সাহিত্য

শহীদ মিনারের মূল নকশা নভেরাই করেছে : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

আজ না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। তার জন্ম বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়। ২ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে। বিদ্যা সেরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু আর কারুকলা বিভাগেই। দেশে-বিদেশে সব মিলিয়ে ৩৫ টির মতোন একক প্রর্দশনী করেছেন। গ্রুপ এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছেন অসংখ্য। শিল্পকলায় কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করেছেন দেশ-বিদেশের একাধিক পদক। গেল ছয় দশকের বেশি সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ১০ হাজারের মতো চিত্রকর্ম এঁকেছেন। তিনি ছিলেন চারুকলা পীঠস্থানের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র। শিল্পী হামিদুর রাহমান আর নভেরা আহমেদের সমকালীন বন্ধু। সম্প্রতি তাঁর বাসভবনে ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে এই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।

Advertisement

সাখাওয়াত টিপু: নভেরা আহমেদের সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে?সৈয়দ জাহাঙ্গীর: নভেরার সাথে আমার পরিচয় হয় হামিদুর রহমানের মাধ্যমে। হামিদুর রাহমান আমার বন্ধু ছিল। ও যখন আর্ট কলেজে সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে ওঠে, তখন আমি আর্ট কলেজে ভর্তি হই। তারপর সে লন্ডনের স্লেট স্কুলে চলে গেল উচ্চতর লেখাপড়া করতে। হামিদুর লেখাপড়া শেষ করে ফিরে আসলো ৫৬ সালে। দেশে আসার পর ওর সাথে নিয়মিত দেখা হত। পুরোনো ঢাকায় তাদের বাড়ি ছিল। খাবার-দাবারে ওদের পরিবারের খান্দানি ব্যাপার ছিল। অনেক বন্ধু-বান্ধব ওখানে যেত। একদিন ওদের বাড়িতে আমি দেখলাম, এক লোক খালি গায়ে গেরুয়া রঙের ধুতি কাঁধে আর ধুতি পরে বসে আছেন। মেয়েদের মতো লম্বা লম্বা কোকড়ানো চুল। চুলে তেল মাখা। তো আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল হামিদুর। বলল, উনি হচ্ছেন এস এম সুলতান। আর্টিস্ট। সুলতান ভাই বললেন, আমি একদিন আপনার স্টুডিওতে আসবো কাজ দেখতে। এই করে হামিদুরের সঙ্গে ঘনিষ্টতা জমিয়ে উঠল। কিছুদিন পরে ওরা শহীদ মিনারের কাজটা পেল।

টিপু: কত সালের ঘটনা?জাহাঙ্গীর: এটা ১৯৫৬ সালে। তখন জব্বার সাহেব ছিলেন পিডব্লিওডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার। পিডব্লিওডির আন্ডারে এটা করা। ফলে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা আর অফিসিয়াল কাজটা করেছে হামিদুর রাহমানই। হামিদুর রাহমান নিজেও একজন শিল্পী। সে ম্যুরালের কাজ করত। আর নভেরা ওর বান্ধবী। লন্ডন থেকে ওরা পরিচিত। ওখান থেকে এসে দুজনেই একসঙ্গে কেপ করে শহীদ মিনারের কাজ শুরু করল। আমি আর আমিনুল ইসলাম প্রায়ই ওদের ওখানে যেতাম। কাইয়ুম চৌধুরীও যেত। যখন কাজটা করছিল আমার মনে আছে, মাটি দিয়ে প্রথম বেদিটা, তারপর মাটি দিয়েই সিঁড়িগুলো বানিয়ে ছিল। যে পিলারগুলো আছে ছোট ছোট কাঠের ডাল দিয়ে, সেটা দিয়ে প্রাথমিক ডিজাইন করেছিল।

টিপু: কে করেছিল, নভেরা না হামিদুর?জাহাঙ্গীর: নভেরাই করেছিল। কারণ নভেরা ছিল ভাস্কর। ওর পক্ষে এটা সুবিধা ছিল আইডিয়া কন্সিভ করা, ডাইমেনশন কন্সিভ করা, ম্যাটেরিয়াল কন্সিভ করা। কিন্তু হামিদ সাহায্য করেছিল নভেরাকে। হামিদও জানত টেকনিকগুলো, বিষয়গুলো। দুজনে মিলে করলেও, নভেরাই কাজটা করেছে। তবে মূল নকশাটা নভেরাই করেছে। আমরা দেখতাম, আলোচনা করতাম। এটার কাজ শুরু হল আরও পরে। অনুমতি পাবার পর। প্রথমে চিন্তা করেছিল, পিলারগুলোর মাঝখানে ওরা স্টেইন্ট গ্লাস লাগাবে। চার্চের মধ্যে যেমন স্টেইন্ট গ্লাস লাগায়। চার্চের ভেতরে অন্ধকার থাকে, জানালা দিয়ে সূর্যের আলো যখন নামে তখন লাল-নীল-সবুজ রঙের মতো আভা তৈরি করে। তো সে রকম তারা চিন্তা করেছিল, একদম সাদা বেদি তৈরি করবে। সেই বেদির ওপর সূর্য যখন পেছন দিয়ে যাবে, স্টেইন্ট গ্লাসের কালার বেদির ওপর পড়বে। কিন্তু দেখা গেল, দিনের বেলায় সেই কালার আর আসে না। কাজেই সেই পরিকল্পনা ওরা তখন বাদ দিয়েছিল। বাদ দেবার পরেই লোহার এই কাঠামো করেছিল। এটাই ছিল মূল কাহিনী।

Advertisement

টিপু: বাদ দেয়া কাঠামো কেমন ছিল?জাহাঙ্গীর: ওরা একটা বেইজমেন্ট করেছিল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে হতো। অনেক কামরা ছিল তাতে। কামরার দেয়ালে নকশা করেছিল। কিছু ম্যুরাল করেছিল। কিছু রিলিফের কাজ করেছিল। রিলিফ মানে দেয়ালে সিমেন্ট দিয়ে ভাস্কর্যের কাজ করেছিল। কাজগুলো হামিদুর রাহমান ও নভেরা আহমেদ, দুজনেই করেছিল। হামিদুর ম্যুরালের কাজটা বিদেশ থেকে শিখে এসেছিল। সে কাজ এখন আর নাই। পাকসেনারা ভেঙে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন তৈরি হয়েছে, তখন আর আগের বেইজমেন্টটা নাই। বেদি আছে আর পিলারগুলো আছে।

টিপু: এখন শহীদ মিনারের যে জ্যামিতিক ফর্ম, সেটা কি নকশার ফর্মের সাথে মিল ছিল?জাহাঙ্গীর : আমার মনে হয় ফর্মটা এরকমই ছিল। পরে লাল কাপড়টা লাগানো, মোস্তফা মনোয়ারই যুক্ত করেছিল সেটা। কারণ রাতের বেলায় শহীদ মিনারে যখন অনুষ্ঠান হবে, তখন পেছন দিকে লাইট দিলে পতাকার লাল সূর্যটা দেখা যাবে। ওরা থাকলে এটা মেনে নিতো কিনা বলা যায় না।

টিপু: নভেরার শিল্পকে কিভাবে দেখেন?জাহাঙ্গীর: নভেরা খুব ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট ছিল। যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্স ছিল হেনরি মুরের শিল্পকর্মের। হেনরি মুর কাজের মধ্যে ফুটো ফুটো করে, এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যাচ্ছে, স্কাল্পচারের যে বেসিক নিয়ম সেটাকে পাল্টে দিয়ে থ্রি-ডাইমেনশন এনেছিল। ফুটো দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাবে। এর মধ্যে নভেরা যে কাজটা করেছিল সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এক ভদ্রলোক ছিলেন পাট ব্যবসায়ি। তেজগাঁওয়ের এম আর খান নাকি কি নাম জানি, তার বাড়িতে একটা স্কাল্পচার করেছিল। ওই সময় ওটা আমি দেখেছি। গরুর পিঠে একটা লোক বসে আছে। তারপর ওটাকে আনতে হবে, কিন্তু কী করে আনবে। এটা তো ভীষণ ভারী। হামিদুর রহমান চারটা চাকা বানালো। তারপর রেলের মত রাস্তা দিয়ে টেনে টেনে আনালো। আর বহু কাজ আছে নভেরার। যে কাজগুলোতে হেনরি মুরের কাজের সাদৃশ্য থাকলেও তার নিজস্বতা আছে।

টিপু: হেনরি মুরের সাদৃশ্য থাকলে নভেরার নিজস্বতা কোথায়? জাহাঙ্গীর: তার নিজস্বতা আছেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের কালচার, যে ফিগার নিয়ে কাজ করেছে সে, সেগুলো তো বাংলাদেশেরই কালচারের ফিগার। বাচ্চাকে নিয়ে মহিলা, তারপরে ধান মাড়াই করছে মহিলা, এগুলো বাংলাদেশেরই ফিগার। ওয়েস্টার্ন কোন থিম নিয়ে কাজ করা না, থিমগুলো এই অঞ্চলেরই। তবে কাজের ধরন পশ্চিমা এবং আধুনিক। ওই সময় এমন আধুনিক কাজ খুব কম হয়েছে। এখনও পর্যন্ত যে সব স্কাল্পচার তৈরি হচ্ছে, তার ওগুলো বেশি কমপেক্ট। বেশ থটফুল। বেশি প্রভোকিং। বেশি আধুনিক তো বটেই।

Advertisement

টিপু: পঞ্চাশের দশকের একটা ক্যাটালগ দেখলাম। যেখানে বেশকিছু চিত্রকলা আছে এই ফর্মের। চিত্রকলার ফর্মটাই তো স্কাল্পচারে আসে। তাহলে নভেরার স্কাল্পচার কেন সিগনিফিকেন্ট হয়ে উঠল?জাহাঙ্গীর: আমি নভেরার সব কাজ দেখিনি। তবে নভেরার ইতিহাস বলতে গেলে, নভেরা তো হামিদুর রাহমানের সাথে ছিল। এক সঙ্গে থাকতো। লিভ টুগেদার করত। ১৯৫৮ সালের একটা ঘটনা বলি, ওই সময় আমিই পাকিস্তানের প্রথম ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকায় যাই। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ওই ফেলোশিপের নাম ছিল ‘লিডার স্পেশালিস্ট একচেইঞ্জ ব্রান্ড’। তিন মাসের জন্য গিয়েছিলাম আমেরিকায়। সেখানে বিভিন্ন গ্যালারি ঘুরে দেখতাম। ফিলাডেলফিয়াতে আমি একটা এক্সিবেশন করেছিলাম। তিন মাস শেষ হবার পরেও আমি ওখানে ছিলাম। ছবি আঁকতাম। ছবি-টবি এঁকে একটা এক্সিবিশন করেছিলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে। আরেকটা ফিলাডেলফিয়ায়। ফিলাডেলফিয়ার এক্সিবিশন করার সময় একদিন রাস্তায় সরাসরি হামিদুর রাহমানের সঙ্গে দেখা। আমি বললাম, হামিদ তুমি কি করে এখানে এলে? সে বলল, আমি একটা স্কলারশিপ নিয়ে আসছি। স্কলারশিপটা ম্যুরালের ওপর হায়ার এডুকেশন। তখন হামিদ বলল, তুমি আছো কোথায়? বললাম, এইখানে কাছের একটা হোটেল। হামিদ বলল, না তুমি ওইখানে থাকার দরকার নেই। আমি এক রুমের একটা কামরা ভাড়া নিয়েছি। তুমি এখানে চলে এসো। তো আমি হামিদুরের সাথে একমাস ছিলাম ওইখানে। আমার করার কিছুই ছিল না। ছবি আঁকতাম। হামিদ চলে যেত তার কলেজে।

তারপরে আমি যখন চলে আসব, তখন সে বলল: নভেরাকে আমি বেলি রোডে ঘর ভাড়া করে দিয়ে এসেছি, একটা গাড়ি কিনে দিয়ে আসছি, একজন ড্রাইভার ঠিক করে দিয়ে আসছি, কাজের লোক রেখে এসেছি। তো তুমি গিয়ে দেখো একটু। একদিন আমি গেলাম নভেরাকে দেখতে। দরজা নক করার পর খুলে নভেরা একদম চমকে গেছে। ও বিশ্বাস করেনি যে, আমি ওখানে যাব। তখন ও বলে, দাঁড়াও আমি পোশাক পাল্টে আসি। কারণ সে কাজ করছিল তখন। সি ডিড নট ওয়ান্ট টু শো হারসেল্প লাইক দ্যাট। পরে আমি গিয়ে দেখলাম, সে অনেক কাজ করেছে। সে মেয়ে হয়েও অনেক পরিশ্রমের কাজ করত। কামরার ভেতর বড় বড় স্কাল্পচার। পরে সেগুলোর প্রদর্শনী হয়। এটা অসাধারণ ব্যাপার। ১৯৬০ সালে আমি চলে যাই ওয়েস্ট পাকিস্তানে। কারণ এখানে তখন ছবি বিক্রি হত না। আর আমি ছিলাম পেশাদার আর্টিস্ট। ছবি বিক্রি করে সংসার চালাতাম। পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিল ক্যাপিটাল। সেখানে ছিল বিদেশি দূতাবাস। দূতাবাসের লোকেরাই ছবি কিনতেন। ওইখানে গিয়ে যদি ছবির মার্কেট পাওয়া যায়, তাহলে মন্দ হবে না। তো আমার বান্ধবী বলল, চল একটু দেখে আসি নভেরা আসছে। এখানে থাকবে। ওতো ডান্স করে। ওতো ফ্লোরগুলো দেখতে চায় যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে। তখন শুনলাম, হামিদুর রাহমান মোহাম্মদ আলীকে বলে আসছিল, তুমি নভেরাকে দেখাশোনা কর। মোহাম্মদ আলী বোধ হয়, তখন এশিয়া উইকলির সাব-এডিটর ছিল। মোহাম্মদ আলী তখন নভেরাকে নিয়ে চলে গেল। ওরা থাকত তখন লাহোরে। তো ওই বাড়িটা পা ঘষে ঘষে দেখছিল, ফ্লোর সমান আছে কিনা? নাচের জন্য সুবিধা হবে কিনা!

তার কিছুদিন পর, ওই সময় আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারি ছিলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। ফয়েজ আহমদ নভেরার একটা আর্ট এক্সিবিশন অর্গেনাইজ করেছিলেন। যেটা আমি দেখিনি। কারণ ওই সময় আমি রাওয়ালপিন্ডি চলে গিয়েছিলাম। আমি আর লাহোরে নাই। শুনেছি, এইখানে যে কাজ করত সেই ধরনেরই কাজ ছিল ওই প্রদর্শনীতে। নভেরা কাজে নিজস্বতা বজায় রাখত। অন্য আর্টিস্টরা এই ধরনের কাজ করত বলে মনে হয় না।

টিপু: নভেরাকে কি বলা যায়, পূর্ববঙ্গের প্রথম আধুনিক ভাস্কর?জাহাঙ্গীর: অবশ্যই বলা যায়। প্রথম মডার্ন স্কাল্পচারিস্ট। যেটা আমি মনে করি, এখনো পর্যন্ত আমাদের এখানে এত মডার্ন স্কাল্পচারিস্ট তৈরি হয়নি। এখন যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেরই কাজ দেখেছি। তাদের বেশির ভাগেরই কাজ বিদেশি স্কাল্পচারের অনুকরণ। একদম নকল। অনেকের কাজ আছে তার মধ্যে মেধা কম। বিদেশি কাজ দেখে যন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে এমন করে বানানো, ওর মধ্যে শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া যায় না, শিল্পকে খুঁজে পাওয়া যায় না, আর শিল্পের যে বিষয়বস্তু সেটাও খুঁজে পাওয়া যায় না, একটা অবজেক্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা আমার ব্যক্তিগত মত।

টিপু: হেনরি মুর থেকে পার্থক্য কোথায় নভেরার? হেনরি মুর তো প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে স্কাল্পচার করতেন? এানে প্রকৃতিকে যোগ করতেন আর কি?জাহাঙ্গীর: হেনরি মুরের তো পারস্পেকটিভ অন্যরকম ছিল। আপনি যেমন বলেছিলেন, প্রকৃতিকে সে যোগ করতে চেয়েছে। যেমন: হেনরি মুরের একটা স্কাল্পচার আমি দেখেছিলাম হংকংয়ে। হংকংয়ের ডাউন টাউনে বিশাল বিশাল বিল্ডিং তার মাঝখানে ছোট্ট একটা লন। লনের মধ্যে দুটো সার্কেলের মত মেটাল-ব্রোঞ্জের কাজ। অপূর্ব সুন্দর ওই বিল্ডিংয়ের মধ্যে মানিয়ে ছিল। আরেকটা এক্সিবিশন দেখলাম লন্ডনের হাইড পার্কে হেনরি মুরের। সেখানে আবার অন্যরকম কাজ দেখলাম। কিছু জন্তু-জানোয়ারের ফিগারের কাজ। খুব আধুনিক কাজ। হেনরি মুরের সমকালীন ছিলেন বারবারা হেপওর্থ। বারবারাও ভাল কাজ করতেন। কাঠের কাজ, মেটালে না, সিমেন্টে না।

টিপু: এটা তো তাদের চেতনাগত জায়গা। নভেরার কাজ কি সেই পর্যায়ের? তার কাজ কি মেকানিক্যাল মনে হয়? কিংবা ম্যাকানিক্যাল রি-প্রোডাকশন মনে হয়?জাহাঙ্গীর: হেনরি মুর শেষের দিকে যে কাজ করতেন, সেগুলো ওর্ডার নিয়ে কাজ করতেন। ‘আমাকে এটা বানিয়ে দাও’ এই ধরনের কাজ। আমাদের এখানেও এই ধরনের কাজ হয়। তবে মুরের ক্ষেত্রে যেটা সত্যি সত্যি প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে, চিন্তা-ভাবনা করে, সেটার সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতেন। সেটা নভেরার ক্ষেত্রে অনেকাংশে আছে। নভেরা নিজের দেশের বিষয়বস্তু তুলে ধরেছে। হেনরির সব কাজের ছায়া তো নভেরাতে নাই। তার নিজস্বতা গ্রো করেছিল।

টিপু: আপনি যে মডার্ন বলছেন, সেটা কি সাবজেক্টের ক্ষেত্রে না অবজেক্টের ক্ষেত্রে? নাকি দুটোর ক্ষেত্রে?জাহাঙ্গীর: দুই ক্ষেত্রেই আধুনিক। এক তো হল ফর্ম, একটা হল ম্যাটেরিয়াল, আরেকটা হল তার কন্সেপশন, সব মিলিয়ে আমি বলছি মডার্ন! এখানকার পুতুল-টুতুলের মধ্যে যে ফর্মগুলো ছিল, লোকজধারার যে ট্রেডিশনগুলো ছিল সেগুলোর সঙ্গে নভেরার কাজের মিল পাই।

টিপু: তার মধ্যে কি জাতীয়তাবোধ ছিল?জাহাঙ্গীর: লোকজধারার যে ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করতো সেগুলোর মধ্যে তো জাতীয়তাবোধ ছিল। ছোটবেলায় দেখতাম, পুজোর বাজারে যে সকল পুতুল, ছোট ছোট নৌকো, মাটিরই নৌকো, তলায় আবার মাটির চাকা লাগানো। সাদা আর লাল রং দিয়ে ডেকোরেট করা। ওটা রশি দিয়ে টানা যেত। যেমন- একটা মাটির ঘোড়া, তার পিঠে মানুষ বসে আছে। পা দুটো আছে। এগুলো পালরা তৈরি করত। ওরকম একটা ফর্ম নিয়ে সে কাজ করেছে। যেটা জাদুঘরের ভেতরে রাখা হয়েছে। ওই স্কাল্পচারে যেটা হলো, সেটা বলা যেতে পারে হেনরি মুরের প্রভাবিত।

টিপু: নভেরার বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়াটা কেন?জাহাঙ্গীর: এটা একজন শিল্পীর পক্ষে হতেই পারে। দীর্ঘদিন হামিদুর রাহমানের সাথে ছিল। মোহাম্মদ আলী তার একটা দারুন পাবলিসিটি দিল। একজন শিক্ষিত জার্নালিস্ট। ইন্টারন্যাশনাল লেবেলের, সে তাকে নিয়ে গেল। নভেরা হামিদুর রাহমানের চেয়ে প্রেফার করল মোহাম্মদ আলীকে। তারপর মোহাম্মদ আলীর সাথেও সে থাকল না। সে ইন্ডিয়াতে ডান্স শিখতে চলে গেল। তারপর চলে গেল ফ্রান্সে। এতো কিছু খেয়াল করাতো সম্ভব না। এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার।

টিপু: নভেরা সম্পর্কে মিথটা তৈরি হল কেন?জাহাঙ্গীর: মিথটা সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। এটা আগে ছিল না। মাতামাতি হতো না। লেখালেখি হতো না। একসময় বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক দিতে চেয়েছিল। তখন সে প্যারিস ছিল। সে পদকটা রিফিউজ করেছিল। রাষ্ট্রীয় পদক নেবে না, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। সে জন্য তার মূল্যায়ন অন্যভাবে তৈরি হয়েছিল। সেই থেকে আমার মনে হয়, অল্প অল্প করে লোকে জানতে শুরু করল। বলাবলি শুরু করল। তাকে নিয়ে বই বের হল।

তারপরে নভেরা আরেকটা জিনিস করল। যেটা হিন্দুরা করে। এটা শুধু হিন্দুরা না, প্রাচীন গ্রিক আমল থেকে চলে আসছে। যেটা পুরোপুরি হিউম্যান ফিগারের মতোই হবে। একটা বেউজ তৈরি করা হয়, কাঠামো তৈরি করা হয়, তাকে আবার মাটি দিয়ে, প্লাস্টার দিয়ে তৈরি করা হয়। তাকে আবার কাস্টিং করা হয়। তার থেকে ট্রান্সফার করা হয়। নভেরার বহু কাজে এই হিউম্যান ফর্মগুলোর ভেতরের অংশকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। দেখা যায়, ভেতরের অংশটা নাই, কিন্তু বাইরের কাঠামোটা ধরে রেখেছে। এটাও তার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

টিপু : তার দেশে না থাকাটা কি ক্ষতির?জাহাঙ্গীর: হয়ত নভেরা যদি দেশে থাকত, তাহলে দেশের জন্য অনেককিছু করে যেতে পারত। হয়ত অনেক আইকনিক স্কাল্পচার তৈরি করতে পারত। অন্যদিকে, সে কিছুই করতে পারত না হয়ত। আটপৌরে অন্য মেয়েদের মতোও হতে পারত। আবার এইখানে না থাকার ফলে সে যে কাজ চালিয়ে গেছে, এতেই বোঝা যায় তার শিল্পী মন সবসময় জাগ্রত ছিল। সি ওয়াজ ভেরি ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট। জেনুইনলি ফ্রলিফিক আর্টিস্ট। ওই সময়, ১৯৫০ দশকে পিছিয়ে থাকা সমাজে একজন নারী শিল্পীর পক্ষে এই ধরনের কাজ করা নিঃসন্দেহে অসাধারণ ব্যাপার।

টিপু: নভেরার পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্কাল্পচারে কি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে?জাহাঙ্গীর: নভেরার পরে বাংলাদেশের স্কাল্পচারে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। যে কাজটা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, সেটা রিয়েলিস্টিক ফর্মের কাজ। সেটার সেন্টিমেন্টাল ভেল্যু অনেক বেশি স্কাল্পচারের ভেল্যু থেকে। এটা খুব একটা আধুনিক না। পুরোনো ইউরোপে এই ধরনের কাজ হয়েছে। ইউরোপে তো পাথর দিয়ে কাজ হতো, এখানে তো সেভাবে হয়নি। সিমেন্ট দিয়ে জমিয়ে জমিয়ে কাজ হয়েছে। তবুও বলব, আবদুল্লাহ খালিদের ভাল কাজ। আর যেগুলো হয়েছে সেগুলো রিলিফ ওয়ার্ক। কিছু মেটালের কাজ হয়েছে সেগুলো ভাল না। কারণ মেটালে কাজ করতে হলে কিছু কন্সেপশনের দরকার। সেটার ঘাটতি আছে। যাই হোক, কলিকদের সম্পর্কে এসব বলা ঠিক না। হয়ত ওরা ভালই করছেন। ভবিষ্যতে মূল্যায়িত হবেন।

টিপু: সাক্ষাৎকারে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।জাহাঙ্গীর: আপনাকে ধন্যবাদ।

এইচআর/পিআর