পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গুটিকয়েক বীমা কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে। গত দুই মাসে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ প্রায় সাত লাখের মতো বেড়েছে। তবে টাকার অঙ্কে বিনিয়োগের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার ওপরে কমে গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক ভিত দুর্বল এবং বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত থাকায় দেশের বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নামমাত্র কয়েকটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে বিদেশিদের। তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালোভাবে পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের বিনিয়োগ সাধারণত ব্লু চিপ (ভালো মৌলভিত্তি) কোম্পানিতে হয়ে থাকে। কিন্তু দেশের সিংহভাগ বীমা কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি খুব একটা শক্ত নয়। দু-একটি বাদে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের আয় ও লভ্যাংশের ক্ষেত্রে খুব একটা ধারাবাহিকতা নেই। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বর্তমানে ৪৭টি বীমা কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে মাত্র আটটি কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে। ওই আট কোম্পানির মধ্যে তিনটিতে বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ দুই মাসের ব্যবধানে বেড়েছে। বাকি পাঁচটিতে শেয়ার ধারণ আগের অবস্থানেই রয়েছে। তিনটি কোম্পানিতে বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ বাড়ার পরও টাকার অঙ্কে বিনিয়োগ কমে গেছে। বর্তমান বাজার দরে বীমা খাতের কোম্পানিগুলোতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ৫৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। যা দুই মাস আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে ছিল ৫৮ কোটি ৩২ লাখ ২৯ হাজার টাকা। সে হিসাবে দুই মাসে বীমা খাতে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমেছে দুই কোটি ৫৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা। বীম প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিদেশিদের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আছে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সে। নভেম্বর মাস শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের হাতে। সেপ্টেম্বর মাস শেষেও প্রতিষ্ঠানটির একই পরিমাণ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে। গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের মোট শেয়ার সংখ্যা আট কোটি ছয় লাখ ৯১ হাজার ১৮৭টি। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির ৬৬ লাখ ৫৭ হাজার শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। বর্তমান বাজার দরে এ শেয়ারগুলোর মোট মূল্য ৩৮ কোটি এক লাখ ১৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ সাধারণ বীমা কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ৩৮ কোটি এক লাখ ১৬ হাজার টাকা। শেয়ার সংখ্যার পার্থক্য না হলেও সেপ্টেম্বরে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সে বিদশিদের বিনিয়োগ ছিল ৩৯ কোটি ৮০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সেও বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ কম বা বেশি হয়নি। তবে শেয়ারের দাম কমে যাওয়ার কারণে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে গেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ১২ কোটি ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ বা ২১ লাখ ১৫ হাজার রয়েছে বিদেশিদের কাছে। বর্তমান বাজার দরে সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। নভেম্বর মাস শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ১ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে। সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের দশমিক শূন্য নয় শতাংশ ছিল বিদেশিদের কাছে। সে হিসাবে এই বীমা প্রতিষ্ঠানে বিদেশিদের শেয়ার ধারণ বেড়েছে ১০ গুণের ওপরে। ফলে টাকার অঙ্কেও বেড়েছে বিনিয়োগ। সেপ্টেম্বরে সিটি জেনারেলে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল আট লাখ ৫৯ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ন্যাশনালে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ১২ লাখ ১৯ হাজার টাকা। সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল ১২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ সাত হাজার টাকার মতো কমেছে। তবে বর্তমানে বিদেশিদের কাছে কোম্পানিটির যে শেয়ার আছে, দুই মাস আগেও শেয়ার সংখ্যা তাই ছিল। বিদেশিদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দশমিক ১৭ শতাংশ বা ৭৫ হাজার শেয়ার রয়েছে। এছাড়া বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ স্থির থাকা অন্য বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ১২ লাখ ২২ হাজার টাকা। সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল ১৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের দশমিক ১৫ শতাংশ বা ৬০ হাজার শেয়ার রয়েছে বিদেশিদের কাছে। পপুলার লাইফে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে এক কোটি ৪৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল এক কোটি ৪৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের দশমিক ২১ শতাংশ বা এক লাখ ২৭ হাজার শেয়ার রয়েছে বিদেশিদের কাছে। এদিকে বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ বাড়া বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রাইম ইসলামী লাইফে বর্তমানে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে ২৯ লাখ ছয় হাজার টাকা। সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল ২৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। সে হিসাবে শেয়ার ধারণের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। নভেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের দশমিক ১৮ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল দশমিক ১৭ শতাংশ। তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে দুই কোটি ৩২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল দুই কোটি ১৭ লাখ দুই হাজার টাকা। সে হিসাবে দুই মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে ৩৫ লাখ টাকার ওপরে। নভেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ২ দশমিক ২৩ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ২ দশমিক ১১ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে জোগো নিউজকে বলেন, ‘বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন অস্বচ্ছ। আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়ই গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ না করা সংক্রান্ত অভিযোগ ওঠে। এসব কারণে হয় তো বিদেশিরা বীমা খাতের প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘বীমা খাতের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায় না- এমন আশঙ্কা থেকেই হয় তো বিদেশিরা বীমা খাতের কোম্পানিতে খুব একটা বিনিয়োগ করেন না। তাছাড়া বীমা খাত বেশ বিশৃঙ্খল। এ খাতের একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলেও সেটি খুব একটা কার্যকর নয়। ফলে বীমা কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে।’ এমএএস/এমএআর/আরআইপি
Advertisement