একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো পর্যায়েই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সমান সুযোগ) নেই বলে অভিযোগ করে প্রতিকার চেয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন আসনের বিরোধী প্রার্থীরা। তারা বলছেন, প্রচারণায় নামলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় হামলা, মারধর ও হয়রানি করছে সরকারি দলে প্রার্থীর লোকজন।
Advertisement
তবে উল্টো সুর আওয়ামী জোটের প্রার্থীদের মুখে। তারা বলছেন, কেউ প্রচারণায় না নামলে কিছু করার নেই বরং হামলায় তাদের অভিযোগ বিরোধী প্রার্থীদের ওপর।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা-৪ থেকে ঢাকা-১৮ আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব বলেন তারা।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় জাতীয় চিত্রশালার প্লাজা অডিটোরিয়ামে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়। সভায় এসব এলাকার বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা অংশ নেন।
Advertisement
ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও ঢাকা মহানগর এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তা কে এম আলী আজমের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (ঢাকা অঞ্চল) রকিব উদ্দিন মন্ডল, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃঞ্চপদ রায়, বিজিবির ঢাকা-৮ ও ৯ আসন এলাকায় নিয়োজিত বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর তারিক।
অনুষ্ঠানে ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকি বলেন, নির্বাচনে সকলের সমান সুযোগ তৈরি না হওয়ায় মানুষের ভোটের অধিকার ও আস্থাটা থাকছে না। আপনারা (নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) যদি ভূমিকা না নেন তাহলে মানুষের আস্থার জায়গাটা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। আর যদি মনে করেন, এটাই যদি হয় লক্ষ্য যেভাবে আছে সেভাবেই চলবে তাহলে তো কিছু বলার নেই। তখন জনগণই তাদের অধিকার ও স্বার্থ দেখবে। সারাদেশে যে হামলা গ্রেফতার ও ঢাকার যে চিত্র দেখছি, সেখানে সমান সুযোগের দেখছি না। সেখানে আমরা আশা করছি আপনারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন।
জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রচার-প্রচারণার প্রথমদিনই প্রথম দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পোস্টার লাগাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন সরকারদলীয় একজন মন্ত্রী এবং তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তার কথা বলেই আমাদের বলা হয়েছে আর কারও পোস্টার এলাকায় থাকবে না। নির্বাচনী আচরণবিধি বলে তো কিছু আছে। সেটার ন্যূনতম কার্যকারিতা যদি না থাকে তাহলে আচরণবিধির ব্যাপারটাই উঠিয়ে দেয়া ভালো।
তিনি বলেন, আচরণবিধিতে বলা হচ্ছে, প্রতি ওয়ার্ডে একটির বেশি নির্বাচনী অফিস থাকতে পারবে না। কিন্তু ঢাকার সে এলাকায় যদি যান তাহলে দেখতে পাবেন আসলে কয়টা তাদের নির্বাচনী অফিস। কিন্তু আমরা একটি করে অফিস নেয়ার চেষ্টা করেও পাইনি। ২৭নং ওয়ার্ডের অফিস নেয়ার কথা ছিল তা ভেঙে দেয়া হয়েছে। ৩৬নং ওয়ার্ডের জন্য অফিস নিতে গেলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে হুমকি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর এসব অভিযোগের প্রমাণ দেয়াও মুশকিল।
Advertisement
অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর হাতপাখা প্রতীকের ঢাকা-৯ আসনের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সর্দার মো. মানিক মিয়া বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। আছে বলে দাবি করাও সম্ভব না। যে কারণে সেনাবাহিনীকে যেন ২৪ তারিখের আগেই মাঠে নামানো হয়।
তিনি বলেন, প্রতিটি আসনে তদারকি ও সমন্বয় সভা করা দরকার। কারণ আজও অনেক প্রার্থী অনুপস্থিত। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো নম্বর নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সমস্যায় পড়ে কারও নম্বরে কল দিলেও পাওয়া যায় না। বিটিভি শুধুমাত্র একপক্ষের প্রচারণা করছে। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি যেন সবার সমান সুযোগ দিয়ে প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান করে। সেটার নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বিশেষ করে যত প্রার্থী আছে তাদের সঙ্গে যেন সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ সমান আচরণ করেন।
নিজের বক্তব্যে ঢাকা-৬ আসনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী মতবিনিময় সভায় পুলিশের আচরণে বিষোদগার করে বলেন, একের পর এক হামলা হচ্ছে। আমার ওপর হামলা হয়েছে। হামলায় সহযোগিতা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা দাঁড়িয়ে দেখেছে। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং হামলার শিকারদেরই নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করেছে। সহযোগিতা চাইলে তারা তামাশা দেখেছে। তারা বলেছে, পুলিশের নির্দেশ সহযোগিতার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, মিছিল বের করলেও হামলা, প্রচারণা হলেই হামলা, বাধা হয়রানি। এসব কিছুই সংঘটিত হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সযোগিতায়। আমরা এসব নিয়ে বারবার বলার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মাঠে মানা হচ্ছে না। আগামী ৩০ তারিখ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি-না আমি সে ব্যাপারে খুবই সন্দিহান।
ঢাকা-১২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পক্ষ থেকে সমন্বয়ক ও এজেন্ট (নাম বলেননি) বলেন, প্রথম কোদাল মার্কারই লেমেনেটিং পোস্টার লাগানো হয়েছে। আমাদের মধ্যে পারস্পারিক পোস্টার বিতরণও হয়েছে।
তিনি বলেন, এখানে বিরোধী প্রার্থীরা যেসব অভিযোগ করছেন তার আংশিক সত্যতা আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে যে অভিযোগ সেটারও আংশিক সত্যতা আছে। তবে বাকিটা অন্য কেউ করে দেবে না বা সেনাবাহিনী করে দেবে না। রাজনৈতিকভাবেই বা মাঠে নেই সেটার নিজেদের প্রমাণ করে দিতে হবে।
ঢাকা-১৫ আসনের জাকের পার্টির (গোলাপ ফুল) প্রার্থী মো. আব্দুল মান্নান বলেন, আমার এলাকায় যতবার বিচরণ করেছি কোনো সমস্যা হয়নি। পাওয়ারফুল প্রার্থী কামাল আহমেদ মজুমদার। ওখানে তারা বাধা দেয়নি।
ঢাকা-১৫ ও ১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী (দালান মার্কা) আব্দুর রহিম বলেন, আমাকে হাইকোর্ট থেকে প্রার্থিতা নিয়ে আসতে হয়েছে। আমার নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ঘর নিতে গিয়ে কর্মী গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। আর আমার এলাকায় ক’জন প্রার্থী তা মিডিয়া জানে না। কারণ প্রার্থীদের সঠিক সংখ্যা জানানো হয়নি। আমার নামটাই কোথাও নেই। তাহলে বোঝেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কোথায়?
ঢাকা-১৪ আসনের বিএনএফ প্রার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার এলাকায় কেউ আমাকে বাধা দেয়নি। ছোটদল বলেই হয়তো (হেসে)। জাতীয় পার্টির মনোনীত ঢাকা-১০ আসনের প্রার্থীও একই সুরে কথা বলেন।
ঢাকা-১৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামাল আহমদ মজুমদার বলেন, যারা মানুষ হত্যা করেছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদেরই একটি দল জামায়াতে ইসলামী। সেই দল থেকে ধানের শীষের প্রতীকে তাদের সেক্রেটারিকে নমিনেশন দেয়া হয়েছে। তারা বহিরাগত ক্যাডার নিয়ে আসছে। সেখানে তারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি ও নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। এমন প্রার্থীর নমিনেশন কেন বাতিল হলো না তা জানি না। কারণ তার ঠিকানা, তথ্য সব মিথ্যে।
তিনি বলেন, অনেকেই বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং নেই। আপনারা আমার জনসভায় আসেন। আমিই ব্যবস্থা করে দেবে কী বলতে চান। আমরা ভোটে বিশ্বাস করি। নিরপেক্ষ ভোট হবে, যার যার ভোট সে দেবে।
অনুষ্ঠানে অর্ধশতাধিক প্রার্থী অংশ নিলেও মতবিনিময় সভায় ৪১ জন প্রার্থী কথা বলার সুযোগ পান। অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ প্রার্থীর বক্তব্য, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং নেই এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিভির ভূমিকার সমালোচনা করেন তারা।
জেইউ/বিএ/জেআইএম