বর্তমান প্রজন্ম তাকে সেভাবে পায়নি। তার খেলা, বোলিং দেখেনি। তাই হাসিবুল হোসেন শান্ত আসলে কি মানের পেসার, কেমন বোলার ছিলেন, তা জাননো বা বোঝানো বেশ কঠিন। তার পরিসংখ্যানও এমন সমৃদ্ধ নয় যে, এক পলক দেখলেই মনে হবে অনেক বড় মাপের বোলার। বল হাতে আগুন ঝরাতেন।
Advertisement
খেলেছেন মাত্র ৫ টেস্ট। উইকেট সংখ্যাও নেহায়েত আহামরি, মাত্র ৬টি। অভিষেক টেস্টের এক নম্বর বোলার হিসেবে বোলিংয়ের সূচনা করে প্রথম ইনিংসে ১৯ ওভারে (২ মেডেন) ৬০ রান দিয়ে উইকেট পাননি।
পরের ইনিংসে একমাত্র উইকেট পাওয়া বোলার ছিলেন শান্ত। তার বলে ভারতীয় ওপেনার সদাগোপান রমেশের উইকেট উপড়ে যায়। ঠিক পরের বলে উইকেটে এসেই ক্যাচ দিয়ে বসেন রাহুল দ্রাবিড়; কিন্তু আল শাহরিয়ার রোকন সে ক্যাচ ধরে রাখতে পারেননি। তাহলে অভিষেক টেস্টে ২ উইকেট হতে পারতো শান্তর।
আর ওয়ানডেতেও ম্যাচ পিছু একটি করে উইকেট নেই। ৩২ ম্যাচে ২৯ উইকেট। সেরা বোলিং ফিগার ৪/৫৬।
Advertisement
এটুকু দেখে ও জেনে যে কেউ ভাববেন এ আবার এমন কি? আজকাল তাসকিন, মোস্তাফিজ, এবাদত, শরিফুল, হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানা কিংবা খালেদ আহমেদদের ট্র্যাক রেকর্ডতো এর চেয়ে অনেক ভালো!
কিন্তু পরিসংখ্যান যা বলছে, শান্ত বাস্তবে তার চেয়ে ঢের ভাল বোলার ছিলেন। গতিতে তাসকিন, নাহিদ রানার মত না হলেও এবাদত, খালেদদের গতিতেই বল করতেন শান্ত। শারীরিক গঠন, রানআপ, বোলিং অ্যাকশন, ক্ষিপ্রতা, বলের গতি, লাইন ও লেন্থকে মানদণ্ড ধরলে শান্তকে ৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের এক নম্বর পেসার হিসেবেই ধরা হতো তাকে।
তবে ৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে টেস্ট অভিষেকের সময় পর্যন্ত দেশের এক নম্বর স্ট্রাইক বোলার শান্ত কিন্তু তার ক্যারিয়ারের ‘পিকে’ থেকে প্রথম টেস্ট খেলতে পারেননি।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের ঠিক পরে ঢাকা লিগের এক ম্যাচে পাকিস্তানী ব্যাটার জহুর এলাহির ব্যাটের আঘাতে হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা পান শান্ত। ব্যাঙ্গালোরে নিজের উদ্যোগে একটি সার্জারিও করান। ৬ মাস পর যখন আবার বল হাতে নেন, তখন আগের সেই মসৃন রানআপ, চমৎকার ফলো ‘থ্রু‘ ছিল না। গতিও যায় কমে।
Advertisement
তখন মাইল মিটার খুব বেশি ছিল না। তবে শান্ত ১৩৫ থেকে ১৩৭-১৩৮ কিলোমিটার গতিতে বল করেছেন। মোটকথা, যে শান্ত ক্যারিয়ারের প্রথম ৩-৪ বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, সেই ‘শান্ত’ কিন্তু অভিষেক টেস্টে ছিলেন না। তারপরও তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। শান্ত হেসেখেলে এক নম্বর বোলার হিসেবেই দলে জায়গা করে নেন।
অভিষেক টেস্টের বোলিং নিয়ে তার সুখস্মৃতি নেই তেমন। তবে দুটি ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে। প্রথম ঘটনা হলো, মূলত পেসার এবং দলের এক নম্বর স্ট্রাইকবোলার হলেও বাংলাদেশ যেহেতু আগে ব্যাট করেছে, তাই শান্তও অভিষেক টেস্টে বল হাতে নেয়ার আগে ব্যাটিং করেন।
টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবার ব্যাটিং, তাও ১০ নম্বরে পজিসনে। সেখানে নেমেও ৬৬ মিনিট ক্রিজে থেকে ৩ বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ২৮ রানে ছিলেন নট আউট। শান্তর ব্যাটিংয়ের সুখস্মৃতি আছে একটি। তাহলো সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাথে জুটি গড়ে নবম উইকেটে ৩১ রান যোগ করা। অভিষেক টেস্টে ব্যাটিংয়ের সময় দুটি ঘটনাই মনে আছে।
‘এক ভারতের বাঁহাতি স্পিনার সুনিল জোসিকে ছক্কা হাঁকিয়েছিলাম। আর বুলবুল ভাইয়ের সাথে ব্যাটিং করেছি। বারবার বলছি, বুলবুল ভাই আপনি দেড়শো পূরণ করেন। ওয়ান ফিফটির মাইলফলক স্পর্শ করেন; কিন্তু মাত্র ৫ রানের জন্য তা পূর্ণ হয়নি। বুলবুল ভাই আরও সময় উইকেটে থাকলে তার দেড়শোর পাশাপাশি হয়ত আমারও ফিফটিটা হয়ে যেত। হা.. হা... হা....।’
বোলার শান্তর অভিষেক টেস্টের স্মৃতি বলতে গিয়ে শুধু একটা কথাই বলেছেন, পেসার ও উদ্বোধনী বোলার শান্তর প্রথম টেস্টে অর্জন বলেন, প্রাপ্তি বলেন-, একটাই। তাহলে টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটি করা। ইতিহাসে লিখা থাকবে টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটি করেছিলেন শান্ত। একজন বোলার হিসেবে এর চেয়ে পাওয়ার আর আসলে কিছু নাই।
নিজেও মানছেন পরিসংখ্যানে যে শান্তর দেখা মিলছে, বাস্তবের শান্ত তার চেয়ে ঢের বেটার ও কোয়ালিটি পেসার ছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে, ঢাকা লিগ, জাতীয় লিগ দুই আসরে শান্তর রেকর্ড বেশ ভাল। ৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে অন্তত ৪-৫ বছর শান্তকে খেলতে সমস্যা হতো দেশের সব প্রতিষ্ঠিত ও নামী ব্যাটারদের।
কেন শান্ত নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেই ঘরোয়া ক্রিকেটের তেজী ঘোড়ার মত শান্তকে খুঁজে পাওয়া যায়নি? কেনই বা ৫ টেস্ট খেলেই শেষ ক্যারিয়ার? সেটা কি ঢাকা লিগ ম্যাচে জহুর এলাহির ব্যাটের আঘাতে হাঁটুতে ব্যাথা পাওয়ার কারণে?
বিনয়ী শান্ত ভিনদেশি জহুর এলাহিকে দোষ দেননি। তবে ৯৯ সালের ঢাকা লিগে আবাহনী আর কলাবাগান ম্যাচে পাকিস্তানের নামকরা অলরাউন্ডার মঞ্জুর এলাহির ছোট ভাই জহুর এলাহি তার বলে আউট হয়ে নিজের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে ব্যাট বাতাসে ছুঁড়ে দিলে তা বিদ্যুত গতিতে গিয়ে আঘাত হানে শান্তর হাঁটুতে। তারপর শান্তকে মাঠে ফিরতে অনেক কষ্ট করতে হয়।
এখনকার মত চিকিৎসা তত উন্নত ছিল না তখন। বিসিবির টেককেয়ারও এত ছিল না। শান্তর ব্যাখ্যা, ‘যখন আঘাত পাই তখন হয়ত প্রপার ট্রিটমেন্টটা হয়নাই। তারপর গাইডেন্সেরও একটা ব্যাপার ছিল। আমার নিজেরও একটা ডিসিপ্লিনের ব্যাপার ছিল। সব মিলিয়ে চলাফেরায় সমস্যা ছিল। এছাড়া ‘ব্যাকে’ একটা প্রবলেম হয়েছিল। তখন আবার প্রায় এক বছর মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। তারপর আর নিজেকে ফিরে পাইনি।’
অভিষেক টেস্টের বোলিংয়ের অনুভুতি বলতে গিয়ে শান্তর অকপটে স্বীকারোক্তি, ‘বলতে হবে যে আসলে তখন আমি নিজে টেস্ট খেলার জন্য সেভাবে তৈরি ছিলাম না। প্রথম ইনিংসে বোলিং করেই বুঝেছি, আমি যে বোলিং করি, যে লাইন লেন্থ ও কারুকাজে বল আমার তা দিয়ে টেস্টে চলবে না। আরও চিন্তা করে ব্যাটারকে রিড করে বল করতে হবে। প্রথমত ম্যাচ অভিজ্ঞতা, ধারণা কিছুই ছিলাম না। টেকনোলজিও ছিল না কিছুই। যা পেরেছি, তাই করছি। তাই প্রথম ইনিংসে উইকেট পাইনি। দ্বিতীয় ইনিংসে একটি পাইছি। ২টা পাইতাম, রোকন স্লিপে ক্যাচ ফেলে দিলে সেটা আর পাইনি।’
খেলা ছেড়ে দেয়ার পরতো অনেকদিন ক্রিকেটে ছিলেন না, সেটা কেন? হ্যাঁ, সত্য। খেলা ছাড়ার পর আসলে ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত নিজেকে তৈরি করেছি। তারপর ২০১৬ থেকে জুনিয়র সিলেক্টর হিসেবে কাজ করছি।
আপনিতো কোয়ালিটি পেস বোলার ছিলেন। পেস বোলিং কোচ হিসেবে আরও ভাল করতেন পারতেন না? নাকি নির্বাচক হিসেবে কাজ করেই সন্তুষ্ট? আলহামদুল্লিল্লাহ। আমি সিলেক্টর হিসেবেই ভাল বোধ করছি।
কারণটা ব্যাখ্যা করবেন কি? ‘আসলে আমি কিন্তু নির্বাচক হয়েও অনেক পেস বোলার তৈরির কাজ করেছি। শরিফুল, হাসান মাহমুদ, আশিক, মুশফিক, তানজিম সাকিব, এবাদত, ফাহাদ, খালেদ, রাজা সবারই ওপরে ওঠার পিছনে আমার কম বেশি ভূমিকা আছে। এবাদতের বোলিং অ্যাকশন ঠিক করার কাজেও আমি হেল্প করেছি। এক কথায় দেশের ইয়াং পেসারদের যে অংশটা এখন জাতীয় দলে, তাদের বয়স ভিত্তিক দল থেকে জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও আমার ভূমিকা আছে। তারা প্রায় সবাই আমার সিলেকশন থেকে আজকের পর্যায়ে।
ব্যক্তি জীবনে বিসিবির জুনিয়র নির্বাচক হিসেবে কাজ করছেন শান্ত। সাথে একটা পার্টনারশিপ ব্যবসায়ও করেন। ‘এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়ে ফাইনান্সে বিবিএ করছে। ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। সব মিলে আল্লাহ খুব ভাল রাখছেন। আমি ভালই আছি।’
এআরবি/আইএইচএস