কখনো আরচারি খেলবেন, তা কল্পনায়ও ছিল না আব্দুর রহমান আলিফের। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল ফুটবল। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই খেলায়ই ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন ছিল পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার আল হেরা নগরের কলেজ শিক্ষক আলতাফ হোসেনের চার সন্তানের মধ্যে বড় এই আলিফের।
Advertisement
তবে ঘটনাচক্রে তিনি এখন দেশের অন্যতম সেরা আরচার। গ্রামের বাড়িতে গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতেন। সে অভিজ্ঞতা দিয়েই বিকেএসপিতে ধনুক হাতে নিয়ে তীর ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করেন। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু আরচারিতে।
ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় চমকের পর চমক দেখিয়ে দেশকে সাফল্য এনে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকেও। গত মাসে সিঙ্গাপুরে হওয়া এশিয়া কাপ আরচারিতে স্বর্ণ জিতেছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) এইচএসসি পরীক্ষার্থী আলিফ।
এশিয়া কাপ আরচারির ফাইনালে আলিফ হারিয়েছিলেন জাপানের প্রতিযোগী মিয়াতা গাকতোকে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর আলিফ জিতেছিলেন ৬-৪ সেট পয়েন্টে। ১৯ বছর বয়সী এই আরচারের এখন লক্ষ্য কি, কি করে তিনি এলেন তীর-ধনুকের খেলায়? এসব নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাগো নিউজকে।
Advertisement
জাগো নিউজ: এশিয়া কাপে স্বর্ণ জয়ের পর এখন কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন?
আলিফ: আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার জন্য টঙ্গীর আরচারি ট্রেনিং সেন্টার থেকে আমি এখন বিকেএসপিতে আছি। তিনটা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন আমি পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। জাগো নিউজ: সামনে আন্তর্জাতিক কি প্রতিযোগিতা আছে?
আলিফ: সামনে সাউথ এশিয়ান গেমস আছে। তার আগে এ বছর কানাডায় হবে ওয়ার্ল্ড যুব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ। এছাড়া ঘরোয়া কিছু প্রতিযোগিতা আছে। জাগো নিউজ: এসএ গেমস আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তো কি ভাবছেন, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নিয়ে?
আলিফ: এসএ গেমসের অনেক সময় বাকি। তবে আপাতত আমার ধ্যানজ্ঞান জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে। সামনে ট্রায়াল আছে। যদি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাই তাহলে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো কিছু করার চেষ্টা করবো। এশিয়া কাপ জিতেছি, এখন আমার লক্ষ্য জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ। এত বড় প্রতিযোগিতায় প্রথমবার খেলার স্বপ্ন দেখছি। জাগো নিউজ: আপনি তো বেশ কয়েকটি ওয়ার্ল্ড কাপ খেলেছেন। সেগুলোতে ফলাফল কেমন ছিল?
Advertisement
আলিফ: ২০২১ সালে গ্রিসে প্রথমবার ওয়ার্ল্ড কাপ খেলেছি। তারপর ২০২২ সালে কোরিয়া ও ফ্রান্সে, ২০২৩ সালে তুরস্কে এবং এ বছর মে মাসে সাংহাইয়ে। প্রথম চার ওয়ার্ল্ড কাপে কোনো ম্যাচ জিততে পারিনি। এবার দুই রাউন্ড জিতেছিলাম। যার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিলাম, মেক্সিকান সেই আরচার শেষ পর্যন্ত ফাইনালে খেলে রৌপ্য জিতেছিলেন। আমি ওয়ার্ল্ড কাপে ১৭তম হয়েছিলাম।
জাগো নিউজ: ঘরোয়া আরচারিতে কম বয়সী হিসেবে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জিতেছেন। কবে থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলছেন এবং এ পর্যন্ত কতগুলো স্বর্ণ জিতেছেন?
আলিফ: ২০২১ সালে সিনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে রিকার্ভ এককে, মিশ্র ও দলীয় ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছিলাম। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আমি ২৫টির মতো স্বর্ণ জিতেছি। রৌপ্য আছে ৯টি। একবার মাত্র ব্রোঞ্জ জিতেছি। ঘরোয়া সব প্রতিযোগিতায় আমি স্বর্ণ জিতেছি। জাগো নিউজ: এ সময়ের তরুণরা ফুটবল ও ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী থাকে। আপনি আরচারিতে কীভাবে এলেন?
আলিফ: আমার স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়া। ফুটবলে ভর্তি হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই ২০১৭ সালে আমি বিকেএসপিতে ট্রায়াল দিয়েছিলাম। সাথে আরচারিতেও ট্রায়াল দিয়েছিলাম। দুটোতেই ক্যাম্পে ডাক পাই। তবে ভর্তি হই আরচারিতে। জাগো নিউজ: স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার। আরচারিতে কীভাবে সুযোগ পেলেন এবং ফুটবলে সুযোগ পাওয়ার পরও কেন ভর্তি হননি?
আলিফ: ওই সময় আমি ফুটবল খেলে ইনজুরিতে পড়ে যাই। যে কারণে ফুটবলে ভর্তি না হয়ে আরচারিতেই ভর্তি হই। জাগো নিউজ: ছোট সময় থেকে ফুটবলের পাশাপাশি কি আরচারিও খেলতেন?
আলিফ: না। আমি ফুটবল খেলতাম ও সময় পেলে গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতাম। আমার হাত ভালো ছিল। বাবার এক বন্ধু বাবাকে বলেছিলেন আমাকে যেন আরচারিতেও ট্রায়াল দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যে কারণে আমার দুই খেলায়ই ট্রায়াল দেওয়া হয়।
জাগো নিউজ: আপনার বাবা কি করেন? পরিবারে কে কে আছেন?
আলিফ: আমার বাবা আলতাফ হোসেন সাঁথিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক। মা গৃহিণী। আমরা দুই ভাই, দুই বোন। আমিই বড়। আমি ছাড়া আর কেউ খেলাধুলায় নেই। সবাই পড়াশোনা করছে। জাগো নিউজ: বলছিলেন খেলার প্রতি আপনার অনেক আগ্রহ ছিল। বাবা-মায়ের কাছ থেকে কেমন সমর্থন পেতেন ওই সময়ে?
আলিফ: খেলাধুলা করি, আমার বাবা সেটা পছন্দ করতেন না। তবে মা আমাকে সমর্থন করেন। বিকেএসপিতে ট্রায়ালের জন্য মাকে দিয়েই বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম। আমি বাবাকে বলার সাহস পেতাম না। জাগো নিউজ: এখন নিশ্চয়ই আপনার বাবার কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছেন?
আলিফ: তা তো অবশ্যই। আমি যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন অনেকে সমালোচনা করেছেন বাবার বিরুদ্ধে। কটু কথা বলেন। শুনেছি কিছু মানুষ বলেছেন একজন কলেজের শিক্ষক অন্যদের ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেন অথচ তার ছেলেকে দিয়েছে খেলায়। শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। সেই মানুষরাই এখন বাবাকে বাহবা দেন। এশিয়া কাপে স্বর্ণ জয়ের পর তারাই বাড়িতে গিয়ে বাবাকে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছেন।
জাগো নিউজ: পাবনার যে গ্রামে আপনার বাড়ি, ওই এলাকায় কি অনেক গাছপালা আছে যে নিয়মিত পাখি শিকার করতেন?
আলিফ: হ্যাঁ। অনেক গাছগাছালি আছে। আমি তো আসলে ফুটবলই খেলতাম। অনেক খেলাধুলা করতাম। যার মধ্যে ফুটবল বেশি। খেলার প্রতি আমার এমন নেশা ছিল যে, সারাদিন না খেয়েও খেলাধুলা করতে পারতাম। একটু পানি খেলেই হতো। যেদিন ফুটবল খেলা থাকতো না সেদিন চলে যেতাম গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতে। জাগো নিউজ: কখনো তীরধনুক হাতে নেননি, অথচ বিকেএসপির আরচারি কোচরা আপনাকে নির্বাচিত করলেন। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
আলিফ: ওই যে বললাম না আমার হাত ভালো ছিল। নিঁখুতভাবে গুলতি মারতাম। ট্রায়ালে তীরও নিঁখুতভাবে মারতে পেরেছিলাম। আমার ট্রায়াল দেখে বিকেএসপির আরচারি কোচ বলেছিলেন, তুমি পারবে। ভর্তির জন্য নির্বাচিত করেছিলেন তিনিই। জাগো নিউজ: ধন্যবাদ।আলিফ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরআই/আইএইচএস/