আন্তর্জাতিক

কাতারের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক ছিন্নের হিসাব নিকাশ

কাতারের সঙ্গে যে আশায় সৌদি জোট কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তা যে পূরণ হচ্ছে না, এখন সেটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। গত ৫ জুন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয়। তাদের সঙ্গে সর্বমোট নয়টি দেশ কাতারকে বয়কট করে। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে মদদ যুগিয়ে কাতার উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার অভিযোগ তোলা হয়। 

Advertisement

আকাশ, সাগর আর ভূমিতে অবরোধ আরোপ করার পর কাতারের কাছে ১৩ দফা পেশ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করা এবং আল জাজিরা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কঠোর পদক্ষেপের মূলে রয়েছে সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক। কাতার ইরানের সঙ্গে মিলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন করছে।

শক্তিশালী সৌদি আরব কাতারকে দেখছে এমন একটি বিরক্তিকর প্রতিবেশী হিসেবে। যাদের রয়েছে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেতে যারা আগ্রহী।

Advertisement

কিন্তু অবরোধ আরোপের পাঁচ সপ্তাহ পরেও কাতার দাবি মানেনি, বরং তারা ইরান ও তুরস্ক থেকে খাদ্য আমদানি করছে।

তাহলে কি সৌদি আরব ও তার সহযোগীরা যা আশা করেছিল, ফলাফল হচ্ছে ঠিক তার উল্টো? আসুন হিসাবগুলো মিলিয়ে নিন।

ইরান ও তুরস্ক

কাতার নিজেদের দেশের ২৭ লাখ মানুষের দৈনন্দিন খাবারের চাহিদা মেটায় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আমদানি করে। কাতারের সঙ্গে ভূমির সংযোগ রয়েছে একমাত্র সৌদি আরবের; আর ওই পথে দেশটির প্রায় ৪০ শতাংশ খাদ্যপণ্য আসতো।

Advertisement

ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে বিশ্লেষক জেফরি স্ট্যাসি এবং বাসিমা আলগুসেন লিখেছেন, শুরু থেকেই সৌদি আরব ও তার সহযোগীরা ভুল করছে। তারা কাতারকে সরাসরি ইরান ও তুরস্কের হাতে তুলে দিয়েছে। কারণ একঘরে হয়ে পড়া কাতারের প্রয়োজন ছিল খাদ্য, আর ওই দেশগুলো দিয়েছে। 

তারা আরও বলছেন, অবরোধ আরোপের ফলে কাতার আর ইরানের মধ্যে কেবলই যে বাণিজ্য বেড়েছে তা নয়, বরং দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও জোরদার হয়েছে।

কাতারের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোরি মিলার ‘মরুরাজ্য থেকে বৈশ্বিক শক্তি : উপসাগরীয় আরবের উত্থান’ মিরোনামে একটি বই লেখেন। সেখানে উল্লেখ করেন, সৌদি জোট যা ভেবেছিল তা ঘটেনি। এমন কোনো বিজয় তাদের ঘটেনি যার মাধ্যমে বলা যায় উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরব-আমিরাতই সবচেয়ে চৌকশ খেলোয়াড়।

তিনি আরও লেকেন, এই সংকট কাতারকে তুরস্ক ও ইরানের আরও কাছে নিয়ে গেছে। সংকটের কারণে আগামীতে কাতার হয়তো ইরান সম্পর্কে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের নীতি অনুসরণ করবে না।

অতিরঞ্জন

লন্ডনে রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের আরব উপদ্বীপ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পিটার সালিসবারির মতে, সময়মত যেহেতু পরিণাম মেলেনি, সেকারণে বলা চলে কিছুটা উল্টো ফল হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, কাতার ইরানের হাতে চলে গেছে, এমন বক্তব্য অতিরঞ্জন ছাড়া কিছুই নয়। কাতার ইরানকে বিশ্বাস করে না। আবার ইরানও কাতারকে বিশ্বাস করে না। যদিও তারা অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের সহযোগিতা করছে, তবে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাসের ইতিহাস বহু পুরনো। 

ইরান এখন কাতারের কাছে খাদ্য বিক্রি করছে; কারণ এটা খুব ভাল ব্যবসা। একই সঙ্গে সৌদি আরবকে মর্মাহত করে এমন সুযোগ কাজে লাগানো তাদের জন্য খুব ভাল রাজনীতি বলেও মনে করেন তিনি। 

তবে কাতার, ইরান আর তুরস্ক মিলে নতুন বিন্যাস গড়ে ওঠার ধারণা অতিরঞ্জন ছাড়া কিছুেই নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

জঙ্গি গোষ্ঠী

কাতারের কাছে অন্যতম দাবি হল মুসলিম ব্রাদারহুড, হামাস, অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা। কিন্তু নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাতার খোলাখুলিভাবে এটা দেখাতে পারে না যে তারা এদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। 

অন্যদিকে, এসব গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে গিয়ে কাতারের নেতারা নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলবেন না বলে মনে করেন রোরি মিলার।

মিলার বিশ্বাস করেন, চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যে যে জঙ্গিবিরোধী চুক্তি সই হয়েছে, তা সংকট নিরসনে একটি চাবিকাঠি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, কাতারের নেতাদের সমর্থনের যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, তার বিনিময়ে দোহা সম্ভবত হামাস আর মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন কমাবে। তবে এসব ঘটবে পর্দার অন্তরালে।

বিকল্প পরিকল্পনা

সৌদি আরব, বাহরাইন, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বলছে, দাবির ব্যাপারে কাতার সাড়া না দেয়ায় তারা জুতসই সময়ে নতুন পদক্ষেপ ঘোষণা করবে।

কিন্তু কী হতে পারে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ? রোরি মিলার মনে করেন, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, যাতে মনে হতে পারে এসব দেশের বিপরীত পরিকল্পনা রয়েছে।

দার ধারণা, কাতার-বিরোধীরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আংশিকভাবে এর কারণ হতে পারে, পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপ না হয়, সে বাপারে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। অন্যদিকে, এর ফলে উপসাগরীয় এলাকায় ইরান ও তুরস্কের প্রভাব আরও বাড়তে পারে, এমনকি এসব দেশের সঙ্গে সংঘাতও বাঁধতে পারে।

অসাড়তা

আলাদা পরিকল্পনা না থাকার কারণে দুই পক্ষই সম্ভবত এক ধরনের কূটনৈতিক পক্ষাঘাতগ্রস্থতার মধ্য দিয়ে যাবে। তবে মিলার বিশ্বাস করেন না যে দুই পক্ষ খুব দ্রুতই পিছু হটবে।

এখানে দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এই সংকটের সমাধানে কী ব্যবস্থা নেয়। কারণ কাতারে তাদের স্বার্থ রয়েছে। দেশটিতে তাদের রয়েছে ১১,০০০ সৈন্য সহ মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।

সালিসবারি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোনো নীতি এক্ষেত্রে নেই। একদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি মারমুখি অবস্থান নিয়ে আছেন। অন্যদিকে, ওয়াশিংটনে অনেক রাজনীতিক এই সংকটের সমাধান চান।

তার মতে, একটি সমস্যা হলো বাইরে থেকে যারা সংকট দেখছেন, তাদের দেখার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। অনেকেই চান একটি দ্রুত সমাধান।

তিনি বিবিসিকে বলেন, সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর অবরোধ চালিয়ে যেতে চায়। তাদের আশা, কাতার এক সময় এর প্রভাব টের পাবে।

তিনি আরও বলেন, এখানে মূল কথা হল কাতার বিশ্বের নানা দেশে গ্যাস রফতানি করে টাকা আয় করে। সেজন্য তাদের প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভর করতে হয় না। কাতার এটাই দেখাতে চাইছে যে, তারা দীর্ঘ সময় এভাবেই চলতে পারবে। যতদিন গ্যাসের চাহিদা আছে, আর এর জন্য ভাল দাম পাওয়া যাবে, ততদিন কাতার নিজেকে চালিয়ে নিতে পারবে। বিবিসি বাংলা।

কেএ/পিআর