শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামার পর থেকে কিছু শঙ্কা-সম্ভাবনা, ধারণা-জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খেয়েছে বিভিন্ন মহলে। সেগুলোর বেশিরভাগই বাস্তব হয়েছে। এরা বেদম মার খাবে-এ শঙ্কাটা ফলেছে বেশি। সেইসঙ্গে স্পষ্ট হয়ে গেছে ছোটদের চিন্তা-চেতনার কাছে বড়দের অকেজো হয়ে যাওয়ার বার্তা। এই ফাঁকে ক্ষমতাবান-দায়িত্ববানদের সজ্ঞানে-অজ্ঞানে, চেতনে-অবচেতনে, মুখ ফসকে-ঠোঁট পিছলে, বেখেয়ালে চরিত্রের দুর্বল দিক তো প্রকাশ পেলোই। যদিও তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না।
Advertisement
এই শিশু-কিশোর আন্দোলন নিয়ে চুমু খাওয়া, হাসি দেওয়া, তাচ্ছিল্য করার ক্যারিশমা তারা দেখালেন। তা সবাই পারে না। বিশেষ করে চুমু খাওয়া বা দাঁত কেলিয়ে হাসার যোগ্যতা সবার থাকেও না। বাসী ইস্যু চুমুকে হঠাৎ তাজা করে আবার সটকে গেলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের হুমকি দিতে গিয়ে চুমু টেনে আনলেন তিনি।
‘আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা করলে আমরা কি চুমু খাব?’-এভাবেই তিনি বলেছিলেন কথাটা। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্মদিন উপলক্ষে রবিবার সকালে বনানীতে তাঁর কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের দিকে গুলি করতে করতে আসবে, তাদের বলপ্রয়োগ না করে কি চুমু খাবে?’
সড়ক-পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর ‘চুমু’ বেশ গুরুত্ব পায় সংবাদমাধ্যমে। টেলিভিশন এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে তা জম্পেশ শিরোনাম হয়। মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয় বিভিন্ন মহলে। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মতো দেরি করেননি তিনি। এ জন্য কারো ক্ষমাপ্রার্থনা বা দুঃখপ্রকাশের দাবি পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। ল্যাঠা লাগার আগেই পরিস্থিতি বুঝে ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই ইউটার্ন দেন ওবায়দুল কাদের।
Advertisement
বিকালেই দুঃখপ্রকাশ করেন সকালের বক্তব্যের জন্য। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে চুমু খাওয়া বিষয়ক মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘যদিও রাজনীতিতে এ ধরনের শব্দ ব্যবহারও হয়, কিন্তু কেউ আমার কাছে আশা করে না। তা আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এ বক্তব্যে কেউ কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত’।
বাদবাকি অন্যান্য বক্তব্যে তিনি অটল থাকেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে এক কর্মীর সঙ্গে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর টেলিফোন আলাপের বিষয়ে যথারীতি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন ওবায়দুল কাদের। তার ভাষায়: অবশেষে থলের বিড়াল মিউ করে বেরিয়ে পড়েছে। বিএনপি অরাজনৈতিক একটি আন্দোলনকে রাজনৈতিক রং, রূপ দিতে চলেছে। আর মির্জা ফখরুল ইসলাম সেই বক্তব্যে সমর্থন দিয়ে প্রমাণ করলেন, শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক আন্দোলনকে ঘিরে বিএনপির ষড়যন্ত্র রয়েছে। তিনি বলেন, এটি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়।
বিএনপি ও তার দোসর সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামায়াত একেকবার একেক আন্দোলনের ওপর ভর করছে। কোটা আন্দোলনে সুবিধা করতে না পেরে বিএনপি এখন শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনে সওয়ার হয়েছে। বেশ গাম্ভীর্য ও ভারিক্কির সঙ্গেই তিনি বলেন কথাগুলো। মাত্র ক’দিন আগেও যেভাবে আবৃত্তিভরা বক্তব্যের সময় আয়েসি হাসি দিতেন তেমনটা করেননি। গত কয়েকদিন করছেনও না। এমনকি নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানও সেদিনের ঘটনার পর থেকে হাসি দূরে থাক দাঁত দেখানোও স্থগিত করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে হাসিমাখা তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ায় শাজাহান খানকে ভর্ৎসনা ও সতর্ক করার পর থেকে অন্যমন্ত্রীদেরও সাবধান হয়ে যাওয়া লক্ষণীয়। মোটাদাগে সবাই অন্তত হাসির ব্যাপারে সংযমী।
Advertisement
এরমাঝেই জেদের মারে চুমু টেনে আনেন চালাক-চতুর মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নগদে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি সামলে ফেলেছেন আশা করা যায়। তবে, রেশ থেকেই যাচ্ছে। নানান ঘটনা ও ইস্যুর হাটে সপ্তাহ দুয়েক আগে ‘চুমু’ আচমকা একটা কিউট ইস্যু হয়েছিল টিএসসি চত্বরে প্রকাশ্যে এক যুগলের চুমু ভাইরাল হওয়ায়।
এ নিয়ে বেশি ঝড় ওঠে ফেসবুকে। এ উছিলায় ফ্রেঞ্চ কিস, এস্কিমো কিস, লিপ কিস, ম্যারাথন কিস, স্পাইডারম্যান কিস, লিপ গ্লস কিস, লিজি কিস কতো কিসের কথা জানান দেন চুমু এক্সপার্টরা। নচিকেতার 'প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ, ঘুষ খাওয়া কখনোই নয়’ শীর্ষক গানটি আবার বাজানো শুরু হয়। হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত লেখা ‘এইদেশে প্রাকাশ্য কাউকে চুমো খাওয়া যায় না। কিন্ত প্রকাশ্য খুন করা যায়। সমাজ প্রকাশ্য চুমুকে নিষিদ্ধ করে। কি হিংস্র অসভ্যদের সময়ে আমাদের জন্ম’-ও নতুন করে আওড়ানো শুরু হয়।
চুমু কি খাওয়ার জিনিস?-এ প্রশ্নও পুনর্কচলানো বাদ যায়নি। আর যদি খাওয়ার মতো কিছু হয়েও থাকে সেটা পটেটো ক্রেকার্সের সেই ঐতিহাসিক বিজ্ঞাপনের মতো। 'একা একা খেতে চাও তবে দরজা বন্ধ করে খাও'। এটা মোটেই প্রকাশ্যে খাওয়ার আইটেম নয়।
চিকিৎসা শাস্ত্রে চুমু না-কি একধরনের বিদ্যা। চুমু বিদ্যাকে বলা হয় 'ফাইলম্যাটোলজি'। চুমুতে ভয় পাওয়াদেরকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘ফাইলম্যাটোফোবিয়া' রোগী। যারা নিজে না খেলেও অন্যের চুমু দেখতে পছন্দ বা ছবি ভাইরাল করে তাদের রোগের নাম ফাইলম্যাটোজেলাসোবিয়া।
এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, '৬৬ শতাংশ যুগলই চুম্বনের সময় নিজেদের চোখ বন্ধ রাখে। ভালো-মন্দ, আলো-আঁধার বোঝার ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। এ সময় তাদের মস্তিষ্কের নিওকোরটেক্সের একটি অংশ কাজ না করায় তারা আশপাশের কাউকে দেখে না। সেদিন টিএসএসসিতেও ওই যুগলের এমন কিছুই হয়েছিল। আর সেই সুযোগটি নিয়েছে ফটোগ্রাফার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, কলাভবন, কার্জন হল, এনেক্স বিল্ডিং, লেকচার থিয়েটারের চিপাচাপা এবং লম্বা করিডোরসহ কয়েকটা স্পটে নির্জন সময়ে চুমু খাওয়া ওপেন সিক্রেটের মতোই। এসব স্পট অনেকে এড়িয়ে চলেন। অনেকে মজা নিতে ঢুঁ মারেন। আর কেউ কেউ তা ওই ফটোগ্রাফরের মতো ব্যবহার করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সব ঐতিহ্যের মত এ বিশেষায়িত স্পটের ঐতিহ্যও প্রাচীন। টিএসসি'র বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরের ফুটপাতে বসে প্রকাশ্যে চুম্বনরত জুটির একটি ছবি ভাইরাল হওয়ার পর কারো কারো প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়, এটা তাদের অজানা। অদেখা। চিন্তার বাইরের। এর আগে জাতি যেনো জানতোই না চুমু কি! ভাবটা এমন যেন এইমাত্র এটা জেনে আকাশ থেকে পড়লেন তারা।
সেই ঠুনকা ইস্যু বাসী হওয়ার পর ওবায়দুল কাদেরের হুঁশিয়ারিমূলক মন্তব্য ও দুঃখপ্রকাশের মধ্য দিয়ে জাতি যেন আবার জানলো, চুমু একটা খাদ্যপণ্য। তফাৎ শুধু রকমফেরে। প্রয়োগে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে কিছুদিন নানান ফরমেটে এই চুমু খেয়েছে রাশেদ, নূর, ফারুকরা। কিছুদিনের ব্যবধানে আবার চুমু খাওয়া-খাওয়ির পর্ব। এই কিসিং ফিকচারে গত ক’দিন অন্যরকম চেহারা রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে উত্তরা, শনিরআখড়া থেকে মিরপুর। গাম্ভীর্য্যের সঙ্গেই চলছে এ কায়কারবার। যোগ হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগসহ গুজবের ছড়াছড়িও।
গুজব ও উস্কানির জন্য মামলা রিমান্ড বরাদ্দ হলেও হামলার জন্য চুমু আর হাসি ছাড়া কিছুই বরাদ্দ হয়নি। হেলমেট বাহিনীর কৃতি সন্তানরা শিশুদের পাশাপাশি প্রকাশ্যে চুমিয়েছে সমাজের আরেকটি নিরীহ শ্রেণির সদস্য সাংবাদিকদেরও। এ পিটুনির সময় সাংবাদিকদের আচানক বৈশিষ্ট্য বেশ পর্যবেক্ষণ করার মতো।
এক সাংবাদিকের উপর নির্মম হামলা করে ৬/৭ সন্ত্রাসী। অদূরে দাঁড়িয়ে দুই ডজন সাংবাদিক সেটার ছবি তোলেন। সহকর্মী মার খাচ্ছে আর বাদবাকিদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যস্ততা। কারো কারো দূর থেকে আহ- উহ, ইস-ফিস। সাংবাদিকদের এভাবে পিটানোর বিষয়ে তাদের বিভিন্ন পেশাগত ইউনিয়ন-ইউনিটি, ক্লাবের প্রতিক্রিয়া বড় ক্ষীণ। অনুভূতি একদম ভোঁতা। সাংবাদিকদের এ সংগঠনগুলোতে ইলেকশন-সিলেকশন নিয়ে যত এন্তেজাম হয় এক্ষেত্রে তার ছিটাফোঁটাও নেই।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সাংবাদিকরা কোন পক্ষ নয়। তারা কেবল ঘটনার সংবাদ সংগ্রহকারী। তারপরও তাদের উপর বর্বরোচিত হামলা, যার সচিত্র দৃশ্য সবাই দেখেছে। হামলাকারীদের চেহারাও স্পষ্ট। বেশ চেনাজানা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সবলমতি সাংবাদিকদের যারা পিটিয়েছে তাদের ছবি কম-বেশি প্রকাশ হয়েছে। চুমু উচ্চারণকারী মন্ত্রী, এক সময়ের সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের সাফ জানিয়েছেন, এরা তাদের ছাত্র, যুব, শ্রমিক কোনো লীগের কেউ নয়। এরপরও কারো কাছে প্রমাণ থাকলে নাম দিতে বলেছেন। কী তামশা! সব ফকফকা! ভেরি সিম্বোলিক সিন-সিনারি!
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর