ফিচার

কবি নজরুলের হাস্যরস

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তার কথা আমরা জানি। প্রেমিক পুরুষ হিসেবেও তিনি বিখ্যাত। সব ছাপিয়ে একজন মানুষ নজরুল যে পুরোটাই রসিক, তা-ও হয়তো জানি আমরা। কেননা বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণে আমরা কবি নজরুল হাস্যরসের সন্ধান পাই। শিল্প-সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি আমোদ-আহ্লাদে থাকতে ভালোবাসতেন। জরাজীর্ণ জীবনের দুঃখবোধ মুছে দিতেন হাসি-আনন্দে। আজ আমরা কবি নজরুলের হাস্যরসের সঙ্গে মিশে যাবো-

Advertisement

১.একবার কবি কাজী নজরুল ইসলাম পল্লীকবি জসীম উদদীনের বাড়ি বেড়াতে গেলেন। নজরুল চা পান করার আগ্রহ প্রকাশ করলে পল্লীকবি বাজার থেকে চা পাতা এনে বাড়ির বউ-ঝিকে বানানোর জন্য দেন। বউ-ঝিরা এর আগে চা বানাননি। তারা বাড়িতে যত রকম মসলা ছিল (আদা, মরিচ, পেঁয়াজ, ধনে, জিরা ইত্যাদি) সবকিছু দিয়ে জম্পেশ এক কাপ চা খাওয়ালেন নজরুলকে।

২. একদিন শিল্পী আব্বাসউদ্দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছেন। নজরুল ইশারায় তাকে বসতে বললেন । অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন । নজরুল বললেন, ‘কি তাড়া আছে, যেতে হবে ?’ আব্বাসউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য।’ নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন।

আরও পড়ুন- হুমায়ূন আহমেদের নুহাশপল্লী

Advertisement

জোহরের নামাজ শেষ করার সাথে সাথে নজরুল তার হাতে একটি কাগজ দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার গজল’। নামাজ পড়তে যে সময় লেগেছে ঠিক সেই সময়ের মধ্যে নজরুল একটি নতুন গজল লিখে ফেলেছেন। গজলটি ছিলো, ‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/ দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ।’

৩.একবার নজরুল সিরাজগঞ্জে আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর বাসায় গেলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে দই দেওয়া হল। তা খেয়ে নজরুল আসাদউদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভূত ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?’

৪. আলী আকবর একদিন নজরুল ইসলামকে একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে মতামত চাইলেন। পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, ‘আপনার পাণ্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। যদি বলেন তো আমি একটা ছড়া লিখে দিতে পারি।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুরোধ করলেন একটি ছড়া লিখে দেওয়ার জন্য। নজরুল ইসলামও দু’খিলি পান মুখে পুরে লিখলেন ‘লিচু চোর’ ছড়াটি।

৫.একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ তার চোখ পড়লো অঞ্জলির ওপর। নজরুল দেখলেন, একটা পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে অঞ্জলি যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে অঞ্জলি পেয়ারা চাইছে। তিনি ভাবলেন, অঞ্জলির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন।

Advertisement

অঞ্জলির সামনে গিয়ে কবি নজরুল গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। নজরুল তখন অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’ অঞ্জলি বললো, ‘কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।’ এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তিনি লিখলেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের সেই কবিতা।

৬.কাজী নজরুল আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে খেতে বসেছেন। আসাদউদ্দৌলা নিজেই ইলিশ ভাজা দিচ্ছেন সবার পাতে। পাতে ইলিশ পড়া মাত্র নজরুল সেটা খেয়ে ফেললেন। তখন কে যেন আরও কয়েক টুকরো ইলিশ দিতে যাচ্ছিলেন কবির পাতে। কবি তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘আরে করছ কী?’ তিনি বললেন, ‘ইলিশভাজা দিচ্ছি!’ কবি বললেন, ‘আমাকে এত ইলিশ দিও না। শেষকালে বিড়াল কামড়াবে তো?’

আরও পড়ুন- বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গমাতা

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কবির মুখের দিকে। হঠাৎ হাসতে হাসতে কবি বললেন, ‘ইলিশ মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়। বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে। বেশি খেলে কি আর রক্ষে আছে? সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।’

৭.কবি নজরুল আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করতেন। তিনি রুটি বানাতে বানাতে ছড়া কাটতেন। আটা মাখছেন আর কিশোর নজরুলের গা বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। আর মুখে ছড়া, ‘মাখতে মাখতে গমের আটা/ ঘামে ভিজল আমার গা-টা।’

৮. একবার ছোট্ট এক মেয়েকে কবি বলেছিলেন, ‘খুকি তোমাকে কলকাতার এ মোড় থেকে ও মোড় সব দেখাব।’ ছোট্ট মেয়েটি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি কবির এ কথা। কাজী নজরুল ইসলাম সত্যি সত্যি একদিন একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লেন মেয়েটিকে নিয়ে। সারাদিন কলকাতা ঘুরে বেড়ালেন। বিকেলে ট্যাক্সি ভাড়া দিতে গিয়ে দেখেন- পকেটে একটা পয়সাও নেই। পরে সেই ট্যাক্সি নিয়েই ছুটলেন বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি। এর-ওর কাছ থেকে ধার করে মেটালেন ট্যাক্সি ভাড়া।

৯. কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ধূমকেতু অফিসে সবসময় চলতো হাসি-আনন্দের বন্যা। মাটির ভাঁড়ে চা চলতো কিছুক্ষণ পর পর। কবি যখন চায়ে চুমুক দিতেন কিংবা কোনো হাসির কথা মনে পড়ত কিংবা কোনো রসিক বন্ধু অফিসে ঢুকত, অমনি কবি অট্টহাসি দিতেন। মাটির পেয়ালা ছুঁড়ে মারতেন। আর মুখে বলতেন, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’।

এসইউ/পিআর