আফসান চৌধুরী। সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। জন্ম ১৯৫৪ সালে ঢাকায়। সাংবাদিকতা জীবনে ঢাকা কুরিয়ার, দ্য ডেইলি স্টার ও বিবিসিতে কাজ করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র প্রকল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। গবেষণাধর্মী কাজের পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্যেও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অবদান। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। ধারাবাহিক চার পর্বের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির কথা বলছিলেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব। ১৯৪৭ সালের পরে এসে তা কী রূপ ধারণ করলো?আফসান চৌধুরী : বঙ্গীয় মুসলিম লীগ এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম এক ছিল না। পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্রে যারা ছিলেন, তাদের কাছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের বাস্তবতা আর বাংলার মানুষের কাছে বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। ত্রি-জাতি তত্ত্ব হতে পারত। অনেকেই দ্বি-জাতি তত্ত্বকে সাম্প্রদায়িক বলেন। আমি তা মনে করি না। নিজেদের স্বার্থের জন্য এমন হাজারো তত্ত্ব সামনে আসতেই পারে। এ সময়ই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং শেখ মুজিবের মতো মানুষকে পাওয়া, যার বিনিময়ে ১৯৭১ পেলাম।জাগো নিউজ : এই সময় তো আরও নেতৃত্বও আসলো। তাদের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী? আফসান চৌধুরী : অনেকেই ছিলেন। এদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্ব সর্বাগ্রে। কিন্তু এই দুই নেতার ওপর নির্ভর করার সুযোগ ছিল না। যদিও তাদের ভূমিকা ইতিহাসের অন্যতম অধ্যায়। কিন্তু জাতিসত্ত্বার প্রশ্নে শেখ মুজিবের ওপর শতভাগ নির্ভর করা যেত। তিনি ছিলেন প্রথম থেকেই পূর্ববঙ্গীয়। অন্য নেতাদের নিয়ে লিখতে হলে জানতে, বুঝতে ও তুলনা করতে হয়। কিন্তু শেখ মুজিবকে নিয়ে লিখতে গেলে এত জানা লাগে না। কারণ তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন মানুষ। জাগো নিউজ : দ্বিধাহীন নেতৃত্বের কথা বলছেন। কিন্তু পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের জন্য তো শেখ মুজিবকে ভারতীয় নেতৃত্বের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। গোপন আঁতাতের কথাও প্রচার আছে? আফসান চৌধুরী : ১৯৬১ সালে ভারত গিয়ে বৈঠক করার পর শেখ মুজিব আর কখনো গোপন রাজনীতি করেননি। তার নেতৃত্ব একেবারেই প্রকাশ্যে চলে আসল এই সময়ে। ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ অবশ্যই এই প্রেক্ষাপট চালু করে দিল। জাগো নিউজ : শেখ মুজিবের বাইরে আর কোনো নেতৃত্ব, যারা পাকিস্তানবিরোধী...আফসান চৌধুরী : ইস্ট লিবারেশন পার্টি পাকিস্তান ভাঙতে চাইল। কিন্তু তাদেরও আটকে ফেলা হলো। জামালপুরের আলী আহসান ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন গঠন করে আন্দোলন করেছিল। ভারতে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকও করেছিল। ওস্তাদ ফজলুল হক নামের আরেকজন ছিল ওই দলে। সরকারি সহায়তা না পেলেও কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে ভারত থেকে ফিরে আসেন তারা। দেশে আসার পর তাদের আটক করা হয়।জাগো নিউজ : বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে কি বলবেন? আফসান চৌধুরী : ষাটের দশকে সব রাজনৈতিক দলই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে ভিড়তে শুরু করে। তবে রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্টরা দূরে থাকল। মস্কোর সিদ্ধান্ত ছাড়া তারা কিছু করতেও পারেনি। ১৯৬১ সালে ভারতে গিয়ে শেখ মুজিব খোকা রায়কে বললেন, আমি দেশ স্বাধীন করব, পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবো না। তখন কমরেড ফরহাদরা বললেন, আপনি তো সোহরাওয়ার্দীর লোক। শেখ মুজিব বললেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার জায়গায়, আমি আমার জায়গায়। সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু বটে। কিন্তু শেখ মুজিব নিজের বুদ্ধিতেই এগিয়ে যান। অনেকেই মনে করেন শেখ সাহেব গোয়ার ছিলেন। এটি ভুল কথা। তার মতো বুদ্ধিমান নেতা দ্বিতীয়টি ছিল না। শেখ সাহেবও কমরেড মণি সিং এবং কমরেড ফরহাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। তারা জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা রাশিয়ার সিদ্ধান্ত ছাড়া কথা বলতে পারব না। তখন শেখ সাহেব সিলেটের সেই মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর কাছে গেলেন। তিনিই ১৯৬১ সালে ভারতে খোকা রায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। আমি মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এসব জানতে পারি। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবিই আসলে রাজনীতির চিত্র পাল্টে দেয়। রাজনীতির সব কিছু ছাপিয়ে উপরে উঠে গেল ৬ দফা দাবির আন্দোলন। ১৯৪৮ সালের হরতাল, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল` জারির মধ্য দিয়েই ৬ দফার পূর্ণ বিকাশ ঘটতে থাকে। জাগো নিউজ : ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠন এবং বামপন্থীদের এখানে সম্মিলন ঘটলো। এই ঘটনা শেখ মুজিবকে বিশেষ সুবিধা দিল কিনা? আফসান চৌধুরী : ১৯৫৭ সালে ভাসানী ন্যাপ গঠন করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ চালু করেন। এই সময় আওয়ামী লীগও দুর্বল ছিল। এরপরও বামপন্থীরা কিছুই করতে পারলো না। ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বামপন্থীরা আরও দুর্বল হলো। স্বাধিকার আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। ইতিহাস চর্চা করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। ভালো হোক, খারাপ হোক শেখ সাহেব এগিয়ে গেছেন, তার সিদ্ধান্তেই। তার কোনো পিছুটান ছিল না। এটি বামদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। পরবর্তীতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও তার ভুল বুঝলেন।জাগো নিউজ : কিসের ভুল? আফসান চৌধুরী : ১৯৬৯ সালের একটি গল্প বলি। সাংবাদিক আতাউস সামাদ ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তখন কাভার করছেন। একদিন জেলখানায় শেখ মুজিব সাহেব সামাদ ভাইকে ডেকে বলছেন, হুজুরের (ভাসানী) কাছে গিয়ে বলবি, সময় হয়ে গেছে। সামাদ ভাই বললেন, এইটুকু বললেই হবে? শেখ সাহেব বলছেন, হ্যাঁ। ভাসানী তখন ইস্কাটনে ছাইদুল হকের বাসায়। সিরাজুল ইসলাম খানও ছিল সেখানে। তখন সামাদ ভাই ভাসানীকে পাশের ঘরে নিয়ে বললেন, হুজুর লিডার আপনার কাছে এই বার্তা দিতে বলেছেন যে, ‘সময় হয়েছে, তিনি প্রস্তুত।’ ভাসানী প্রশ্ন করলেন, সত্যি তাই বলেছেন? জবাবে সামাদ ভাই আবারও বলেন, হ্যাঁ তাই বলেছেন। তখন ভাসানী বললেন, ঠিক আছে। সিরাজুলকে ডাকো। আগামীকালই পাকিস্তানের গায়েবানা জানাজা পড়বো। জাগো নিউজ : তার মানে তখনও মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ? আফসান চৌধুরী : হ্যাঁ, নইলে এমন ভরসার কথা কেমনে বলেন? ভাসানী বড় দুঃখ পেয়েছিল যে, বামপন্থীদের দিয়ে আর কিছু হবে না। এ কারণেই শেখ মুজিবের জন্য ভাসানী জায়গা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের বিপক্ষে একমাত্র ভাসানীই নির্বাচন করার যোগ্যতা রাখছিলেন তখন। কিন্তু নির্বাচন না করে শেখ মুজিবকে জায়গা করে দিলেন। অথচ সমালোচকরা বলেন, ভাসানী বিদ্রোহ করে নির্বাচনে যায়নি। জাগো নিউজ : কিন্তু বামপন্থীদের অনেকেই মনে করেন, এটিই ছিল ভাসানীর রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত? আফসান চৌধুরী : অনেকেই অনেক কিছু মনে করতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসে প্রমাণিত বামপন্থীরা কোনো সফলতা আনতে পারেনি। নির্বাচনে জেতার কোনো ইতিহাস নেই। যে কারণে শেখ মুজিবকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন ভাসানী। বামপন্থীদের নৈতিকতার ইতিহাস থাকতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরে বামপন্থীদের কিছু করার ইতিহাস, এমন নজির নেই। জাগো নিউজ : এক পক্ষের দ্বিধা আর অপর পক্ষের সফলতার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ। সাধারণ মানুষ কি পেল? আফসান চৌধুরী : সবাই যুদ্ধ করলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি হয়েছে বড়লোকের। এটি প্রমাণিত। এ রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের জন্য কোন বিষয়টি দাঁড়িয়ে আছে যে, যার ওপর গরিব মানুষ ভর করতে পারে? জাগো নিউজ : এ যুদ্ধও তো মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণে থাকল? আফসান চৌধুরী : হ্যাঁ। মুক্তিযুদ্ধও মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণে হয়েছে। মুজিবনগর সরকার মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করেছে, যদিও যুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জাগো নিউজ : এ কারণেই কি মুক্তিযুদ্ধের পরপরই চেতনার সংকট দেখা দিল? আফসান চৌধুরী : যুদ্ধের পর তো মধ্যবিত্তরাই ক্ষমতায় এল। টাকাওয়ালা, ব্যবসায়ী শ্রেণিই ক্ষমতায় বসল। আমরা কয়জন মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান দেখাই? যে মুক্তিযোদ্ধার টাকা, ক্ষমতা আছে সেই মুক্তিযোদ্ধাকেই সম্মান করি। মুক্তিযুদ্ধের যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি তো মনে করেন, ভারতই বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়েছিল। তবে জোর দিয়ে তিনি বলেন, অস্ত্রধারী মানুষের চেয়ে সাধারণ মানুষের ভূমিকাই বেশি ছিল। সাধারণ মানুষই তাদের বাংলার পথঘাট চিনিয়ে সহায়তা করেছেন। তবে যৌথবাহিনীর মধ্যে ভারতীয় সৈন্যের আধিক্য ছিল, তা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এএসএস/জেএইচ/আরআইপি
Advertisement