মতামত

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়

কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেই আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের আবেগ কমে যায়, বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, আইনের ফাঁক গলিয়ে পার পেয়ে যায় মূল অপরাধীরা।দৃষ্টান্তটা আর হয় না। কিন্তু আশা করি, এরপর আর দৃষ্টান্ত পেতে দূর দূরান্তে হাতড়ে বেরাতে হবে না আমাদের। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের মামলার রায়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়েছে। ৩৫ আসামির সবাই সাজা পেয়েছে। ২৬ জনের ফাঁসি আর বাকি ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। দিনে-দুপুরে ৭ জন মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ায় সারাদেশে যতটা আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, রায়ে ততটাই স্বস্তি এসেছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে সরকারি দলের নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রভাবশালী সদস্যরা জড়িত থাকায় এর বিচার নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু রায়ের পর প্রাথমিক সংশয় দূর হয়েছে। একটা বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, সরকার বা সরকারের কোনো বাহিনী বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। আইন চলেছে তার নিজস্ব গতিতে। তারপরও আমাদের সংশয় যায় না। চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়েছে, তাই দই দেখলেও আমরা ভয় পাই।আমি সবসময় গ্লাস অর্ধেক ভরা দেখি। তবে চারপাশে গ্লাস অর্ধেক খালি বলার লোকেরও কমতি নেই। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলার রায়ে আমি সন্তুষ্ট, আমি একে আইনের শাসনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ বলেই মানি। মূল পরিকল্পনাকারী আওয়ামী লীগ নেতা, মূল বাস্তবায়নকারী র্যাবের বড় কর্তা নন শুধু, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাতাও। কিন্তু রায়ে ফাঁসি হয়েছে সবারই, মোট ২৬ জনের। কিন্তু তাতেও অনেকে সন্তুষ্ট নন। একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক লোক সবসময় তার প্রতিপক্ষের একজনের খারাপ চান। তো প্রতিপক্ষের সন্তান যখন স্কুলে ভর্তি হতে গেল, সেই লোক বললো, চান্স পাবে না। চান্স যখন পেলো, বললো, পাস করবে না। পাস যখন করলো, বললো, চাকরি পাবে না। চাকরি যখন পেলো, তখন বললো, বেতন পাবে না। তো এই অবস্থা এখানেও। রায় হওয়ার পরপরই অনেকের হাহাকার, এ রায় কার্যকর হবে না। আপিলে খারিজ হয়ে যাবে। না হয় রিভিউ, আর না হলে মাফ করে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি তো আছেনই। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি বসেই আছেন ভয়ঙ্কর সব খুনিদের মাফ করে দেয়ার জন্য। তার বুঝি আর কোনো কাজ নেই।তবে তাদের এই শঙ্কাও একদম উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। আগেই যে চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়, সাংবিধানিক প্রটেকশনে ঘুরে বেরিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রী হয়েছে। এই সরকারের আমলে লক্ষ্মীপুরের আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লবের ফাঁসি মাফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। সকল বিচারিক প্রক্রিয়া শেষেও রাষ্ট্রপতি চাইলে যে কাউকে প্রাণভিক্ষা দিতে পারেন। এটা তার সাংবিধানিক ক্ষমতা, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না। আদালতে হয়তো প্রশ্ন তোলা যাবে না, কিন্তু রাষ্ট্রপতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলতে তো বাধা নেই। বিপ্লবের ফাঁসি মওকুফের নৈতিক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনও। এ কারণেই এত শঙ্কা। বাংলাদেশে একজন মন্ত্রীর জামাতা, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের, সরকারি দলের নেতাদের ফাঁসি হয়ে যাবে; অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের এই বাস্তবতা বিশ্বাস করার সাহস দেয় না।তবে ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। বর্তমান রায় নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। ভবিষ্যতে যদি কখনো অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, অবশ্যই প্রতিবাদ করবো। ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আমি বর্তমানের সন্তুষ্টিকে জলাঞ্জলি দিতে রাজি নই।২০ জানুয়ারি, ২০১৭এইচআর/এআরএস/এমএস

Advertisement