গতকাল ছিল বিজয় দিবস। উৎসবের আমেজ ছিল দেশজুড়ে। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন উদ্যমে পালন করছে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর প্রক্রিয়ায় ইতিহাসকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। গত কয়েকদিন ধরেই একথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিবছরই হয় মার্চ আর ডিসেম্বরে। তারপর আবার ভুলে যাই আমরা। ভুলে যেতে যেতে একদিন কি সত্যি ভুলে যাবো এমন গৌরবের ঠিক ইতিহাস? ভয় এখানেই, কারণ স্মৃতিচারণের লোকও কমছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর গেছে, যারা যুদ্ধ করেছেন তারা সংখ্যায় কমছেন, অনেকেই বয়সের ভারে নুয়ে আছেন।বাংলাদেশের জন্য যারা জীবন বাজি রেখে ১৯৭১-এ যুদ্ধ করেছেন, ভারতের কিছু সৈনিক শোনালেন যুদ্ধদিনের কথা। তারা সেইসব রোমাঞ্চকর দিনের কথা বলছিলেন রাজধানীতে গত বুধবার। আর্মি গলফ কোর্সের পামভিউ রেস্টুরেন্টে এই আসর জমেছিল বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আসা মিত্র বাহিনীর ২৮ সেনা কর্মকর্তা আর তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে যুদ্ধ করা এই দেশের সেনাদের মাঝে।দীর্ঘ নয় মাস মুক্তির সংগ্রাম করে যে বিজয় অর্জন তার গল্প এখন অনেকেরই জানা। কিন্তু থেকে গেছে হয়তো আরও কিছু অজানা গল্প। এসব শুনতে শুনতে কেবল একটি কথাই মনে হচ্ছিল যদি লিপিবদ্ধ না হয় তাহলে কে জানবে সেই ইতিহাস? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোটাই রাজনৈতিক যুদ্ধ। আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ এ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানতো আছেই, সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ইতিহাস বিকৃতি হয় তখনই যখন এমন এক রাজনৈতিক জনযুদ্ধকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয় আকস্মিক কোন একজনের এক ঘোষণার সাথে। মানুষ তার জীবন বাজি রেখেছে, জীবন দিয়েছে রাজনৈতিক কারণে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ডাকে। বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। কিন্তু তিনি অনুপস্থিত থাকলেও পুরো যুদ্ধটাই হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। তাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান ছিলেন একজন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। আর কোন নাম ছিল না তখন। বঙ্গবন্ধুর নামেই এদেশের সব শ্রেণির মানুষ যুদ্ধে গিয়েছিল, কোন এক অজানা লোকের জন্য নয়।তাই যারা এই যুদ্ধে একটি ঘোষণা দেখে কেবল, তারাই ১৯৭৫ এর পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নাম লিখতে দিতোনা স্কুল পাঠ্য বইয়ে, গণমাধ্যমে। লিখতে হতো হানাদার বাহিনী। রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের বর্বরতার কথা। এখনো সেই রাজনৈতিক শক্তির বিবৃতিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের কথা উচ্চারিত হয় না। হয় না পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসরদের কথা। যারা ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিয়েছিল, তারাই আল-বদর কমান্ডারদের মন্ত্রী করেছিল। তারাই শহীদের সংখ্যা নিয়ে এখনো বিতর্ক করার চেষ্টা করে।দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। চলছে যুদ্ধাপরাধের বিচার। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি থেমে নেই। একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে কথা বলে পাকিস্তান। কিন্তু দেখা গেলো এমন প্রশ্ন তুলছে এদেশেরও কেউ কেউ। গতবছর এমন একটি কথা বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়ার মুখ থেকে এমন বক্তব্য আসার পর স্বভাবতই দাবি উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির শাস্তি দিতে আইন প্রণয়ন করতে হবে। ‘হলোকাস্ট ডিনায়াল অ্যাক্ট’র মতো বাংলাদেশেও আইন প্রণয়নের দাবি এখন সর্বত্র উচ্চারিত। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় পাকস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও রাহাজানির ঘটনাকে অস্বীকার, প্রত্যাখ্যান বা কমিয়ে দেখানোর অপচেষ্টা পাকিস্তানিরাতো করছেই, করছে এদেশের অনেকেই। এদেশের যারা এমনটা করছে তাদের সেই অপচেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তবে, এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র কোন আইন না থাকায় এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বই, পত্র-পত্রিকা, ব্লগ, সভা সেমিনার, টিভি টকশোতে দেদারসে মুক্তিযুদ্ধ, এর ইতিহাস, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের ভয়ংকর সব কাহিনীর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করছে জাতিকে। পৃথিবীর নানা দেশে এ ধরনের আইন আছে। অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, স্পেনসহ নানা দেশে তাদের মতো করে ইতিহাস বিকৃতি, গণহত্যা অস্বীকার করা বিরোধী আইন আছে। প্রশ্ন হলো তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকছি এমন ব্যবস্থা থেকে? আগামীকাল আমরা কেমন সমাজ গড়ব, তার নির্দেশ পেতে গেলে গত কালের কাছে আমাদের যেতেই হবে। তাই উন্নয়নের পথে যাত্রায় আমাদের যে প্রচেষ্টা তার জন্য বারবার আমাদের ফিরতে হবে একাত্তরে। অনেকেই বলবেন আসল অতীতকে সেভাবে পাল্টানো বা কাটাছাঁটা যায় না। নথি নিশ্চিহ্ন করা যায়, স্মৃতি লোপ করা যায়, তবু বাস্তব ইতিহাস থেকেই যায়। একথা মেনে নিয়েও বলতে হবে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভুল আর মিথ্যা ইতিহাস শেখানো হয়েছে। আজ সময় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে বাধ্যতামূলক করা। কাজটি যত তাড়াতাড়ি শুরু হবে, ততই মঙ্গল দেশের জন্য, কারণ ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শীরা কেবলই হারিয়ে যাচ্ছেন, সংখ্যায় বাড়ছে বিকৃতিকারীরা। লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি। এইচআর/এমএস
Advertisement