দেশজুড়ে

নোয়াখালী-২ আসনে দুটি বড় দলেরই একাধিক প্রার্থী

নোয়াখালীর সেনবাগ-সোনাইমুড়ীর আংশিক এলাকা নিয়ে নোয়াখালী-২ আসন গঠিত। বিএনপির দুর্গ হিসেবে খ্যাত এ আসনে আওয়ামী লীগ ১৯৭৩ ও ২০১৪ সাল ছাড়া আর কোনো বার জয় লাভ করতে পারেনি। তাই সামনের নির্বাচনে এ আসন ছাড় দিতে রাজি নয় বড় দুটি দল। ভালো প্রার্থী হলে এ আসনে ভোটে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।

Advertisement

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণায় নেমেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। দলীয় প্রতীকে ভোট চেয়ে উপজেলা সদর থেকে শুরু করে পৌরসভা ও ইউনিয়ন ওয়ার্ডের অলিগলি সম্ভাব্য প্রার্থীদের বর্ণিল ব্যানার, বিলবোর্ড আর পোস্টারে ছেয়ে গেছে। দুটি দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় সবাই মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ কৌশলে শুরু করেছেন ভোটের রাজনীতি।

সেনবাগ উপজেলার ৯টি ও সোনাইমুড়ী উপজেলার আংশিক এলাকা তিনটি ইউনিয়ন মোট ১২টি ও একটি পৌরসভা নিয়ে নোয়াখালী-২। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার ০৮১। মোট ভোটকেন্দ্র ১০৩টি এবং বুথের সংখ্যা ৫৩৮।

আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ মোরশেদ আলম, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহম্মেদ এফসিএ পিইচডি, আওয়ামী লীগ নেতা লায়ন জাহাঙ্গীর আলম মানিক, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাফর আহম্মদ চৌধুরী। এছাড়া সেনবাগ পৌরসভার মেয়র আবু জাফর টিপুর নামও শোনা যাচ্ছে।

Advertisement

বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও বর্তমানে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সেনবাগ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মফিজুর রহমান। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি থেকে দলের সেনবাগ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হাসান মঞ্জুরের নাম শোন যাচ্ছে। জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম জুয়েলও নির্বাচন করতে পারেন বলে জানা গেছে।

তবে এ আসনেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। ২০১৪ সালে মূল সেনবাগ থেকে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে পার্শ্ববর্তী তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে নাটেশ্বর গ্রামের মোরশেদ আলমকে হঠাৎ করে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন ও পরবর্তী এমপি হওয়ার পর থেকে শুরু হয় কোন্দল। তাছাড়া পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়াকে নিয়ে রয়েছে কোন্দল। এছাড়া দীর্ঘদিনেও উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় না এখানে। হঠাৎ সম্মেলন ছাড়াই জেলা থেকে কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতেও মূল সেনবাগের বাইরের গ্রামের মোরশেদ আলমকে সভাপতি ও আতাউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু সেনবাগ বিএনপির রাজনীতিকে জয়নুল আবদীন ফারুক তার ঘরের মধ্যে নিয়ে গেছেন। জয়নুল আবদীন ফারুক মেয়েকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি বানানো, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিনি এখন প্রায় এক ঘরে হয়ে পড়েছেন।

জানা যায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মফিজুর রহমানকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পছন্দ করলেও জয়নুল আবদীন ফারুকের রোষানলে পড়ার ভয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে কাজী মফিজের হয়ে মাঠে অবস্থান নিচ্ছেন না। কারণ জয়নুল আবদীন ফারুক বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। কেন্দ্রে তার একটি অবস্থান রয়েছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে বর্তমান এমপি মোরশেদ আলম ১৯৯৬ সালে বেগমগঞ্জ থেকে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করে নোয়াখালী-২ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় নেতাকর্মীরা আশা করেছিলেন তিনি দলকে সংগঠিত করবেন। ৭৩ এর পর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ এ আসনে ক্ষমতায় না থাকায় এলাকাটি মূলত আওয়ামী বিরোধীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। কার্যত এ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের শক্ত কোনো ভিত্তি ছিল না। নেতৃত্বের সংকট ছিল। কিন্তু মোরশেদ আলম সাংগঠনিকভাবে দলকে না গুছিয়ে তিনি কিছু অসাংগঠনিক ব্যক্তির বলয়ে আবদ্ধ হয়ে যান। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার কাছে ঘেষার সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। পুরো নির্বাচনী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মোরশেদ আলমের দূূরত্ব এতই বেড়ে যায় যে, তার উপস্থিতিতে কোনো সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলে দলীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম দেখা যায়। তবে তিনি শিল্পপতি হওয়ায় এবং স্থানীয় এমপি হওয়ার কারণে নিজের ব্যক্তিগত তহবিল ও সরকারের দেয়া তহবিল দিয়ে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন।

Advertisement

অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ড. জামাল আহমেদ এফসিএ ২০০৮ সালে নোয়াখালী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। নৌকা প্রতীকে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৬৭ হাজার ৪৯৭ ভোট। আর জয়নুল আবদীন ফারুক ধানের শীষে ভোট পেয়েছিলেন ৮৭ হাজার ৪৪৩ ভোট।

নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও তিনি এলাকা ছাড়েননি। নানাভাবে এলাকার উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর দেয়াসহ মুক্তিযোদ্ধারের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। অনেক শিক্ষিক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। সব সময় এলাকার সার্বিক উন্নয়নে তার অবদান ছিল। নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনিও দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। ভোটারদের নিয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভাসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের দিক নিয়ে সাধারণ জনগণ ও ভোটারদের অবহিত করছেন। অনেকটা পরিচ্ছন্ন ও মেধাবী রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সকলের কাছে সুপরিচিত। ফলে এ আসনে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

আওয়ামী লীগ থেকে আরেক মনোনয় প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক। তিনি প্রতি সপ্তাহে এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সভা সমাবেশ করছেন।

দলের মনোয়ন প্রত্যাশী আরেক নেতা হলেন আলহাজ জাফর আহাম্মেদ চৌধুরী। তিনি ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তার দলের প্রার্থী মওদুদ আহমেদের সূচনীয় পরাজয় ঘটে। সেই নির্বাচনে জয় লাভ করেন বিনপির প্রার্থী জয়নাল আবদীন ফারুক। এতে মওদুদ আহমেদের সঙ্গে জাফর চৌধুরীর বিরোধ দেখা দিলে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি নোয়াখালী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।

এ দিকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক লায়ন জাহাঙ্গীর আলম মানিক দীর্ঘ দুই দশকেরও অধিক সময় আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সক্রিয়। তিনি এলাকায় দান অনুদানসহ নানাবিধ সামাজিক কাজে জড়িত আছেন। আগামী নির্বাচনে তিনিও মনোনয় চাইবেন বলে জানা গেছে।

মিজানুর রহমান/এমএএস/এমএস