৮ জুলাই! এই দিনে তিন বছর আগে বাংলা বিনোদন অঙ্গনের আকাশ থেকে খসে পড়েছিল দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তারা হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ ও কিংবদন্তি সুরকার আলম খান। ২০২২ সালের এই দিনে চিরদিনের মতো তারা বিদায় নিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে।
Advertisement
সময় গড়িয়ে গেলেও সংস্কৃতি অঙ্গনে তাদের অবদান, কর্ম ও জীবনাচরণ আজও গভীরভাবে মনে রেখেছে এ দেশের মানুষ।
১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া শর্মিলী আহমেদের প্রকৃত নাম মাজেদা মল্লিক। তিনি অভিনয় শুরু করেন মাত্র চার বছর বয়স থেকে। রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে নাম লেখান শর্মিলী। এর মধ্যে অবশ্য প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ (উর্দু ভাষায় নির্মিত) আলোর মুখ দেখেনি। তবে সুভাষ দত্তের ‘আলিঙ্গন’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ এবং ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্র দিয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
শর্মিলী আহমেদের স্বামী রকিবউদ্দিন আহমেদও ছিলেন পরিচালক। তার নির্মিত ‘পলাতক’ সিনেমাতে অভিনয় করেছেন শর্মিলী আহমেদ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আরও কিছু উর্দু সিনেমাতেও তিনি অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পর ‘রূপালী সৈকতে’, ‘আগুন’, ‘দহন’-এর মতো জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রে ছিল তার সরব উপস্থিতি।
Advertisement
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে প্রায় ৪০০ নাটক ও ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন শর্মিলী আহমেদ। অভিনয়জীবনে মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সবার মন জয় করেছেন সাবলীল অভিনয় দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘দম্পতি’-তে অভিনয় করেছেন। ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ মহসিন পরিচালিত ‘আগুন’ সিনেমায় মায়ের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিরলসভাবে মমতাময়ী মা চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
অভিনয়জীবনে মায়ের চরিত্রে এত বেশি অভিনয় করেছেন যে, বিনোদন অঙ্গনে তিনি সবার কাছে ‘মা’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সবাই তাকে ‘শর্মিলী মা’ বলেই ডাকতেন।
অন্যদিকে ১৯৪৪ সালে সিরাজগঞ্জে জন্ম নেওয়া আলম খান ছিলেন সুরের জাদুকর। ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কি জাদু করিলা’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘সাথীরে যেও না কখনো দূরে’, ‘কাল তো ছিলাম ভালো’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া’ ইত্যাদি কালজয়ী সব গান উপহার দিয়েছেন তিনি। এসব গানেই তিনি বেঁচে রইবেন অনন্তকাল।
বিশেষ করে চলচ্চিত্র সংগীতে তার ছিল রাজত্ব। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আলম খান শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৮২ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এর পর তিনি ‘তিন কন্যা’ (১৯৮৫), ‘সারেন্ডার’ (১৯৮৭), ‘দিনকাল (১৯৯২) এবং ‘বাঘের থাবা’ (১৯৯৯), ‘এবাদত’ (২০০৯) সিনেমাগুলোতে একই পুরস্কারে ভূষিত হন। শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে ২০০৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ‘কি জাদু করিলা’ সিনেমার জন্য। তবে ক্যারিয়ারে সবচেয় বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা, এমনটাই মনে করতেন তিনি।
Advertisement
কর্মজীবনে আলাদা আলাদা আলো ছড়ালেও দুজনের বিদায় হয়েছিল একই দিনে। এই দিনটি তাই শুধু একটা মৃত্যুবার্ষিকী নয়, বাংলা সংস্কৃতির হৃদয়ে খোদাই হয়ে যাওয়া একটি ক্ষত।
তাদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা। তারা নেই, কিন্তু ভালোবাসায় তারা চিরকাল থাকবেন অমর হয়ে।
এলআইএ/জেআইএম