দেশজুড়ে

‘বেওয়ারিশ রোগী আর আমার স্বামীর মধ্যে পার্থক্য ছিল না’

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের অন্যতম নায়ক ছিলেন কুমিল্লার চান্দিনার তৎকালীন পুলিশ সার্জেট হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া। গত ১৭ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীতে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না পারলেও এরই মধ্যে স্ত্রী ইয়াসমিন জুয়েল জানতে পেরেছেন, যথাযথ চিকিৎসা পেলে হয়তো তার স্বামীকে বাঁচানো যেত।

Advertisement

শনিবার জাগো নিউজের কুমিল্লা প্রতিনিধির সঙ্গে শহরের বাসায় একান্ত আলাপচারিতায় এসব ক্ষোভের কথা বলেছেন ইয়াসমিন জুয়েল। এছাড়াও স্বামীর চাকরি জীবনের নানা স্মৃতি, ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের সাফল্য, কর্মস্থলে হয়রানি, ৬ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি ফিরে পাওয়া, পদোন্নতি এবং পিপিএম পদক লাভের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন তিনি।

জাগো নিউজ : দুর্ঘটনার দিন সর্বশেষ কখন হেলালের সঙ্গে আপনার কথা হয়?

ইয়াসমিন জুয়েল : কুমিল্লা শহরের বাসায় আমরা একসঙ্গে ঈদ করি। দুর্ঘটনার দিন মায়ের সাথে দেখা করতে সে কুমিল্লার চান্দিনায় গ্রামের বাড়িতে যায়। সেখান থেকে দুপুরের দিকে প্রাইভেটকারে চট্টগ্রামে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দিয়ে কয়েকবার কথা হয়। ফেনীতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ার পর তার মোবাইলের ডায়াল কল থেকে সম্ভবত পুলিশ প্রথম আমার চাচা শ্বশুর এবং পরে আমাকে কয়েকবার কল করে। কিন্তু দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর সে আর মোবাইলে কথা বলতে পারেনি।

Advertisement

দুর্ঘটনার পর হেলাল নিজেই গাড়িতে থাকা তার পরিচয় পত্র, মানি ব্যাগ ও অন্যান্য কাগজপত্র বের করে আনতে বলে। তখন পুলিশ ও অন্যান্যরা তার মোবাইল দিয়েই আমাদেরকে কল করে জানিয়েছিল সে ভালো আছে, ডান পায়ে গুরুতর জখম পেয়েছে। বুকে সামান্য ব্যথা। কথা বলতে পারছে। তবে রক্তের দরকার। এ সময় তার রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজেটিভ বলে আমি জানাই।

জাগো নিউজ : ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করার কথা কখন জানানো হলো?

ইয়াসমিন জুয়েল : এরই মধ্যে আমি আমার এক মাত্র ছেলে, দেবর ও চাচা শ্বশুরকে নিয়ে ফেনী যেতে কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে চলে যাই। তখন ফেনী থেকে পুলিশ জানায় ‘হেলাল কে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে, পা রক্ষা করতে হলে পায়ের অপারেশন লাগবে।’ তখন আমি পুলিশকে জানাই ‘ওকে বাঁচাতে যা যা দরকার করুন, যতো টাকা দরকার আমি দেব, আপনারা চিকিৎসার অবহেলা করবেন না, টাকার সমস্যা হবে না।’

এরপর সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ওর জন্য আমাদের টেনশন ক্রমেই বাড়ছিল। আমরা তো বার বার কল করে ফেনী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। পরে বেসরকারি একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হয়। তাতে ছিল না অক্সিজেনের ব্যবস্থা, ছিল না সাইরেন। হেলালের পা থেকে অনেক রক্ত বের হলেও তাকে রক্ত দেয়া হয়নি। একটি স্যালাইন পুশ করে এবং সঙ্গে ফেনী পুলিশ লাইনের কনস্টেবল হুমায়ুন কবিরকে অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে পাঠানো হয়। দুর্ঘটনার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর বিকেল ৪টার দিকে জরাজীর্ণ অ্যাম্বুলেন্সটি কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে আসার পর আমি, আমার ছেলে, দেবর (হেলালের ছোট ভাই) সাইফুদ্দিন ভূইয়া ও চাচা শ্বশুর বশির আহাম্মদ এতে উঠি।

Advertisement

জাগো নিউজ : অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার পর কী অবস্থা দেখলেন হেলালের?

ইয়াসমিন জুয়েল : হেলাল কথা বলতে পারছিল না, তবে কথা বলার চেষ্টা করছিল। কী যেন বলতে চেয়েছিল। ডান পা থেকে রক্ত ঝরছিল। ওই পা মিথ্যা অস্ত্র মামলায় গ্রেফতারের সময় ভেঙে দেয়া হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে এসি ছিল না। তাই প্রচণ্ড গরমে হেলাল হাত দিয়ে বার বার যেন জানালা খুলতে চেয়েছিল। তখন আমরা জানালা খুলে দিয়ে হাতের কাছে যা ছিল তা দিয়ে বাতাস দেয়ার চেষ্টা করি। কুমিল্লায় পৌঁছার আগে ফেনী থেকে পুশ করা স্যালাইনও ততক্ষণে শেষ হয়ে যায়। তখন তার অস্থিরতা দেখে আমার চিন্তা হয় কুমিল্লার কোনো আইসিইউ সমৃদ্ধ হাসপাতাল কিংবা সিএমএইচে নেয়া যায় কি-না। কিন্তু তখনো ঢাকা থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা হেলালকে পঙ্গুতে নেয়ার জন্য বার বার মোবাইলে তাগাদা দিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তখন মুখে একটু পানি দিতেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হয়তো আমাদের সাথে শেষ দেখা করার জন্যই সে কুমিল্লা পর্যন্ত বেঁচে ছিল।

জাগো নিউজ : এরপর কী করলেন? ইয়াসমিন জুয়েল : হেলালের নিথর ঠান্ডা দেহের পাশে আমি ও আমার ছেলে বসে ছিলাম। হেলাল আর নেই জেনেও শেষ সান্ত্বনাটুকু পেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় মাগরিবের আযানের সময় ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছি। ততক্ষণে পুরো আকাশ যেন মাথায় ভেঙে পড়েছে। বাসা থেকে মেয়ে বার বার বাবার খবর জানতে চাচ্ছিল। হেলাল তার মেয়েকে খুব আদর করতো। তাকে ডাক্তারি পড়াবে বলে স্বপ্ন ছিল। আত্মীয়দেরকে হেলালের মৃত্যুর খবর বার বার বলতে বলতে এক সময় আমার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না।

জাগো নিউজ : হেলালের মৃত্যুর জন্য কেন চিকিৎসায় অবহেলা বলে মনে করছেন?

ইয়াসমিন জুয়েল : যারা হেলালের মৃতদেহ দেখেছে তারা সবাই একই কথা বলছে। আমি গত বৃহস্পতিবার ফেনীতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। ফেনীতে ‘এ’ পজিটিভ রক্তের ডোনার খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ছিল না। অনেক পুলিশ রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু আমার স্বামীর পরিচয় জানার পরও তার যথাযথ চিকিৎসার উদ্যোগ না নিয়ে একটি ভাঙা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তাকে তড়িঘড়ি করে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু এ সময় হেলালের রক্ত ও অক্সিজেন প্রয়োজন থাকলেও তা দেয়া হয়নি। রাস্তায় পড়ে থাকা বেওয়ারিশ রোগীর মতো একটি স্যালাইন দিয়েই ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ আমার স্বামীকে বাঁচাতে হেলিকপ্টার কল করা, ফেনী কিংবা কুমিল্লার আইসিইউ সমৃদ্ধ প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা সিএমএইচে রেফার্ড করা যেতো। একজন বেওয়ারিশ রোগী আর আমার স্বামীর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না।

এখন ফেনী পুলিশ ডাক্তারদের দুষছে। পুলিশ বলছে ‘হেলালের অবস্থা বিচেনায় ডাক্তাররা যে পরাপর্শ দিতো ফেনী পুলিশ তাই করতো।’ ফেনী হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে একটি স্যালাইন দিয়ে রোগীকে ঢাকায় রেফার্ড করা কি ডাক্তারদের ঠিক হয়েছে।

জাগো নিউজ : হেলালের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন

ইয়াসমিন জুয়েল : ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল যেদিন ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল, সেদিন রাতভর সে বাইরে কাজ করেছে। আমাদের বাসা ছিল সিইউএফএল ঘাটে সরকারি কোয়াটারে। সকালে কয়েক মিনিটের জন্য সে বাসায় এসেছিল। এক গ্লাস পানি খেয়ে চলে যায়। ময়লা পোশাক পরিবর্তন করতে বলেছিলাম। কিন্তু সে বললো আজ দেশের জন্য এতো বড় কাজ করেছি, পোশাক দিয়ে কি করবো। সারাদিন টিভিতে অস্ত্র উদ্ধারের খবর ছিল। তখন আমার খুব ভালো লেগেছে।

কিন্তু উল্টো অনুভূতিও কম নয়। অস্ত্র উদ্ধারের এক বছর পর ২০০৫ সালের ২০ আগস্ট ফেনীর সুধারাম থানায় মিথ্যা একে-৪৭ অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তার সামনে অস্ত্র রেখে টিভিতে বার বার দেখাচ্ছিল এবং পরদিন পত্রিকায় ছবিসহ খবর প্রকাশ হয়। সাংবাদিকরা সেদিন যাচাই-বাছাই না করেই ওই মিথ্যা খবরটি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। তখন হতাশ হয়েছি। অনেক কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু সে (হেলাল) ভেঙে পড়েনি। সুধারাম থানায় এবং পরবর্তীতে ২ বছর কারাগারে থাকার সময় দেখা করতে গেলে সে বলতো ‘আমি দেশের জন্য কাজ করেছি, এটাই অপরাধ, একদিন ন্যায় বিচার পাবই, একজন হেলাল মরে গেলেও কষ্ট নেই, ১০ ট্রাক অস্ত্রে তো অনেক মায়ের সন্তানই মারা যেতে পারতো, আমি মরে গেলেও দুঃখ করো না,আমার সন্তানদের আমার আদর্শে মানুষ করবে।’

২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট থেকে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর সার্জেন্ট হেলালের জীবনে ছিল চরম ক্রান্তিকাল। সাসপেন্ড হওয়ায় তার অর্ধেক বেতন পেতাম। রেশনও বন্ধ করে দেয়া হয়। হেলালের বড় অপরাধ ছিল সে কেন ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক করলো। অবস্থা এমন ছিল যেন ‘তাকে মেরে ফেলতে পারলেই কেউ কেউ শান্তি পায়।’ কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার পুনরায় তদন্ত শুরু হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনিরুজ্জামান চৌধুরী তার তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ১০ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যে কোনো একে-৪৭ রাইফেল ছিল না। সার্জেন্ট হেলাল ও সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে যে একে-৪৭ রাইফেল রাখার দায়ে অস্ত্র মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে তা ছিল সাজানো। পরে সিআইডির এ রিপোর্টের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩তম সভায় দুই সার্জেন্টের নাম অস্ত্র মামলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। দুই বছর চারমাস বন্দী থাকার পর ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনের আদেশ দিলে ১৩ নভেম্বর নোয়াখালী কারাগার থেকে জামিনে বের হন হেলাল।

২০১০ সালের দিকে সুধারাম থানার মিথ্যা ও সাজানো অস্ত্র মামলায় অব্যাহতি পাওয়ার পর ২০১১ সালের ৮ আগস্ট চাকরি ফিরে পান হেলাল ও তার বন্ধু আলা উদ্দিন (যিনি ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের সময় হেলালের সাথে ছিলেন, বর্তমানে ফেনী পুলিশ লাইনে রেশন স্টোরের পরিদর্শক)। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার ১০ বছর পর ২০১৪ সালে হেলাল ও আলা উদ্দিন প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) লাভ করেন। ২০১৫ সালের দিকে হেলাল পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান।

জাগো নিউজ : সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

ইয়াসমিন জুয়েল : এই সরকারই তো হেলালকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে চাকরি ও সন্মান। যেদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে হেলালকে পিপিএম পদক পরিয়ে দেন, সেদিন আমি সেখানে ছিলাম। সেদিন আমরা সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম। তাই এই সরকারের কাছে শুধু এটুকুই চাইব হেলালের মতো কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। তার চিকিৎসার অবহেলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

এফএ/এমএস