আশা, প্রত্যাশা অনেক থাকলেও ২০১৮ সালটি খুব একটা ভালো কাটেনি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য। তবে নতুন বছরে নতুন স্বপ্ন দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। অতীতের হতাশা দূরে ঠেলে নতুন বছরে ভালো একটি পুঁজিবাজার পাবেন এমন প্রত্যাশায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
Advertisement
তারা বলছেন, চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে পেয়েছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এটি দেশের শেয়ারবাজারের জন্য বড় একটি ঘটনা হলেও, এর সুবিধা এখনও পাওয়া যায়নি। অপরদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় দেশি-বিদেশি সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাই ছিলেন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ফলে ২০১৮ সালে সূচক, লেনদেন, বাজার মূলধন সব ক্ষেত্রেই পতন ঘটেছে।
বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা করছেন নতুন বছরে এক নতুন মাইলফলকে পৌঁছাবে দেশের শেয়ারবাজার। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকার ঘটনা ছাড়াই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেছে। এ নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছে ক্ষমতাসীন দল। ফলে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা নতুন বছরে অনেকটাই কেটে যাবে। আর রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির না হলে অবশ্যই শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে আসাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে সামগ্রীকভাবে দেশের শেয়ারবজরে মূল্যসূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধন সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমনকি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে বাজারে টানা দরপতন দেখা দেয়। তবে বছরের শেষ সপ্তহের প্রতিটি কার্যদিবসে বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এতে প্রায় দেড়’শ পয়েন্ট বেড়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখীতার দেখা দিয়েই নতুন বছরে পদার্পণ করছে দেশের শেয়ারবাজার।
Advertisement
নতুন বছরের প্রত্যাশা নিয়ে বিনিয়োগকারী মো. মসিউর রহমান বলেন, ২০১৮ সাল আমাদের জন্য মোটেই ভালো ছিল না। বছরের বেশিরভাগ সময় বিদেশিরা যে পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করেছেন, বিক্রি করে দিয়েছেন তার থেকে বেশি। দেশি বড় বিনিয়োগকারীরাও অনেকটাই নিষ্কৃয় ছিল। বছরের শেষ সময়ে এসে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা জেকে বসে সবার মধ্যেই। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে বছরটিতে শেয়ারবাজার এক ধরনের পতনের মধ্যেই ছিল।
এই বিনিয়োগকারী বলেন, আগে যে দল সরকারে ছিল, আবার সেই দলই সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছে। এতে সরকারের একটি ধারাবহিকতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নতুন বছরে খুব একটা রাজনৈতিক আস্থিরতা দেখা দেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে সকল ধরনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়বে। এছাড়া চীনের দুই প্রতিষ্ঠান কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে আসার সুফল নতুন বছরে পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
আমিনুর রহমান নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, আশাকরি ২০১৯ সালে আমাদের জন্য একটি সুন্দর বছর হিসেবে দেখা দিবে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বাজার ভালো রাখতে প্রয়োজনী পদক্ষেপ নিবে বলে আমরা আশা করি। ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের যে ক্ষতি হয়েছিল তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভাব হয়নি। আশা করি নতুন বছরে আমরা অতিতের সব হতাশা কাটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাবো।
বিনিয়োগকারী বেলাল হোসেন বলেন, আমরা সবাই জানি ২০১৮ সাল শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো ছিল না। বছরটিতে নতুন করে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারী ধরা খেয়েছেন। বাজারের এ অবস্থার মূল কারণ হলো- রাজনৈতিক অস্থিরত। তবে আশার কথা হলো- বছরের শেষ মুহূর্তে বাজার কিছুটা হলেও ভালো আচরণ করেছে। আমরা আশা করছি নতুন বছরে বাজার ভালো হবে। থাকবে না কোনো রাজনৈতিক হানাহানি।
Advertisement
ফিরে দেখা ২০১৮-
চীনের দুই নামকরা শেয়ারবাজার বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের অংশীদার হলেও বছরটি বিনিয়োগকারীদের জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি। বছরটিতে ডিএসইর বড় অঙ্কের মূল্যসূচক হারানোর পাশাপাশি মোটা অঙ্কের বাজার মূলধনও হারিয়েছে। লেনদেনের ক্ষেত্রেও ছিল নেতিবাচক প্রভাব।
লেনদেন-
২০১৮ সালেজুড়ে ডিএসইতে মোট হয়েছে ১৩ হাজার ৩৫৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যা আগের থেকে ৮৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। ২০১৭ সালে লেনদেনের পরিমান ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার ৯৫৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৫৫২ কোটি ৩ লাখ টাকা। আগের বছর প্রতিকার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৮৭৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
মূল্যসূচক-
২০১৮ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স’র পতন হয়েছে ৮৫৯ পয়েন্ট বা ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বাছাই করা সূচক ডিএসই-৩০ কমেছে ৪০২ পয়েন্ট বা ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর ডিএসিই শরীয়াহ সূচক কমেছে ১৫৮ পয়েন্ট বা ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বাজার মূলধন-
সূচকের পাশাপাশি ডিএসই’র বাজার মূলধনও কমেছে। ডিএসই বাজার মূলধন আগের বছরের তুলনায় কমেছে ৩৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।
কমেছে লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানির সংখ্যা-
২০১৮ সালে ২৯৬টি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১৭৯টি কোম্পানি ২ শতাংশ থেকে ৭৯০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আগের বছর ২০১৭ সালে ২৯১টি কোম্পানি তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা করে। এর মধ্যে ১৮৭টি কোম্পানি ২ শতাংশ থেকে ৭৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে।
বিদেশি বিনিয়োগ-
২০১৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ৯ হাজার ৫৮৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার লেনদেন করেছে, যা মোট লেনদেনের ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। বছরটিতে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে বিক্রি করেছে ৫ হাজার ৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০১৭ সালে বিদেশিদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্রয় ছিল ৬ হাজার ৫৭৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং বিক্রয় ছিল ৪ হাজার ৮৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
আইপিও-
২০১৮ সালে বাজার থেকে ১টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও’র মাধ্যমে ৬০১ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ২৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা মূলধন উত্তোলন করে। অপরদিকে ২০১৭ সালে ২টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ ৮টি সিকিউরিটিজ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও’র মাধ্যমে ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ১টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ৪১ কোটি ২১ লাখ টাকা মূলধন উত্তোলন করে।
রাইট শেয়ার-
২০১৮ সালে ২টি কোম্পানি ১০ কোটি ৯৪ লাখ রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। আগের বছর ৪টি কোম্পানি ৮৬ কোটি ৮০ লাখ রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করেছিল ১ হাজার ১১৪ কোটি ২ লাখ টাকা।
বোনাস শেয়ার-
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতের ২০টি, আর্থিক খাতের ১২টি, প্রকৌশল খাতের ২৩টি, খাদ্য ও আনুসাঙ্গিক খাতের ৬টি, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতের ৭টি, টেক্সটাইল খাতের ২৯টি, ওষুধ ও রসায়ন খাতের ১৪টি, সার্ভিস অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট খাতের ১টি, সিমেন্ট খাতের ২টি, আইটি খাতের ৪টি, ট্যানারি খাতের ২টি, সিরামিক খাতের ৩টি, ইন্সুরেন্স খাতের ২৪টি এবং বিবিধ খাতের ৭টি সহ মোট ১৫৪টি কোম্পানি ৩৫৫ কোটি ৭৬ লাখ বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩ হাজার ৫৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূলধন বৃদ্ধি করেছে। অপরদিকে ২০১৭ সালে মোট ১৪২টি কোম্পানি ২৭৭ কোটি ৬৮ লাখ বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২ হাজার ৭৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূলধন বৃদ্ধি করে।
রাজস্ব-
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিএসই ২৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। এর মধ্যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৫৩ বিবিবি ধারা অনুযায়ী ব্রোকারেজ কোম্পানি থেকে উৎসে কর ১৫৯ কোটি ৩ লাখ টাকা, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৫৩এম ধারা অনুযায়ী স্পন্সর এবং প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডারের সিকিউরিটিজ বিক্রয় বাবদ ৭৪ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ সেকশন ৫৩এন অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বিক্রি বাবদ মূলধনী আয়ের ওপর ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রয়েছে।
এমএএস/এমবিআর/জেআইএম