আন্তর্জাতিক

কাস্ত্রোর পাঁচ দশক

কিউবার ইতিহাসে ফিদেল কাস্ত্রো এক মহান বিপ্লবী নেতা। তার হাত ধরেই কিউবাকে পেয়েছিল সাধারণ জনগণ। ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অভিবাসী পরিবারে জন্মেছিলেন এই বিপ্লবী নেতা। পুরো নাম ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ হলেও তিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধু কাস্ত্রো নামেই পরিচিত। ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন কাস্ত্রো। মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণী ও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবিচার, দারিদ্র, বেকারত্ব ও নিম্ন মজুরীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে খুব কম সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি।১৯৫২ সালে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন ফিদেল। নির্বাচনে পিপলস পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়।  বিপ্লবের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মাত্র ১২৩ জন নারী-পুরুষের একটি সশস্ত্র দল নিয়ে ১৯৫৩ সালে মনকাডা আর্মি ব্যারাকে হামলা করেন ফিদেল। সংঘর্ষে ফিদেলের দল পরাস্ত হয় এবং তার প্রায় ৮০ জন সহযোদ্ধাকে বাতিস্তার নির্দেশে হত্যা করা হয়।তবে ফিদেলকে হত্যা না করে বিচারের মুখোমুখি করেন বাতিস্তা। মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা পরবর্তীতে ‘হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোলভ মি’ বা ‘ইতিহাস আমার পাপমোচন করবে’ নামে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ওই দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে কিউবার রাজনৈতিক সংকট এবং তার সমাধানের পথ নির্দেশ করেন তিনি। এতে রাতারাতি দেশব্যাপী বিখ্যাত হয়ে উঠেন ফিদেল। বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হলেও প্রবল জনমতের কাছে পরাজিত হয়ে দু’বছরের মাথায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় বাতিস্তা সরকার।মুক্তি পাওয়ার পর বিপ্লবী দল গড়ার লক্ষ্যে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল। সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন করে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডা এবং অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে প্রায় ৮০ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে আবারো কিউবায় ফিরে আসেন তিনি। ১৯৫৯ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কিউবার মার্কিন সমর্থিত একনায়ক ফুলগেন্সিও বাতিস্তাকে উৎখাত করে যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ শতকের কিংবদন্তীতে পরিণত হন কাস্ত্রো। স্নায়ুযুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদের জয়জয়কারের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে টিকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। সে সময় তিনি তার সরকারে চে গুয়েভারাকে নিয়োগ দেন। ১৯৬০ সালে কাস্ত্রোর শাসন ব্যবস্থা পুরাতন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে হটিয়ে নতুন দিনের সূচনা করে। আমেরিকান মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং অর্থনীতি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত হতে শুরু করে। হাভানার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে ফেলার পর কিউবা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে সফল হয়। ১৯৬১ সালে কিউবা কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় ফিদেল কাস্ত্রো রাজনৈতিক জীবন শুরু করার পর কিউবার রাজনীতিতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। ১৯৬২ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক আরো দৃঢ়  হতে শুরু করে। এরপর ১৯৬৫ সালে তিনি কিউবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হন এবং কিউবাকে একদলীয় সমজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রূপ দেন।১৯৬৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন ফিদেল কাস্ত্রো। সেসময় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ফিদেল কাস্ত্রোর রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাবে ১৯৬৫ সাল থেকেই কিউবার রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন চে গুয়েভারা। দু’বছর পর বোলিভিয়ার সরকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন চে গুয়েভারা। ধরা পড়ার দু’দিন পরেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।  ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনে সমর্থন জানায় কিউবা। অ্যাঙ্গোলা এবং ইথিওপিয়ায় গৃহযুদ্ধ প্রভাবিত করতে সামরিক সহায়তা পাঠায় দেশটি। এতে বেশ বিতর্কের জন্ম দেয় কিউবা।কিউবা বিপ্লবের প্রধান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাস্ত্রো। ২০০৬ সালে থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সাময়িকভাবে নিজের ভাই রাওল কাস্ত্রোকে ক্ষমতা অর্পন করেন ফিদেল কাস্ত্রো। তবে শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ার পাঁচ দিন আগেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন কাস্ত্রো। সেসময় থেকেই রাওল কাস্ত্রো দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় সময় শুক্রবার রাতে ৯০ বছর বয়সে হাভানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই মহান বিপ্লবী নেতা। সমর্থকদের কাছে কাস্ত্রো ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি জনগণের কাছে কিউবাকে নিজেদের দেশ হিসেবে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে তার বিরোধীরা অনেক বিষয়েই কাস্ত্রোর সমালোচনা করে থাকেন। মহান এই নেতা যুগে যুগে নিজের ভক্ত এবং সমর্থকদের মাঝে বার বার ফিরে আসবেন। কারণ মহান নেতাদের মৃত্যু নেই। হয়তো ক্ষণকালের জন্য পৃথিবীর মায়া থেকে দূরে থাকেন তারা। তবুও মানবতা, সমাজ এবং সভ্যতার তাগিদে তারা বার বার ফিরে আসেন, আসবেন।টিটিএন/এমএস

Advertisement