ময়মনসিংহে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি ভাঙা হচ্ছে—সম্প্রতি এমন দাবি করে কিছু গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যে বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে সেটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব নেই।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানানো হয়। এতে বলা হয়, ময়মনসিংহে যে বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে তা সত্যজিৎ রায়ের নয়। এটি সরকারের খাসজমিতে শিশু একাডেমির পুরোনো ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসা বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অপসারণ করা হচ্ছে।
এমন অবস্থায় বিভ্রান্তি ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সরকার।
এর আগে গণমাধ্যমে এ সম্পর্কিত খবর প্রকাশের পর ময়মনসিংহে ‘সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি’ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় ভারত। গত মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাড়িটি সংস্কার ও পুনর্নির্মাণে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক নয়াদিল্লি।
Advertisement
এদিকে বাড়িটির ইতিহাস সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র জানিয়েছে, যেই বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে, সেটি মূলত স্থানীয় জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী তার কর্মচারীদের জন্য তৈরি করেছিলেন। এটি তার বাংলো ‘শশী লজ’র পাশে অবস্থিত। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর বাড়িটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিকে বরাদ্দ করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দীর্ঘদিন জেলা শিশু একাডেমির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর ২০১৪ সালে বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এরপর একাডেমি ময়মনসিংহ শহরের অন্যত্র ভাড়া করা স্থানে কার্যক্রম চালায় এবং পুরোনো বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরিত্যক্ত অবস্থায় এটি স্থানীয় অসামাজিক কর্মকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে শিশু একাডেমির জন্য আধাপাকা নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, শিশু একাডেমি জেলা প্রশাসনকে পুরোনো ভবনটি নিলামের মাধ্যমে অপসারণের অনুমতি দেয়। নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৭ মার্চ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় এ বিষয়ে সাধারণ জনগণকে অবহিত করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জেলা প্রশাসনের রেকর্ড পর্যালোচনা করে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, বাড়িটি এবং তার জমির সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি সরকারের খাসজমি, যা শিশু একাডেমিকে দীর্ঘমেয়াদি লিজে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রবীণ নাগরিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিরাও বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
Advertisement
সরকারের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বাড়িটির সামনের রাস্তার নাম ‘হরকিশোর রায় রোড’, যা সত্যজিৎ রায়ের প্রপিতামহ হরকিশোর রায়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তবে রায় পরিবারের যে বাড়িটি একসময় এই রাস্তায় ছিল, তা বহু বছর আগে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে নতুন মালিক বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় জ্যেষ্ঠ নাগরিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় লেখক কাঙ্গাল শাহীন বলেন, ‘যে বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে, সেটি কোনোভাবেই হরকিশোর রায় বা সত্যজিৎ রায়ের নয়।’
অধ্যাপক বিমল কান্তি দে এবং কবি ফরিদ আহমেদ দুলালও জানান, বাড়িটির সাথে রায় পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এ নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
সভায় সবাই শিশুদের স্বার্থে শিশু একাডেমির নতুন ভবন দ্রুত নির্মাণের পক্ষে মত দেন এবং অযথা গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানান।
ময়মনসিংহের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক স্বপন ধর বলেন, আলোচ্য বাড়িটি কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্মারক নয় এবং এটি সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা অসত্য।
সব নথির ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত না করতে এবং সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট না করতে সব পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, সঠিক তথ্য যাচাই না করে কোনো ভিত্তিহীন বক্তব্য বা প্রচারণা না চালাতে।
জেপি/বিএ/এমএস