১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল শেষ রাতে কলকাতা প্রেস ক্লাব এবং হোটেল পার্কের সামনে থেকে কলকাতায় অবস্থিত ২০/২৫ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার নিয়ে আমাদের এক অজানা উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। মুজিবনগর সরকারের তথ্য, সম্প্রচার ও বেতার অধিদপ্তরের পরিচালক (পরবর্তীতে চরমপত্র খ্যাত) এম আর আখতার মুকুলসহ আমি এবং আমাদের ফটোগ্রাফার আলমসহ আমরা তাদের সহযাত্রী হলাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের পক্ষ থেকে সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কভার করার জন্য সেটা ছিল আমার প্রথম সরকারি assignment. ২টি বাস ও কয়েকটি জীপে পশ্চিমবঙ্গের যশোর রোড হয়ে কুষ্টিয়া সীমান্ত পার হয়ে সূর্য ওঠার আগেই আমরা মেহেরপুর মহকুমার কাছাকাছি পৌঁছলাম।
Advertisement
সেখানে যাবার পর জানতে পারলাম যে, কাছাকাছি কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি অনুষ্ঠান হবে। তখনও আমাদের প্রেস টিমের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে, ১৭৫৭ সালের ২২ শে জুন পলাশীর আম্রকাননে বাঙালির যে স্বাধীনতার সূর্য পশ্চিম গগনে অস্তমিত হয়েছিল, তার থেকে কিছু দূরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সেই স্বাধীনতার সূর্য আবার পূর্ব গগনে উদিত হবে। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে অর্থাৎ নির্দিষ্ট স্থানে যখন আমাদের প্রেস টিম পৌঁছালো তখন সেখানে দেবদারু পাতার তৈরি দুটি বড় বড় তোরণ দেখলাম। বঙ্গবন্ধুর হাতে আঁকা ছবি তোরণে ঝুলতে দেখলাম। কিছু দূরে দূরে মিত্র বাহিনীর এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট গান- এর পজিশন দেখলাম। এক ধরনের কমপক্ষে ৩০/৩৫টি এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট চোখে পড়ল। তবে আরও দূরে দূরে ভারতের মিত্র বাহিনীর বেশ কিছু ট্যাংকের পজিশন দেখতে পাওয়া গেল। তবে সেদিকে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের যাবার বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।
উল্লেখ্য যে, ১২ এপ্রিল যশোরের চূড়াডাঙ্গায় এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রথম সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কলকাতায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে তথ্য পেয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী চূড়াডাঙ্গায় ১২ এপ্রিল ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। ভারত সরকার সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকে মূলতঃ অন্ধকারে রেখে ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণের কার্যক্রম গ্রহণ করে। ব্যতিক্রম শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ১৫ এপ্রিল গভীর রাতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অবহিত করেন। বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার মাত্র আধা ঘন্টা পূর্বে জনাব মনসুর আলী, জনাব কামারুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী অবহিত করেন ও প্রায় তৎক্ষণাৎ জীপে তুলে নিয়ে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী সূত্র পরবর্তীতে প্রবাসী সরকারের মুখ্য সচিব আমার মামা রুহুল কুদ্দুসকে জানায় যে, বাংলাদেশের এমপি-দের অসর্তকতার ফলে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী চূড়াডাঙ্গার তথ্য জেনে যায়। সে কারণে, তাদেরকে অবহিত করা হয়নি বিধায় মেহেরপুরের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ২/১ জন এমপি ব্যতীত আর কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। অঘোষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মেহেরপুরের দেড়/দুই হাজার লোক সমবেত হয়েছিলেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে একজন শ্বেত শুভ্র শশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধকে দেখলাম শোকাশ্রু “নয়ন অথচ নির্মল হাসিমুখ। তাকে ঘিরে অনেকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছেন। আমিও ফটোগ্রাফার আলম তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে, তার কেমন লাগছে?
Advertisement
তিনি কোন উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে আসমানের দিকে দু’হাত উঁচু করে বঙ্গবন্ধুর নাম করে জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগলেন। আরবী দোয়ার পরে বাংলায় বললেন, “...হে আল্লাহ পরওয়ার দেগার, তুমি আমাদের কলিজার টুকরা শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের বুকে ফিরিয়ে দাও। সে আমাদের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙে আজাদ করে দিয়ে গেছে। হে পরওয়ার দেগার তুমি তাকে আজাদ করে দাও। আমরা তোমার জান্নাত চাই না। আমাদের জান্নাত, তোমার রহমান নামের নাম মুজিবুর রহমানকে আমাকে বুকে ফেরত এনে দাও।” তিনি মোনাজাত শেষ করে চোখ বন্ধ করে সকলকে বললেন, “আমার সাথে তোমরা সকলে তিনবার আমিন, আমিন, আমিন বলো।” সকলে বিমুগ্ধচিত্তে তার কণ্ঠে কণ্ঠস্বর মিলিয়ে আমিন বললো।
মেহেরপুরের সেই বৈদ্যনাথ তলায় একজন ছিন্ন বস্ত্রধারী সাধারণ কৃষাণীকে দেখলাম, এক কলসী কাঁখে গুড় এনেছে। সকলকে আদর সোহাগ করে ডেকে ডেকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। তার এই মিষ্টি খাওয়ানো দেখে অনেক হাসছিল! আমরাও কৌতুক মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকে দেখছিলাম। অবহেলায় তার নামটাও জিজ্ঞেস করিনি! কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর মনে কত আফসোস হয়েছে! নিজেকে কতবার অভিশম্পাত দিয়েছি!! স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে আজও মনে খেদ রয়ে গেছে আমাদের সেই মহান বঙ্গজননীর জন্য। ছিন্ন বস্ত্র, হালকা-পাতলা, লম্বা দেহী, কপালে ভাঁজ পড়া চামড়া, শ্যামল বরণও মলিন বেশ! কিন্তু নির্মল পুণ্যময় হাসিভরা মুখ! সকলকে আদর সোহাগ করে কাছে ডেকে ডেকে গুড় দিয়ে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে!
তথ্য মন্ত্রণালয়ে কুষ্টিয়ার একজন মুক্তিযোদ্ধা তথ্য অফিসার ছিলেন হাফিজা আপা। পরবর্তীতে মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। তাকে বহুবার বলেছি। তিনিও মেহেরপুরে কয়েকবার গিয়ে সেই পুণ্যবতী মহিয়সী মায়ের সন্ধান আমাকে দিতে পারেননি। নিজেকে অনুকম্পায় দলিত-মথিত করে আজ বলি, “বাঙালি জাতির তাজমহলসম বাংলাদেশের পুণ্যময় জন্মলগ্নে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় কাঁখে গুড়ের কলসী থেকে হাসিমুখে নিজ হাতে সেখানে উপস্থিত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে আদর সোহাগ ভরে গুড় দিয়ে মিষ্টি মুখ করাচ্ছিলেন..বাঙালির যে মহিয়সী জননী, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তোমার পরম স্নেহ-মমতার পুণ্যময় হাত যেন বাংলাদেশের ওপরে আশির্বাদের ছায়া হয়ে বিরাজ করে।
ততক্ষণে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা জানতে পারলেন যে, ২/৩ মিনিটের মধ্যে একটি নব জাতির জন্ম হতে যাচ্ছে এবং তাদের চোখের সামনে একটি ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সকাল ১০টার মধ্যে বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লোকে-লোকারণ্য হয়ে উঠল। তবে তাদের মধ্যে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যাই ছিল বেশি। সকাল ১১টার মধ্যে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী প্রমুখ এলেন আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ১৭ এপ্রিলের সকালে।
Advertisement
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে বিশেষ একটি ঘটনা এখানে আমি উল্লেখ করছি। মেহেরপুরের আম্রকাননে যে মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের একটি বড় ধরনের জমায়েত হতে যাচ্ছে, সেটা ১৬ এপ্রিল ভোরে সে এলাকার পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন এবং জামায়াত-মৌলবাদীরা কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিল। বিশেষ করে, ১৬ এপ্রিল শেষ রাতের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মিত্র বাহিনীর সামরিক যান, এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট এবং কয়েক ডজন ট্যাংকের গর গর শব্দের আওয়াজ পেয়ে তারা মেহেরপুর এলাকা ছেড়ে যেতে থাকে। সেই সাথে রটিয়ে দিয়ে যায় যে, মেহেরপুরে হিন্দুদের একটা অনুষ্ঠান হবে এবং সেখানে পূজা পার্বন হবে। সেখানে কোন মোমিন-মুসলমান যাওয়া হারাম। সেখানে গেলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। এই ফতোয়া পেয়ে এলাকার মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেম, মৌলভী, মাওলানা, ক্বারী, হাফেজ সব সকাল ৭/৮টার মধ্যে এলাকা ছাড়া হয়ে গেল। ফলে সকাল ১১টার দিকে যখন মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হবে, তখন সেখানে কোন ক্বারী, মৌলভী, মওলানা, হাফেজ, ইমাম, মোয়াজ্জেম বা কোন হুজুরকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
সেই ক্রাইসিসের মধ্যে সে অনুষ্ঠানে কে পড়বে পবিত্র কোরান শরীফ? অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কথায় আমি ভীড়ের মধ্য থেকে ১৭/১৮ বছরের তরুণকে খুঁজে পেলাম। সুদর্শন কলেজের ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র বাকের আলী। তার মিষ্টি গলা, সে ভারি ভালো ক্বেরাত পড়তো। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী অধ্যাপক ইউসুফ আলী সেই ছেলেটিকে আমার হাত থেকে নিয়ে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেনঃ “বাবা আল্লাহর নাম নিয়ে তুমি কোরান তেলাওয়াত করো। আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছেন- বাংলাদেশের পুণ্য জন্মলগ্নে আল্লাহর পাক কালাম তেলাওয়াতের জন্য।”
বাকেরের বাড়ি মহেশনগর, বৈদ্যনাথতলা থেকে পৌনে এক মাইল দূরে। সে এসেছিল দলে বলে মিশে, কণ্ঠে কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে। এখন তারই সুরেলা কণ্ঠধ্বনিতে কোরান শরীফ তেলাওয়াত করতে হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হবে পবিত্র কোরান শরীফ তেলাওয়াতের মাধ্যমে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” গাওয়া হলো। অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ করলেন। ২৬শে মার্চ ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করলেন। মঞ্চে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান এবং অর্থ মন্ত্রী জনাব মনসুর আলী শপথ গ্রহণ করলেন। এ সময় আকাশে একটু গুড় গুড় শব্দ শোনা গেল। যদিও সেটা মেঘের গর্জন ছিল এবং মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আশ-পাশ ঘিরে কয়েক মাইলব্যাপী ভারতের কয়েক শত এন্টি এয়ার ক্রাফ্ট এবং দম দম এয়ারপোর্টে ভারতের কয়েক ডজন মিগ ফাইটিং এয়ার ক্রাফ্ট প্রস্তুত হয়ে ছিল। তথাপি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী স্যার ‘হারি আপ’, ‘হারি আপ’ বলে উঠলেন। তার বলার অবশ্য কারণ ছিল।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের পর সেখানে তাদেরকে অভিভাদন জানানোর দায়িত্ব দেয়া ছিল মেজর ওসমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দলকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি ও তার বাহিনী অনুষ্ঠানস্থলে সময়মত পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে মেঘের মধ্য থেকে গুড় গুড় আওয়াজ শোনা যাওয়ায় শংকিত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী হুকুম দিলেন সেখানে উপস্থিত এস.পি. মাহবুবের নেতৃত্বে নব গঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানাতে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এস পি মাহবুব তৎক্ষণাৎ সেখানে যেসব আনসার ছিল, তাদেরকে নিয়ে তিনি সামরিক কায়দায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মঞ্চে দন্ডায়মান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের অভিবাদন জানানোর জন্য মার্চ পাস্ট করে মঞ্চের পাশ ঘেঁষে তাদেরকে সামরিক অভিবাদন জানিয়ে যান। মঞ্চে দন্ডায়মান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাঁর পাশে দন্ডায়মান প্রধানমন্ত্রী এবং তার পেছনে দন্ডায়মান প্রধান সেনাপতি মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্যে সেই অভিবাদন গ্রহণ করেন।
অভিবাদন শেষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কয়েক ডজন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে নব জন্ম লাভকারী জাতির কান্ডারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেনঃ “আজ এই আম্রকাননে একটি নূতন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বৎসর যাবত বাংলার মানুষ, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদারদেরকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই। আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন।
জাতির সংকটের সময় আমরা তাঁর নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নূতন রাষ্ট্রের সূচনা হল তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না। আপনারা জেনে রাখুন গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পাকিস্তানের স্বার্থবাদী শিল্পপতি পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রীরা। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা ঐ পশ্চিমারা শেরে বাংলাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। তাই ওদের সঙ্গে আপোস নেই, ক্ষমা নেই।
আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।”
শপথ গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ও দেশী বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে মুহুর্মুহু “জয় বাংলা” ও “জয় বঙ্গবন্ধু” ধ্বনির মধ্যে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে তথা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে তিনিও ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি বলেনঃ
“বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তাঁরা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা আকাঙ্খাকে সত্যিকার ভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন।”
বাংলাদেশের বুকে এহিয়া খানের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোন-মতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারী পশুর মত। তারা চালিয়েছে, হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা।
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারতো না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণ-হত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানে বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালীর রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়।”
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আরও বলেন, “হিটলারের পর গণহত্যার এমন জঘণ্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করেছিল। তারা যদি মনে করে থাকেন যে এতদ্বারা তাঁরা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তা’হলে তাঁরা ভুল করেছেন।
কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত। তাদের বুঝা উচিত যে পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নূতন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।”
তিনি সুস্পষ্ট করে আরও বলেন, “সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা’ আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাবো। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।”
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভস্ম ধ্বংসস্তুপের ওপর একটা নূতন দেশ গড়ে তোলা। এ একটা দুরূহ বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে। আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না।
এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না। আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না...আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারো তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।”
১৭ এপ্রিল দুপুর থেকে আকাশবাণী, বিবিসিসহ বিশ্বের গণমাধ্যম সমূহে যখন প্রচারিত হয়ে গেল যে, স্বাধীন বাংলার মাটিতে, মেহেরপুরে, স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হয়েছে ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এলো পাক হানাদারেরা মেহেরপুরের দিকে।
কিন্তু সেই মেহেরপুরের কেয়ামতের দিন এলো ২৭ এপ্রিল। পাক আর্মির বিরাট বাহিনী কামান ও অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে চূড়াডাঙ্গা-মেহেরপুর-মোনাখালী দিয়ে ঢুকে মহিষনগর, গোপালনগর, আনন্দবাগের দিকে বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতে ছুটে আসে। বৈদ্যনাথতলা, তথা মুজিবনগর ছিল মহেশনগরের আধা মাইলের মধ্যে। হানাদারেরা মোনাখালী থেকে আরম্ভ করে বৈদ্যনাথতলা পর্যন্ত ৮-১০ মাইলব্যাপী কামানের গোলা ও মেশিনগানের গুলি শিলাবৃষ্টির মতো বর্ষণ করলো। এ সব এলাকার বাড়ী ঘরে, আগুন লাগিয়ে দিলো। মেহেরপুর কোর্টে একটা এলাকায় কয়েক ডজন লোক জড়ো করে বড় গর্ত খুঁড়ে গুলি করে হত্যা করে তাঁদেরকে গর্তে ফেলে। তাদের মধ্যে চুড়াডাঙ্গার দারোগা আইয়ুবও ছিল। চূড়াডাঙ্গা রেল ষ্টেশন থেকে একটু দূরে তিন/চারটা ঘরে ধরে নিয়ে গিয়ে অনেককে সেখানে গুলি করে মারে।
যুদ্ধের পর সেখানে ঘরের মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে গেছে দেখা যায়। ঘরের দেয়ালে সব রক্ত ছিটিয়ে আছে। আনুমানিক ৫০/৬০ জন লোককে পাক হানাদাররা ২৭শে এপ্রিল চূড়াডাঙ্গার ঐ অভিশপ্ত ঘরে মারে। দরিয়াপুর গ্রামের ডাঃ শামসুল হুদার বাড়ীর কৃষককে আর বাচ্চাদের চুল চেপে ধরে, মাটিতে আছড়ে আছড়ে মারে পাকিস্তানি সীমারেরা।
আর সেই বেচারা বাহারউদ্দীনের ভাতিজা ১৭/১৮ বছরের বাকের, যার মিষ্টি কণ্ঠের কোরান তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার সূর্য বঙ্গ জননীর মুখে ১৭ এপ্রিলের সকালে প্রথম আলোক রশ্মি ফেলেছিল- তার ভাগ্যে কি হয়েছিল?
স্বাধীনতার সুবাদে যারা বঙ্গভবনের শীর্ষে, পতাকা উড়ানো গাড়ীতে, সচিবালয়ের সচিব, মতিঝিলের কোটিপতি, গুলশান-বনানী-বারিধারার শ্বেত পাথরের সুরম্য অট্টালিকার মালিক-তারা কেউ তার খোঁজ নেননি!
অথচ স্বাধীনতা না হলে কারো গাড়িতে, বাড়িতে পতাকা উঠতো না, অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের লেজা হয়ে জীবন কাটাতেন এবং মতিঝিলের বর্তমানের কোটিপতিরা ’৭১-এর পূর্বের ন্যায় বাওয়ানী-আদমজী-ইস্পাহানী ও অন্যান্য পাকিস্তানি ব্যবসায়ীর মাথায় ছাতা ধরে ও তাদের ব্যাগ টেনে টেনে জীবনপাত করতেন।
মহেশনগরের গরীব কৃষকের ১৫/১৬ বছরের তরুণ সেই বাকেরকে পবিত্র কোরান শরীফ তেলাওয়াতের অপরাধে পাকিস্তানী খান সেনারা ধরে তাকে প্রথমে বলেঃ “তুই মুসলমান? খোল্ লুঙ্গি। তোর পুরুষাঙ্গ দেখা, মুসলমানি দেয়া আছে কি না দেখা?”
তারপর তাকে আমগাছের গুঁড়িতে দড়ি দিয়ে পেচিয়ে বেঁধে ফেলে। আমগাছে বাঁধা অবস্থায় অসহায় বাকেরের শরীর ছুরি দিয়ে চিরে চিরে লবণ ও ঝালের গুঁড়ো ঢেলে দেয় হিংস্র পাকিস্তানি খান সেনারা। তার অপরাধ, কেন সে কোরান শরীফ পড়লো। গাছের গুঁড়িতে বেড় দিয়ে হাত, পা, শরীর বাঁধা অবস্থায় কোরান শরীফের যত ছুরা ও আয়াত জানে সব চীৎকার করে পড়ে যায় বাকের! কিন্তু হায়! গলেনি মন সেই পাকিস্তানি কাফেরদের, যারা মুখে বলে মুসলমান কিন্তু কোরান শরীফ পড়াকে বলে অপরাধ।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে যত চীৎকারে বালক বাকের কোরান শরীফ পড়ুক না কেন, পাকিস্তানি খানসেনারা তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। জামায়াতীদের দ্বারা বিভিন্ন গাছ থেকে শত শত পিঁপড়ার বাসা ভেঙ্গে আনায় তারা। সে সব পিঁপড়ার বাসার লাখ লাখ পিঁপড়া ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলে সেই যন্ত্রণাকাতর বাকেরের মাথায়, মুখে, বুকে, পিঠে, সর্ব অঙ্গে। পিঁপড়ার ওপরে পিঁপড়ায় তার শরীর ঢেকে যায়। এক সময় তাকে আর দেখা যায় না, সেখানে দেখা যায় পিঁপড়ার গুদাম।
পাকসেনারা চীৎকার করে বলে, “তুঝে গুলিসে নেহি মারুঙ্গা। বুলকে চুটিওসে খেলাওঙ্গা”। (তোকে গুলি করে মারবো না। তোকে পিঁপড়া দিয়ে খাইয়ে মারবো।) বলতে থাকে আর পিঁপড়ার বাসা তার গায়ের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে থাকে। এভাবে দু’ঘন্টা সেই নিষ্ঠুর অত্যাচারের পর বাকের যখন নির্জীব হয়ে পড়ে, তখন সে মারা গেছে ভেবে খানসেনারা অন্য দিকে হামলা করার জন্য যায়।
খানসেনারা অন্যদিকে চলে গেলে সেই সুযোগে গ্রামের দুঃসাহসী যুবকেরা এসে বাঁধন খুলে বাকেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মগোপন করে। তখন তারা দেখতে পায় যে, বাকেরের মাথায় ও গায়ে পাকিস্তানি খান সেনারা পিঁপড়ার শত শত বাসা ভেঙে ভেঙে লাখ লাখ পিঁপড়া ঢেলে দিলেও পিঁপড়া তাকে কামড়ায়নি। পিঁপড়ার কামড়ের একটা দাগও বাকেরের শরীরে নেই দেখে এই অলৌকিক ঘটনায় সকলে বিস্মিত হয়ে পড়ে!
আল্লাহ’র অবলা পিপীলিকা পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারী বাকেরের পুণ্য শরীরে একটিবার কামড় দেয়নি, আর ইসলামের নামে এক লাখ পাকিস্তানি হানাদার বাংলাদেশে ৩০ লাখ ভাই বোনকে হত্যা করেছে, ৩ লাখ মা বোনকে ধর্ষণ করেছে। যে পাকিস্তানী সেনারা গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করেছো, তারা শুনে রাখো, তোমরা কাফির, কাফির, কাফির। তোমাদের পক্ষে ’৭১-এ আল্লাহ ছিলেন না, কেয়ামতের দিনেও থাকবেন না। কেয়ামতের দিনে তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে হাবিয়া দোজখ।
’৭১-এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারী ছাত্র বাকের স্বাধীনতার পর বহু কষ্টে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স পর্যন্ত পড়েছিল। কিন্তু তার গরীব কৃষক বাবা তাকে এম. এ. পড়াবার খরচ আর চালাতে পারেনি। তারপর দ্বারে দ্বারে সে ঘুরেছে, সামান্য একটি চাকরির জন্য। কেউ এগিয়ে আসেনি তাকে একটি চাকুরি দিয়ে সাহায্য করতে। যখন এদেশের পরাক্রমশালী সামরিক প্রেসিডেন্টদের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে ভেজিটেবলস্ আনা হতো, ফ্রান্স থেকে আঙ্গুর, স্পেন থেকে আপেল, তখন দ্বারে দ্বারে ভিখারীর মতো ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে গেছে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারী হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধা বাকের!
’৭১ সালের ১০ এপ্রিল শনিবার বিদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে আকাশবাণী বিবিসিসহ বিশ্বের সকল প্রচার মাধ্যমে ১০ এপ্রিল দুপুরে এ সংবাদ প্রচারিত হয়ে যায়। ঐদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য “জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি ভাষণ” বিকেলে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু ১০ এপ্রিল দুপুরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নাম বিশ্বব্যাপী ইথারে প্রচারিত হয়ে যাবার সাথে সাথে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে বিভেদের ও চক্রান্তের সুর বেজে ওঠে।
চক্রান্তকারীদের মধ্যমণি ছিল খোন্দকার মোশতাক। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যা না গড়াতে সেখানে ২/৩ জন প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্কট ও চক্রান্তের মধ্যে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ রাতে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য বিএসএফ-এর মহাপরিচালক গোলক মজুমদারের হাতে বিকেলে হস্তান্তর করে দেন। কিন্তু সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ চক্রান্তের গভীরতা আঁচ করতে পারেন এবং তার ওপর খোন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগী ছাত্র নেতাদের চাপ বেড়ে যায়। তখন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর ভাষণ” প্রচার স্থগিত রাখতে বলেন।
কিন্তু ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তাকে জানান যে, তাঁর রেকর্ডকৃত ভাষণ তিনি বিএসএফ-এর গোলক মজুমদারের হাতে বিকেলে হস্তান্তর করে দিয়েছেন এবং সেটা ফিরিয়ে আনা বা ফিরিয়ে আনতে বলার আর কোনো সুযোগ নেই। কেননা, স্বাধীন বাংলা বেতারের ট্রান্সমিটার ছিল সমুদ্রে চলমান একটি ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে। উপকূল থেকে নৌবাহিনীর ছোট জলযানে সেটা উক্ত জাহাজে পৌঁছানো হতো। কমবেশি ৪ ঘন্টা সময়ে প্রবাসী সরকারের অবস্থান স্থল থেকে যে কোন রেকর্ড পৌঁছাতে সময় লাগতো।
সুতরাং সেটা বন্ধ করার সকল পথ রুদ্ধ। তাজউদ্দীন সাহেব, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং মনসুর আলী সাহেব একত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ১০ এপ্রিল শনিবার রাতে “জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ” শুনলেন। ভাষণ শুনে মনসুর আলী সাহেব খুব আনন্দিত হলেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে বারংবার অভিনন্দিত করলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের ওপর কিছুটা ক্ষুন্ন হলেন। (ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ইচ্ছা করলে বিএসএফ-এর ওয়াকী টকীতে মেসেজ দিয়ে উক্ত ভাষণ প্রচার বন্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।)
’৭১ সালের সেই সঙ্কটকালে প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক ও নির্ভুল। ১০ এপ্রিল শনিবার রাতে উক্ত ভাষণ প্রচারিত হয়ে যাবার সাথে সাথে প্রবাসে বসে চক্রান্তকারী সিআইএ’র এজেন্ট মোশতাক, তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী (’৬৪ সালে পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে চাকরিকালীন সিআইএ’র সাথে গোপন সম্পর্ক প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত) গংদের বিভেদ সৃষ্টি করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার তৎপরতায় ১১ এপ্রিল রবিবার থেকে বিরতি পড়ে। ১০ এপ্রিলের সরকার গঠন, ছাত্রনেতাদের “বিপ্লবী ওয়ার কাউন্সিল” (সরকারের পরিবর্তে) গঠনের উদ্যোগ পরিহারে তাদেরকে সম্মত করানো এবং ১৭ এপ্রিল শনিবার মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের শুরুতে পঠিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক “স্বাধীনতার সনদ” রচনায় ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের চীফ সেক্রেটারী আমার মামা রুহুল কুদ্দুস আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বার বার তাঁর নাম ধরে বলে গেছেন, “বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম একজন ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন স্যার সম্পর্কে সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি বার বার বলে গেছেন, “তাজউদ্দীন সাহেব না থাকলে মোশতাকের চক্রান্ত জয়যুক্ত হতে পারতো এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য কিছু হয়তো হতো। ক্ষমতালোভী মোশতাকের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফিরে নাও পাওয়া যেতো।” খুনি মোশতাকের সুগভীর চক্রান্ত প্রতিহত করতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পাশে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। তাঁকে ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দন আহমদকে প্রবাসী সরকারের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে সকল সচিব সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে তাঁরা সকলে মিলে ১৬ ডিসেম্বর মনজিলে মকসুদে পৌঁছে দেন।
আল্লাহর রহমতে আজ জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরকার বাংলাদেশের মাটিতে পুনরায় ফিরে এসেছে। ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব-গাথা ও মান-মর্যাদা আবার ফিরে এসেছে। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা সদর্পে ও সগৌরবে আবার ’৭১-এর আমাদের রণধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু”। মন-প্রাণ উজাড় করে উচ্চারণ করতে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।” ’৭১-এর বীরের জাতির মুকুট বাঙালির শিরে আবার পরিয়ে দিয়েছেন মহান জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলার ঘরে ঘরে আজ শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনার নাম। বীর বাঙালির নাম।
বিশ্বের কোটি কোটি বঙ্গজননী, বিশ্বের যিনি যেথায় আছেন, বাঙালির পুণ্যময় ১৭ এপ্রিলের পুণ্য প্রভাতে আপনার কোলের শিশুর কপালে আজ পরিয়ে দিন জয়টিকা। বিশ্বের ত্রিশ কোটি বাঙালি যে, যেখানে আছেন, বিশ্বের দিকে দিকে আজ উড়িয়ে দিন বাঙালির বিজয় পতাকা, আর তাতে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিন, “বাঙালি বীরের জাতি, বাঙালি ৩০ লাখ শহীদের জাতি। বাঙালি শ্রেষ্ঠ জাতি, বাঙালি অমর জাতি। বাঙালি জাতির অমর প্রাণ, সূর্যের নামে নাম, শেখ মুজিবুর রহমান। আকাশে যতদিন সূর্য উদ্ভাসিত হবে এবং পৃথিবীর বুকে সূর্য কিরণ ছড়িয়ে পড়বে, ততদিন সূর্যের পাশে বীর বাঙালি জাতি উদ্ভাসিত হবে এবং সূর্যের ন্যায় পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতি পুণ্য কিরণ ছড়িয়ে দেবে। সেই কিরণে উদ্ভাসিত হবে মানবজাতি। উদ্ভাসিত হবে পুণ্যালোকে, শুভকর্মে। বিশ্বভুবন জুড়ে বাঙালি জাতির জয়গান উঠবে- জয় হোক বাঙালির। জয়তুঃ বাঙালি।
লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।infomusabd@gmail.com, web: www.musabd.com
এইচআর/পিআর