিনের অভিনব ‘কফি’ উদ্ভাবন ১৫ দেশে যাচ্ছে গাজীপুরের কাঁঠাল

ক্রেতা চাহিদা বিবেচনায় এভাবে সারাবছরই বিক্রি হয় পোনা। বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো পোনা বিক্রি করেন আব্দুর রশিদ। বছর শেষে উৎপাদন ও সংসার খরচ বাদে ২০-২৫ লাখ টাকা সঞ্চয় করেন। এ টাকায় প্রতিবছরই জমি কেনাসহ অন্যান্য সম্পদ গড়েন রশিদ।

আব্দুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খালি হাতে এ ব্যবসায় নেমেছিলাম। আমার সঙ্গে আগে ও পরে অনেকেই এ ব্যবসায় এসেছিলেন। তাদের বেশিরভাগই লোকসানসহ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে গেছে, টিকতে পারেনি। কিন্তু আল্লাহ আমার পরিশ্রমকে বৃথা যেতে দেননি। এই ১৮ বছরের ব্যবসা জীবনে আমি কোনো বড় বিপদ পড়িনি।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণত পুকুরে ছাড়া পোনার ২০-২৫ শতাংশ বিভিন্নভাবে মারা যায়। কখনো কখনো এরচেয়ে বেশি মারা গেলেও আল্লাহ অন্যভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে আজ এই পর্যন্ত এসেছি। প্রায় প্রতিবছরই গড়ে ২০ লাখ টাকার জমি কিনতে পারছি। তবে গতবছর আমার বেশি লাভ হয়েছে। এ কারণে ৪৭ লাখ টাকার জমি কিনেছি।’

এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা প্রোগ্রামস ফর পিপলস ডেভেলপমেন্টের (পিপিডি) মৎস্য কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, ‘উনি একটি পুকুর দিয়ে শুরু করেছিলেন। এখন ২৫টি পুকুরে পোনা উৎপাদন করছেন।’

তিনি বলেন, ‘উনি আমাদের সদস্য। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিয়ে পোনা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান বাড়াতে থাকেন। এভাবে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন। অন্যদের উচিত তাকে অনুসরণ করা।’

এসআর/জিকেএস