মতামত

মৃতপ্রায় নদ- নদীগুলোর প্রাণ সঞ্চার হোক

 

কালের বিবর্তনে প্রিয় মাতৃভূমি আজ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। অসংখ্য নদ- নদীর সমন্বয়ে গড়ে উঠা বাংলার জনপদ তার চিরচেনা সেই রুপ হারিয়ে যাত্রা শুরু করেছে ভিন্নপথে। হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির সাথে কী অপরুপ মিল ছিল এইসব নদ-নদীর। বাঙালীর জীবন-যাত্রায় ভীষণভাবে জড়িয়ে থাকা এই নদ- নদীকে কেন্দ্র করে এখানে-ওখানে গড়ে ওঠেছে হাজারো স্কুল- কলেজ, বাণিজ্যকেন্দ্র। দেশের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত্রে যোগাযোগ, সব ঐ নদ- নদীকে কেন্দ্র করেই। পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত করা গেছে সহজে এবং কম খরচে।

Advertisement

সভ্যতার ঘোড়াপত্তন যেমনটা হয়েছিল নদীকে কেন্দ্র করে, তেমনি বাংলা অঞ্চলের সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল নদ- নদীকে ঘিরেই। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছিল আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা। বিশেষত ধান, মাছ, সবজী উৎপাদন সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে এই নদীরই বদৌলতে। আমরা আজ যে ইলিশ মাছ নিয়ে গর্ব করি তা কিন্তু এই নদীরই দান। আর একটি কথাতো বহু বছর ধরে প্রচলিত আছেই যে, আমরা মাছে ভাতে বাঙালী। যদিও নদীর সাথে সাথে আমাদের সে ঐতিহ্যও আজ হারাতে বসেছে।

যেসব নদ- নদীর সংস্পর্শে এসে এদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, সেসব নদ- নদীই আজ হারিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত প্রায় তিন দশকে অসংখ্য নদ- নদী দেশের মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর এই বিলীন হওয়া যতটা না প্রাকৃতিক কারণ, তারচেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট। মানুষ তার হীন স্বার্থে একের পর এক নদ- নদীগুলোকে হত্যা করছে। আজকে আমাদের দেশে নদী হত্যা যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশের সীমানার মধ্যে এমন কোন নদী নেই যেখানে ভূমিখেকো দস্যুর দলের হাত পড়েনি। পদ্মা থেকে মেঘনা, করতোয়া থেকে ইছামতি, নরসুন্দা থেকে ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যা সর্বত্রই যেন চলছে দখলের মহোৎসব।

কখনও বালু ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ, কারখানার বর্জ্য, পলিথিন, প্লাস্টিক জাতীয় আবর্জনা ফেলে পানি দূষণ, বালু ভরাটসহ অপরিকল্পিত নদীশাসন ও বাঁধ নির্মাণের ফলে নদ- নদী গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

গত ২২ এপ্রিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে আমরাও পালন করেছি ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’। পরিবেশ সম্পর্কে পৃথিবীজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যেশ্যে দিবসটি দেশে দেশে পালিত হয়। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্লাস্টিক দূষণ থামাও’। প্রতি বছরে এই দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে আমরা যদি সত্যিকার অর্থে সচেতন হয়ে উঠতাম, ভালোবাসতাম প্রকৃতিকে তাহলে হয়তো নিত্য একের পর এক নদ- নদী হত্যার সংবাদ আমাদের শুনতে হতো না। দেখতে হতো না কোন নদীর মৃত্যু।

‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’-র তথ্য বলছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাংলাদেশের নদীর পানি৷ দূষণের ভয়াবহ শিকার শহরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলো৷

অপরিকল্পিত নদীশাসন, বাঁধ নির্মাণ, বড় নদীগুলোর সাথে ছোট ও শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া, ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশের বেঁচে থাকা নদীগুলোও হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত থেকে নদীর পানিপ্রবাহ আটকে দেয়ার কারণেও নদীমৃত্যু ঘটছে।

সংবাদপত্রসূত্রে খবর, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। ২০ বছর আগেও মৃত নদীর সংখ্যা ছিল যার প্রায় অর্ধেক। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা অ্যাকশন এইডের তথ্যমতে, গত একশ বছরের মরে গেছে প্রায় ৭০০ নদী!তবে এর বাইরে অন্যান্য পরিসংখ্যান ও সূত্র বলছে,বাংলাদেশে ছোট-বড় নদী রয়েছে ৫০০টির ও অধিক। এর মধ্যে ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক সীমারেখার সাথে যুক্ত। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টির উৎসস্থল ভারত এবং বাকি ৩টির মিয়ানমার।

Advertisement

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ নাব্য হারিয়েছে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস-সিইজিআইএস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ছোট ছোট আরো শত শত নদীর হিসাব না পাওয়া গেলেও গত ৪০ বছরে শুধু তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতেই এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। প্রতিবছর কোন না কোন নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এই কারণে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত কিংবা পাহাড়ী ঢলের কারনে অতিরিক্ত পানি নদীতে জায়গা না পাওয়ায় বন্যার সৃষ্টি হয়।

এককালের স্রোতস্বিনী নদ-নদী করতোয়া, ইছামতি, বড়াল, মুসাখান, চিকনাই, ভৈরব, ভদ্রা, হিসনা, কালীগঙ্গা, কুমার, চিত্রা, হরিহর, বিবিয়ানা, বরাক, ভূবনেশ্বর, বুড়িনদী, বামনী, পাগলা, ফকিরনী, মাথাভাঙা, নবগঙ্গা, ফটকি, মুক্তেশ্বরী, মাসামকুড়া, পয়রাডাঙা, চাকিরপশা, কোটেশ্বর, ভক্তি, চাতলা, দেউল, বামনডাঙ্গা, সরমংলা ময়নাকাটাসহ আরো অনেক নদী হারিয়ে গেছে।

১৯৬৫ হতে ১৯৬৭ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডের নদী বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় নদী জরিপ করে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় এবং ১৯৭৫ সনে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক প্রকাশিত মাইলেজ টেবিল এবং ১৯৮৮-৮৯ সনে পুনরায় সমীক্ষা রিপোর্ট ও বর্তমান বিভিন্ন তথ্যসূত্র বলছে, বর্তমানে ১১৭টি নদ-নদীর বেশকিছু সম্পূর্ণ মৃত, কোনটির অংশবিশেষ মৃত এবং অধিকাংশ নদীর নাব্য আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

মানুষের অমানবিক কাজের কারণে নদ-নদীগুলো আজ মরে যাচ্ছে। পানির সংকটের ফলে নদীপাড়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারাচ্ছে। মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে ধানসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনে। বলা যায় নদীর মৃত্যুতে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, খাল, নদ- নদী বাঁচানো না গেলে আমাদের কৃষি-অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

এসব থেকে রক্ষা পেতে হলে, চারদিকে নদ- নদী দখল ও দূষণের যে মহোৎসব চলছে তা বন্ধ করতে হবে। গ্রীষ্মকালে নদীগুলোর পানি শূন্যতা দূর করতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে যৌথ আলোচনা চালাতে হবে। প্রাপ্ত পানির নেয্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনকে কার্যকর করতে হবে।

নদী বাঁচাতে গবেষণায় জোর দিতে হবে। নদী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নদী রক্ষার কাজে উদ্যোগি হতে হবে। এ ব্যাপারে সরকাকে আরো দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ জনগণকে। সর্বোপরি নদী রক্ষায় সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে উদ্যোগী হতে হবে।

আমরা চাই আমাদের নদ- নদীগুলি বেঁচে উঠুক। প্রাণের সঞ্চার ঘটুক প্রতিটি নদ- নদীতে। বাংলাদেশ হয়ে ওঠুক সত্যিকারের নদী মাতৃক দেশ। আর কোন বিলম্ব নয় নদী বাঁচাতে এখনই নেয়া হোক কার্যকর উদ্যোগ। মনে রাখতে হবে, যদি নদী বাঁচে, তবেই বাঁচবে প্রাণ।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস