বিশ্বের আনাচে কানাচে এখনো অনেক উপজাতিরা বাস করেন যারা আধুনিক জীবন থেকে যোজন যোজন দূরে। তারা জানেন না বহির্বিশ্বের ঝা চকচকে জীবন, ইন্টারনেট বা এআইয়ের এই চমৎকার আশীর্বাদ আমাদের জীবনে যুক্ত হয়েছে। রোবট করে দিচ্ছে ঘরের কাজ।
Advertisement
অনেক জনগোষ্ঠী রয়েছেন এখনো বাস করছেন গভীর জঙ্গলে। বাস করছেন নিজেদের নিয়মে। খাবারের জোগান আসছে বন বা পশু শিকার করে। তেমনই এক জনগোষ্ঠী বাজাউ। কথায় আছে বাজাউ জনজাতির শিশুরা নাকি হাঁটতে শেখার আগেও শেখে সাঁতার কাটা, জলে ভাসা, আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রের গভীরে একদমে অনেকটা সময় ডুবে থাকা!
ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করে এই জনগোষ্ঠী যাদের জীবন জলকেন্দ্রিক। ওই জনজাতির মানুষেরা নিজেদের সঁপে দিয়েছেন সমুদ্রের কাছে। বাজাউদের কাহিনি শুনে কল্পচরিত্র ‘অ্যাকোয়াম্যান’-এর কথা মনে আসবে। তবে গল্প বলে মনে হলেও বাজাউ জনজাতি বাস্তবে রয়েছে। পানির নিচে একজন সুস্থ-সবল মানুষ দম নিয়ে যতটা সময় থাকতে পারে, এই জনজাতির মানুষেরা থাকতে পারে তার অন্তত দু’গুণ!
এই জাতির এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, যা অন্য সব উপজাতিদের থেকে আলাদা করেছে। তা হচ্ছে পানির নিচে দীর্ঘক্ষণ দম আটকে থাকার ক্ষমতা। আচ্ছা একজন সাধারণ মানুষ কতক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারেন? ৪০ সেকেন্ড, ৫০ সেকেন্ড বা বড়জোর ১ মিনিট। কিন্তু বাজাউ লাউতরা ১৩ মিনিট পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে পারে। দীর্ঘক্ষণ কাটাতে পারেন ২০০ ফুট গভীর জলে। এজন্য স্কুবা-ডাইভার হিসেবেও কাজ করেন এই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ। এটাই তাদের মূল পেশা।
Advertisement
এদের অনেকেই আছেন কখনো মাটির স্পর্শই পাননি। তাদের জীবন কেটেছে পানিতে ভেসে। সমুদ্রে ভেসেই তাদের জীবন পার হয়ে যাচ্ছে কয়েক প্রজন্ম ধরে। ঘর বলতে ছোট্ট নৌকা। ৫ মিটার বাই দেড় মিটারের এই নৌকায়ই বসবাস করেন তারা। সেখানেই থাকা, খাওয়ার বন্দোবস্ত। তবে অনেকে এখন পানিতেই ঝুলন্ত বাড়ি বানিয়ে বাস করে। তবে তা সাময়িক সময়ের জন্য।
হাজার ঝড়-ঝঞ্ঝায়ও সমুদ্র ছেড়ে তীরে আসেন না তারা। স্থলভূমির সঙ্গে কেবল তাদের ব্যবসায়িক যোগ। ব্যবসা বলতে সমুদ্র থেকে মাছ, কাঁকড়া শিকার করার সময় তারা সংগ্রহ করে আনেন মৃত কোরাল, অর্থাৎ প্রবাল। রত্ন হিসেবে যা বিক্রি হয় মোটা দামে। কেউ আবার মাছ শিকার করে তা জলের দরে বিক্রি করেন মূল ভূখণ্ডের মাছ বিক্রেতাদের কাছে।
‘বাজাউ লাউত’ আসলে জন্মগতভাবে যাযাবর ছিল না। এরা এক সময় ডাঙ্গায় বাস করতো। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিনসে মূলত বাস এই বিশেষ সম্প্রদায়ের। সাধারণ মানুষের ভাষায় তারা পরিচিত ‘সমুদ্র জিপসি’ নামেও।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই সম্প্রদায়ের মানুষরা আসলে মালয়েশিয়ার শহর জোহরের বাসিন্দা। আজ থেকে কয়েকশো হাজার বছর আগে তারা বসবাস করত সেখানে। সেখানে তখন রাজার শাসন। ভয়াবহ এক বন্যার শিকার হয়েছিল গোটা অঞ্চল। তাতে একদিকে যেমন বহু মানুষ গৃহহীন হয়েছিল, তেমনই স্রোতে ভেসে যান রাজ্যের খোদ রাজকুমারী। যেভাবেই হোক জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে রাজকুমারীকে, শোকাহত রাজা আদেশ দেন তার খাস কর্মচারীদের। রাজার কথা মেনেই তারা ছোট্ট ডিঙিতে চেপে পাড়ি দিয়েছিলেন সমুদ্রে। না, রাজকুমারীর দেহ খুঁজে পাননি তারা। এই ব্যর্থতার লজ্জায় আর দেশেও ফেরেননি তারা। সেই থেকে সমুদ্রযাপনের শুরু।
Advertisement
সমুদ্রের জিপসি নামের বাজাউ লাউতদের এই আশ্চর্য ক্ষমতা নব্বই দশকের শুরুর দিকে নজরে আসে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের। তাদের ওপর নানান গবেষণা করেন তারা। সেখান থেকেই জানা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী সমুদ্রযাপনের ফলে, ক্রমে জিনগতভাবে অভিযোজিত হয়েছে তারা। দীর্ঘায়িত হয়েছে তাদের প্লীহা। প্লীহার এই গঠনের কারণে বেশিক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে পারেন তারা। অনেকটা অন্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মতোই।
পাশাপাশি প্লীহা নিয়ন্ত্রণ করে শরীরে লোহিত কণিকার পরিমাণ। বেশি পরিমাণ লোহিত কণিকা উৎপন্ন হওয়ায়, এক দমে বেশি পরিমাণ অক্সিজেনও ফুসফুসে ভরে নিতে পারেন বাজাউ লাউতরা। গবেষকদের নজর কেড়েছে, তাদের ফুসফুসের আকার, ডায়াফ্রেমের দৃঢ়তাও। তবে ঠিক কী কারণে এই অভিযোজন-তা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেননি গবেষকরা।
তবে দীর্ঘক্ষণ সমুদ্রে ডুব দিয়ে থাকার এই প্রশিক্ষণ তাদের শুরু হয় ছোটবেলা থেকেই। অল্প বয়সে নিজেরাই ফাটিয়ে ফেলেন নিজেদের কানের পর্দা। তাতে কানের মধ্যে পানি জমে সংক্রমণের আশঙ্কা কমে ঠিকই, তবে ষাটের গণ্ডি পেরোলেই শ্রবণশক্তি হারান অধিকাংশ মানুষ। তবে এটা ক্রমেই রীতি হয়ে গেছে বাজাউ লাউত সমাজের।
আরও পড়ুন রাজসভা থেকে বাড়ির হেঁশেলে বিরিয়ানি বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ভাজা স্বাদের টানসূত্র: বিবিসি, ন্যাশনাল টুডে
কেএসকে/জিকেএস