শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার টানা নয় বছর ক্ষমতায় থেকে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে একের পর এক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে হাত দিয়েছে। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সামনে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ খ্যাত মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সচেষ্ট আছেন। ইতোমধ্যে মেগা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রকল্পগুলো সম্পন্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকতে।
Advertisement
সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প, পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্প, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (এমআরটি), পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প, মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্প এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প।
পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। সেতু নির্মাণ শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৭ জেলায় লাগবে উন্নতির হাওয়া। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ ৫০শতাংশ শেষ হয়েছে বলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন।
এছাড়া পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও শুরু হয়েছে।
Advertisement
রাজধানীবাসীকে যানজটের নাকাল অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে নেয়া হয়েছে ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি চালু করা হবে।
দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ : প্রকল্পটি শুরু হয়েছে গত ২০১০ সালের জুন মাসে এবং আগামী ২০২২ সালের মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে করিডরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে। এতে আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিল্ক রুট (চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে বিদ্যমান রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প : পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গত ২০১১ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তি (আইজিএ) প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য ২০১৩ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট চুক্তির ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন (প্রথম পর্যায়) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বাধ্যবাধকতা বিবেচনায় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে ধাপে ধাপে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পাদন করা হচ্ছে।
এদিকে, মধ্য মেয়াদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জেনারেল কন্ট্রাক্ট ফর রূপপুর (এনপিপি) স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রয়োজনে সাইটের নিকটবর্তী পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা চর হতে আরও ৮০০ একর জমি প্রকল্পের অনুকূলে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
Advertisement
মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার : এটি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। গ্যাসের ক্রমবর্ধমান স্বল্পতার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা হতে উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ডিএমআরটিডিপি) : ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন, নিরাপদ কার্যকরী দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা চালু এবং গণপরিবহন সুবিধা নিশ্চিতকরণে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় মেট্রোরেল তথা এমআরটি লাইন-৬ বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০১২ হতে জুন ২০২৪ পর্যন্ত। দ্রুত প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও এবং ২০২০ সালের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। মোট আটটি কন্ট্রাক্ট প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর পায়রা বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ ৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। উদ্বেধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পায়রা বন্দরের মাধ্যমে দেশে উন্নয়নের নতুন জোয়ার উন্মোচিত হবে। নতুন এ বন্দর ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য গড়ে উঠবে। শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, সমগ্র বাংলাদেশ এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্যও একটা শুভ সূচনা।
মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ফাস্ট ট্র্যাক মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। যার সভাপতি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর
কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প তিনটি ধাপে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করার পর তা সম্পন্ন করতে পাঁচ বছর প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে কাজ যথাক্রমে ২০৩৫ ও ২০৫৫ সাল নাগাদ সমাপ্তির পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি জি-টু-জি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জি-টু-জি পদ্ধতিতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন, ভারত, নেদারল্যান্ডস ও দুবাইয়ের চারটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব পেশ করেছে।
মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প
মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাগেরহাট জেলার রামপালে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড কর্তৃক নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) ৩০ আগস্ট ২০১০ সালে ৫০-৫০ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যৌথ একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রকল্পটি জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ভূমি প্রক্রিয়াকরণ, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ঢাল সুরক্ষা প্রভৃতি কার্যক্রমের বাস্তব অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। এছাড়া ইপিসি চুক্তির জন্য সময় নির্ধারণ না হওয়ায় এখনও মূল ইপিসি প্ল্যান্টের কাজ শুরু করা হয়নি। মধ্য মেয়াদে এ প্রকল্পে ১১৪ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার যা ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এবং ইকুইটি থেকে নির্বাহ করা হবে।
এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ
দেশে বিদ্যমান গ্যাসের বিকল্প হিসেবে আমদানিকৃত তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এলএনজি ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের জন্য কাতারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এই চুক্তিটি সম্পন্ন হলে এলএনজির প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে। কক্সবাজারে মহেশখালী সমুদ্র উপকূল হতে পশ্চিম দিকে গভীর সমুদ্রে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হবে যার এলএনজি ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার এবং রি-গ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা ৫০০ এমএমএসসিএফডি। প্রকল্পের বিস্তারিত ডিজাইন টার্মিনাল কোম্পানি কর্তৃক সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মধ্যে চালু করা হবে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে মেগা প্রকল্পসমূহ সম্পন্ন করতে আওয়ামী লীগকে আরও এক মেয়াদ ক্ষমতায় রাখতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬-২০০১ সালের বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ৫ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বর্তমানে আমরা ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। আমরা একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে দশ বছর মেয়াদী একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা সম্পন্ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বড় ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য আরও এক মেয়াদ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন।
এফএইচএস/এমবিআর/বিএ