মতামত

বিশ্বজিৎ হত্যার রায় ও ছাত্রলীগ কর্মীর কাটা হাত

বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশের পর যে দৃশ্যটি একজন মানুষকে অস্বাভাবিক করে দিতে যথেষ্ট তার মধ্যে পুরোনো ঢাকার বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্যটি অন্যতম। কোনো সভ্য পৃথিবীর দৃশ্য এটি নয়, ভয়ঙ্কর ও নির্মম এই দৃশ্যটি বাংলাদেশের রাজনীতিকে আহতই করেছে কেবল তা নয়, করে তুলেছে অত্যন্ত কদর্য। একই সঙ্গে দেশের ভেতর চলমান আগুন সন্ত্রাস যা মানুষকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে জীবন্মৃত করে রেখেছে, অনাগত কাল ধরে যার স্মৃতি মানুষকে বহন করতে হবে সেই কালো স্মৃতিকেও ম্লান করে দিয়েছিল একদল যুবকের চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কোপানোর দৃশ্য।

Advertisement

এর আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগ নামক রাজনৈতিক শক্তিটির জন্য মানুষের মনে সামান্য হলেও যে অনুকম্পা ছিল, যা তাদের ওপর বার বার আঘাত বিশেষ করে শিবিরের হাতে ছাত্রলীগের নিহত হওয়া কিংবা রগ কেটে ফেলার কারণে মৃত্যু বা পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়েছিল, কিংবা চট্টগ্রামে ব্রাশ ফায়ারে আট ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল তা একেবারেই ধুয়েমুছে সেই জায়গায় ছাত্রলীগের প্রতি এক ধরনের ঘৃণার উদ্রেক করেছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছিল, সে প্রশ্নটি আর কিছুই নয়, প্রশ্নটি হলো, আওয়ামী লীগ কি সত্যিই জনগণের রাজনৈতিক দল?

আমরা লক্ষ্য করেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ দল ও সরকার উভয়েই বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী-পুত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে, টুইটারে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না এবং আওয়ামী লীগ তার দলীয় অন্যায়কারীকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। কিন্তু আমরা একথা অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যে, বাংলাদেশে যে কোনো বিচারই দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়ে যায় এবং বিচারপ্রার্থীর সামাজিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক সামর্থ অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়াকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্ত করে। বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায়ও আমরা দেখতে পাই যে, সরকার চেয়েছে বলেই বিচার প্রক্রিয়া অন্য মামলার চেয়ে দ্রুত এগিয়েছে বটে কিন্তু বিচার প্রার্থী হিসেবে যেহেতু বিশ্বজিতের পরিবার সামর্থবান নয় সেহেতু বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে দৌড়ে তারা ঠিক পেরে ওঠেননি।

এই হত্যাকাণ্ডের যে রায় হয়েছে সেই রায় থেকেই আমরা জানতে পারি যে, এই মামলার তদন্ত রিপোর্টেই রয়ে গিয়েছিল সবচেয়ে বড় ত্রুটি, যার মাধ্যমে বিচারের রায় হবে সেই তদন্ত রিপোর্টই যদি ত্রুটিযুক্ত হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বিচারের রায় নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। হয়েছেও তাই। নিন্ম আদালতের দেয়া রায়টি নিয়ে কাউকেই তেমন কথা বলতে দেখা যায়নি, কারণ সেই বীভৎস খুনের দৃশ্যে যাদেরকে কোপাতে দেখা গিয়েছিল বিশ্বজিৎকে তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশের রিপোর্ট, ময়না তদন্তের রিপোর্টকে আমলে এনে উচ্চ আদালত নিন্ম আদালতের দেয়া সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রেখেছেন মাত্র দু’জনের ক্ষেত্রে, বাকিদের শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে, খালাসও পেয়েছে কেউ কেউ।

Advertisement

সাধারণ মানুষকে এ রায় যে হতাশ করেছে সেটা বলাই বাহুল্য, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড নিয়ে হাইকোর্টের রায় বিষয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া যদি একত্র করা যেতো তাহলে একথা নিশ্চিত প্রমাণ করা যেতো যে, এই রায়ের ফলে দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কার মনে কী ক্ষত তৈরি হয়েছে সে কথা না বলেও একথাটি জোর দিয়েই বলা যায় যে, এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকার। এ বিষয়ে মাত্র একটি উদাহরণ দিয়েই আজকের লেখা শেষ করবো তবে তার আগে আরো কিছু কথা বলতে চাই।

বাংলাদেশে ন্যায়-বিচার আছে কি নেই, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা কতোটুকু সে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের এবং এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই বলতে চাইবেন যে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। বিশ্বজিৎ হত্যার ক্ষেত্রেও পুলিশ ও তদন্তকারী কমকর্তা যদি সঠিক রিপোর্ট দিতো তাহলে বিচার নিয়ে কারো কোনো হতাশার সুযোগ থাকতো না। বিচার বিভাগ একথা বলে তার দায় এড়াতেই পারে। কিন্তু রাষ্টের আক্রান্ত নাগরিকের প্রাথমিক গন্তব্য অর্থাৎ পুলিশ যে নাগরিকের আস্থার জায়গাটি বারম্বার নষ্ট করে দিচ্ছে তাতো আবারও প্রমাণিত হলো এই হত্যাকাণ্ডের রায়ের মধ্য দিয়ে, নয়? আবারও মানুষ বুঝে গেলো যে, যা চোখে দেখা যায়, যা দিনের আলোর মতো সত্য সেই সত্যও পুলিশের হাতে পড়লে বদলে যেতে পারে।

মানুষ বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সেই ভিডিও চিত্রটি দেখেছে, এলাকাবাসী সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছে তাহলে পুলিশ রিপোর্টে কি করে হত্যাকারীদের বিবরণ বদলে যায়? সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড়ে কী করে অবহেলা হয়? কি করেই বা এতোদিন ধরে বিশ্বজিৎ হত্যার আসামীরা পলাতক থাকে? এসব প্রশ্নের দু’টো ব্যাখ্যা হতে পারে। এক. হত্যাকারীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পেয়েছে, দুই. হত্যাকারীরা অর্থের জোরে তাদের পক্ষে পুলিশকে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু শুরুতেই একথা বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায় থেকেই বিশ্বজিৎ হত্যার সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন করার ব্যাপারে কোনো রাখঢাক না রেখেই প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল। তার মানে এও হতে পারে যে, দলের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশও এক্ষেত্রে মানা হয়নি। দলের ভেতরের শক্তিশালী কোনো পক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছেন কিংবা আগেই যা বলেছি অর্থ ছড়িয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াকে হাল্কা করে দেওয়া হয়েছে হয়তো। কিন্তু যাই-ই ঘটুক না কেন, মানুষ দেখতে পাচ্ছে যে, বিশ্বজিৎ হত্যার মতো এতো বড় একটি ঘটনার বিচার প্রক্রিয়াতেও গাফিলতি হয়েছে এবং এর ফলে সরকার ও বিচার ব্যাবস্থা দু’জায়গাতেই আস্থাহীনতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা আওয়ামী লীগের চেয়েতো আর কারো বেশি জানার কথা নয়, কারণ এই দলটি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছে ১৯৭৫ সালে এবং ইনডেমনিটি জারি করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া এদেশে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘকাল। আওয়ামী লীগ এই অচলায়তন ভেঙে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করে দেশকে একটি কালো অধ্যায় থেকে মুক্ত করেছে। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনেছে আওয়ামী লীগের হাতেই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও সম্পন্ন হওয়ার ফলে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই যদি আবার বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ঙ্কর হত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয় তাহলে দলটির সমস্ত অর্জন সত্যিই নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের মনে তখন এই কথাটিই ঘুরেফিরে আসে যে, তাহলে কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে বক্তব্য আওয়ামী লীগ দেয় তা সত্য নয়? নাকি কেবল তাদের নিজেদের জন্যই?

Advertisement

বিচার বিভাগ নিয়েতো এদেশে প্রশ্ন তোলা যায় না অথচ বিচার বিভাগই সংবিধানের ৭০-অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বিষয়টি যে স্ববিরোধী হয়ে যায় সেকথা বলে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হতে চাই না। নিজেদের স্বাধীনতার প্রয়োগ যদি বিচার বিভাগ কেবল রাজনীতির প্রতি খড়গহস্ত হয়ে প্রমাণ করেন তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ্যের আস্থা যে কখনওই ফিরবে না তা বলাই বাহুল্য। তাই বিচার বিভাগ থাক। যে ছাত্রলীগ বিশ্বজিৎ হত্যা করে নিজেদের, আওয়ামী লীগের ও সরকারের নাকটি কেটেছে তাদের কথা দিয়েই আজকের লেখাটি শেষ করি।

ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। সুযোগ নেই দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা কিংবা ত্যাগ বিষয়েও প্রশ্ন তোলার। কিংবা এদেশের রাজনীতিতে তারা যেভাবে রক্ত দিয়ে দেশের ভয়ঙ্কর অপ-রাজনীতির মোকাবিলা করেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারও তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দল ক্ষমতায় গেলে এই ঐতিহ্যবাহী ছাত্রপ্রতিষ্ঠানটি যে লাগামহীন হয়ে ওঠে তার প্রমাণও আমাদের সামনে রয়েছে ভুরি ভুরি। এরমধ্যে সবচেয়ে কুৎসিৎ ও নোংরাটি নিঃসন্দেহে বিশ্বজিৎকে সর্বসম্মখে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য।

এর ফলে এই সংগঠনটির প্রতি মানুষের সহমর্মিতা সত্যিই যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো, বিশ্বজিৎ হত্যায় রায় প্রকাশের দিনই সিলেটে শিবির কর্মীদের হাতে ছাত্রলীগের দুই কর্মীর গুরুতর আহত হওয়া সাধারণ মানুষকে মোটেও নাড়াতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রলীগ কর্মীর কাটা হাত আর পায়ের রগ কাটার রক্তাক্ত দৃশ্য সত্যি সত্যিই দেখার মতো নয়, মানুষের মগজে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারে সে দৃশ্য। কিন্তু এও লক্ষ্যণীয় যে, কাউকেই এই দৃশ্যে খুব একটা কষ্ট পেতে দেখিনি, অন্ততঃ আমার ফেসবুক পাতায় যারা এই দৃশ্য দিয়েছেন সেগুলোর কমেন্ট অংশে। তার মানে এই যে, বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে মানুষ মিলিয়ে দেখছে ছাত্রলীগের ওপর শিবিরের হামলাকে। কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যার আগে হলে ছাত্রলীগের ওপর শিবিরের এই হামলায় মানুষের প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হতো তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। আমার বিশ্বাস, ছাত্রলীগ কখনওই আর মানুষের সেই সহমর্মিতা ফিরে পাবে না, অন্ততঃ ততোদিন যতোদিন না বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের একটি সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার মানুষের সামনে দৃশ্যমান হয়। আর মূল দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেও এর মূল্য ভয়ঙ্কর ভাবেই দিতে হবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/জেআইএম