মতামত

সুবর্ণ মহিমায় প্রশ্নপত্র ফাঁস : শিক্ষার অধঃপতন

এসএসসি ও এইচএসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা এখন আলোচনার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি মনে করেন না যে তার মন্ত্রী ও সচিবের কোনো গাফিলতি আছে এবং মাত্র ২০ মিনিট বা আধা ঘণ্টা আগে ফাঁস হওয়ায় এর কোনো বড় প্রভাব নেই সামগ্রিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায়।

Advertisement

শিক্ষা মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিল। সম্প্রতি মন্ত্রী ও সচিবও বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। আর খোদ প্রদানমন্ত্রী যখন বলেছেন তখন বলতে হবে ভাল দিক এই যে, বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিনই দেখা গেল শিক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পদস্থরা বসেছেন, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুলিশ ও র্যাবের সক্রিয় তৎপরতাও দেখছি আমরা।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, গোটা সমাজে দুর্নীতি যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস তার থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এবং এভাবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমন স্বনামখ্যাত শিক্ষাবিদের সাথে একমত হয়েও বলছি, প্রশ্নপত্র ফাঁস একেবারে ঠেকানো যাবে না তা নয়, তবে তার জন্য কোথাও না কোথাও আন্তরিকতার অভাব আছে।

এটি আমাদের উপর একটি আগ্রাসন এবং আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন যে, অস্বীকার করার মনোভাব কিংবা বিষয়টি হালকা করে দেখার কর্তৃপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গি যেন এই ধারণা না দেয় যে, এই সমস্যা জিইয়ে রেখেই শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

Advertisement

সবাই বলেছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস আগেও ঘটেছে, কিন্তু এখনকার এমনভাবে তা ছড়িয়ে যায়নি কখনো। এর কারণ প্রযুক্তি। প্রযুক্তি এমন সর্বগ্রাসী কখনো ছিল না এখন যতটা হয়েছে। প্রযুক্তি উপকার করছে আমাদের। নানাস্তরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু একইসাথে ক্ষমতায় সে দৈত্যাকৃতির হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূরপাল্লায় বসে গুগল, ফেসবুক, ভাইবার বা হোয়াট্সঅ্যাপ আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

প্রশ্ন হলো জাতি কী দুষ্টলোকের প্রযুক্তির দুষ্ট ব্যবহারের কাছে পরাজিত হবে? নাকি তারও মেধা আছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা আছে তাকে প্রতিরোধ করার? দক্ষতা বা সক্ষমতা অবশ্যই আছে, কিন্তু স্বদিচ্ছা আছে কিনা সেটাই মানুষের এখন জানার ইচ্ছা।

প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধানসহ আইন রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে। সময়ের আবর্তে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির ধরন পরিবর্তিত হওয়ায় এবং প্রযুক্তিগত ব্যবহার ও জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি কমাতে এ আইন সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তি ও ডিজিটাল আইনের সমন্বয় করা যেতে পারে। এমনকি এসব কর্মকাণ্ডে যেসব অভিভাবক টাকা ব্যয় করছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা যেতে পারে। পরীক্ষার প্রবেশপত্রে জালিয়াতির ধরন এবং অপরাধজনিত শাস্তিগুলো উল্লেখ করা প্রয়োজন। এতে একজন পরীক্ষার্থীর অপরাধপ্রবণতা বেশির ভাগই কমে যাবে। এ ছাড়া প্রবেশপত্রের সঙ্গে প্রতিটি অভিভাবকের কাছে জালিয়াতির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে চিঠি দেওয়া যেতে পারে।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দুই একটি হলেই বড় প্রভাব পড়তে পারে। এই দেশেই প্রচুর ছেলেমেয়ে ইংরেজী মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়। তাদের পরীক্ষা প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয় লন্ডন থেকে। সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আওয়াজ ওঠে না। গত দুটি বছর ভালভাবেই হয়েছে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয় না। এসব দৃষ্টান্ত যখন আছে, তখন কেন আমাদের দেখতে হচ্ছে এসএসসি বা এইচএসসিতো বটেই, এখন পিইসি বা জেএসসি’র মতো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়?

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর কথায় একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন আসছে। এমসিকিউ প্রশ্ন না রেখে এর পরিবর্তে ছোট ছোট প্রশ্ন, শূন্যস্থান পূরণ রেখে পরীক্ষার সময় বাড়ানোর ধারণা পাচ্ছি। কিন্তু এটিই কি সমাধান? তখনও কি ফাঁস হবে না? সব বোর্ডের অভিন্ন প্রশ্নপত্রের ধারণা থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। বিভাগ আনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্র ও একাধিক সেট ব্যবহারে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি অনেকটাই কমাবে বলে শিক্ষাবিদদের ধারণা।

মোবাইল ফোন বা রেডিও ট্রান্সমিটারের সিগনাল প্রবাহে বাধা দিতে অনুমোদিত জ্যামিং ডিভাইস অথবা রেডিও ওয়েভ ব্লাইন্ড স্পট সৃষ্টিকারী ডিভাইস ব্যবহার করা যেতে পারে। নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরীক্ষার স্বার্থে পরীক্ষার্থীকে প্রয়োজনে পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে হাজির করে মেটাল ডিটেক্টর বা নিরাপত্তা যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীকে যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মেটাল বহনে বাধা দিতে হবে।

আমরা জানি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণ-টোকাটুকি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এই প্রশ্নতো ফাঁস যেন সেই গণ-টোকাটুকাকেই এক সুবর্ণ মহিমায় ফিরিয়ে আনল। সরকার কিভাবে সামলাবে আমরা জানি না। কিন্তু বিষয়টি ভয়ানক। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের একাংশ নিজেদের যাবতীয় অযোগ্যতা নিয়েই ভবিষ্যতে সব পেশায় যাবে। এমনকী শিক্ষকতার পেশাতেও যোগ দিবে। এটি অনভিপ্রেত। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার প্রচেষ্টায় কিংবা অর্থ দিয়ে প্রশ্নপত্র কেনার অপকাণ্ডে যখন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও যোগ দেন, তখন তখন ধরেই নিতে হবে যে, এদেশে শিক্ষার বারোটা বেজেছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস সামগ্রিক অধঃপতনেরই একটি বড় লক্ষণ।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এআরএস/পিআর