ফিচার

আমের নাম ফজলি হলো কীভাবে

আমের নাম ফজলি হলো কীভাবে

প্রতি গ্রীষ্মেই আমের আগমন ঘটে কখনো হিমসাগর, কখনো ল্যাংড়া, কখনো বা হাঁড়িভাঙা। তবে মৌসুমের শেষে বাজারে আবির্ভূত হয় এক সুবৃহৎ, সুবাসিত, রসালো আম, যার নাম ফজলি। তখন মনে হয় রাজসিক কোনো অতিথি এসে হাজির হয়েছে আম উৎসবের শেষ অংশে।

Advertisement

‘ফজলি’ এটি শুধু একটি আমের নাম নয়, এটি এক ঐতিহাসিক পরিচয়, এক গর্বের নাম। কিন্তু এই নামের পেছনে কী গল্প লুকিয়ে আছে? কে ছিলেন সেই ‘ফজলি’? আমের কামড়ে যখন স্বাদে ডুবে যাই, তখনই মনে পড়ে এই প্রশ্নগুলো।

হিমসাগর, খিরসাপাতি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, রানীপছন্দ, আম্রপালি, আশ্বিনা-নানান রকম আমের ভিড়ে ফজলি আলাদা হয়ে ওঠে তার স্বাদ, আকার এবং আভিজাত্যে। আমের রাজা হিসেবে এক ধরনের সম্মান রয়েছে তার। ফজলির আরেক নাম ‘ফকিরভোগ’ বলেও শোনা যায়।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলি আমের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। এই দুই অঞ্চলের ফজলি আম পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। বাংলাদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমার-এই অঞ্চল থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে এই ঐতিহ্যবাহী জাতটি। রসালো, আঁশবিহীন, টক-গন্ধযুক্ত মিষ্টি স্বাদের এই আমের নাম ‘ফজলি’ হলো কীভাবে চলুন এবার সে গল্পে ফিরে যাই।

Advertisement

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে, আনুমানিক ১৮০০ সালের দিকে, প্রাচীন বাংলার গৌড়ে এক প্রৌঢ়া বাস করতেন একটি জরাজীর্ণ ঘরে। তার নাম ছিল ফজলি বিবি। আম ছিল তার একান্ত ভালোবাসা উঠোনের একটি আমগাছের আম দিয়ে তিনি পথচারী ও সন্ন্যাসী-ফকিরদের আপ্যায়ন করতেন।

একবার মালদহের ব্রিটিশ কালেক্টর, র্যাভেনস সাহেব, গৌড়ে সফরে এসে ফজলি বিবির বাড়ির পাশে শিবির স্থাপন করেন। হঠাৎ একদিন তৃষ্ণায় কাতর সাহেবের সঙ্গে ফজলি বিবির দেখা হয়। ফজলি বিবি তখন তাকে পানি না দিয়ে দেন এক মিষ্টি আম।

সেই আম খেয়ে সাহেব এতই মুগ্ধ হন যে নাম জানতে চান। ফজলি বিবি, ইংরেজি ভালো না জানায়, নিজের নামই বলে দেন ‘ফজলি’। কালেক্টর সাহেব আমটির নাম ধরে নেন ‘ফজলি’। এভাবেই এক নারী ও এক আম দুইয়ে মিলে হয় আজকের ‘ফজলি’ আম।

এই আমের নামকরণ নিয়ে রয়েছে আরেকটি রোমাঞ্চকর গল্প। ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান ইউসুফ শাহ (১৪৭৪–১৪৮১ খ্রিস্টাব্দ)-এর স্ত্রী সুলতানা ফাদ্লী বিবি একদিন প্রাসাদের বাগানে একটি আম খেয়ে তার আঁটি ফেলে দেন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় একটি নতুন আমগাছ।

Advertisement

বছর কয়েক পর সেই গাছে ফল ধরলে প্রাসাদের লোকেরা লক্ষ করেন, এই আম যেমন বড়, তেমনই সুলতানার দেহেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। তিনি আগের চেয়ে কিছুটা ভারী হয়ে উঠেছেন। দাস-দাসীরা হাস্যরস করে আমটির নাম দেন ‘ফাদ্লী’ সুলতানার নামানুসারে। বিষয়টি সুলতানার কানে গেলে তিনি অসন্তুষ্ট হন এবং অভিযোগ করেন সুলতানের কাছে।

তিনি সব শুনে প্রথমে হাসেন, তারপর গাছটির আমের স্বাদ নিয়ে খুশি হন এবং এর চারা ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘ফাদ্লী’ উচ্চারণ বিবর্তিত হয়ে হয়ে দাঁড়ায় ‘ফজলি’।

ফজলি আম গড়ে লম্বায় ১৩.৮ সে.মি. চওড়ায় ৯.৫ সে.মি. উচ্চতায় ৭.৮ সে.মি. হয় এবং ওজন হয় ৬৫৪.৪ গ্রাম। আমটি দীর্ঘ এবং ঈষৎ চ্যাপ্টা। পাকা আমের খোসা কিছুটা হলুদ হয়ে ওঠে। শাঁস হলুদ, আঁশবিহীন, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। খোসা পাতলা। আঁটি লম্বা, চ্যাপ্টা ও পাতলা। এই আমে শর্করার পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ।

প্রতি বছর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ফজলি আম বাজারে আসে এবং অন্যান্য আমের তুলনায় বেশি সময় সংরক্ষণযোগ্য হওয়ায় এটি রপ্তানিযোগ্য জাত হিসেবেও সমাদৃত।

নাম নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাস আর স্বাদ মিলিয়ে ফজলি নিজের আলাদা জায়গা গড়ে নিয়েছে। রাজসিক আমটি আজও তার আভিজাত্য ধরে রেখেছে গ্রীষ্মের আম-উৎসবে, ঠিক যেমনটি এক সময় গৌড়ের উঠোনে কিংবা সুলতানার প্রাসাদে ছিল। আরও পড়ুন

রাজসভা থেকে বাড়ির হেঁশেলে বিরিয়ানি হাঁড়িভাঙা আম যেভাবে এলো

কেএসকে/এমএস