শিক্ষা

বেঁচে থাকলে আজ এইচএসসিতে বসতো ওরাও

বেঁচে থাকলে আজ এইচএসসিতে বসতো ওরাও

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে আজ। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সকাল ১০টায় এ পরীক্ষায় বসেছেন প্রায় সাড়ে ১২ লাখ পরীক্ষার্থী। কিন্তু এ পরীক্ষায় আরও কখনোই বসা হবে না ফাইয়াজ, আহনাফ, সাদ, মারুফ, জাহিদ, সৈকতদের। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন তারা। বেঁচে থাকলে আজ তারাও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতেন। তাদের জন্য আজ পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, সহপাঠীরা মর্মাহত।

Advertisement

২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে অভ্যুত্থান চলাকালে আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে ছয়জনের এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তারা হলেন- শহীদ আবদুল্লাহ বিন জাহিদ, ফারহান ফাইয়াজ, শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, আফিকুল ইসলাম সাদ, মারুফ হোসেন ও আব্দুল আহাদ সৈকত।

তাদের কেউ শহীদ হয়েছেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি, কেউ আগস্টের শুরুতে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর কিছুদিন আগে ফেসবুকে লিখে গিয়েছেন বর্ণময় বিদায়বার্তা। আজ তাদের সহপাঠীরা পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে হয়ত চোখের পানি মুছেছেন। কারণ বন্ধুরা নেই। আছে কেবল তাদের গল্প-স্মৃতি।

কাঁদছেন জাহিদের ৫ বন্ধু ও মাআবদুল্লাহ বিন জাহিদকে ছাড়াই আজ পরীক্ষায় বসছেন তারা ঘনিষ্ঠ পাঁচ বন্ধু লামিম, হাসান, সালেহীন, রাকিব ও মেহেদি। ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। একই পাড়ায় থাকায় বন্ধুত্বের বন্ধন ছিল অটুট। পড়েছে আলাদা কলেজে। তবে প্রতিদিন দেখা হতো। পরীক্ষা সামনে আসায় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন একসঙ্গেই। কিন্তু আজ, তাদের একজন, নেই।

Advertisement

জাহিদের মা ফাতেমা-তুজ-জোহরার চোখে এখনও জলের ধারা। তিনি বলেন, ‘ওর কলেজ থেকে পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকেছিল। আমি যাইনি। মনে হচ্ছিল, সহ্য করতে পারবো না।’

জাহিদ শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাতে উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। মৃত্যুর তিন মাস পর ছিল তার ১৭তম জন্মদিন।

বড় ছেলের মৃত্যুর ১৪ দিনের মাথায় ছোট ছেলে মাহমুদুল্লাহ বিন জিসানের কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। চলতি বছরের ১৮ মার্চ হৃদ্রোগে মারা যান ফাতেমার স্বামীও। এখন তিনি থাকেন উত্তরা আব্দুল্লাহপুরে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাহিদের মা ফাতেমা বলেন, ‘ওর পাঁচ বন্ধু লামিম, হাসান, সালেহীন, রাকিব ও মেহেদি ফোন করে অনেক কেঁদেছে। বলেছে, খালাম্মা দোয়া করবেন। ওদের মুখেই যেন আমার ছেলেকে খুঁজে পাই।’

Advertisement

ফাইয়াজের রেজিস্ট্রেশন কার্ড হাতে বিষণ্ণ বাবাঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া, ডাকনাম ফারহান ফাইয়াজ। সেই নাম এখন হয়ে উঠেছে জুলাই অভ্যুত্থানের এক প্রতীক। ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় তার বুকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মারা যান ঘটনাস্থলেই।

বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, ‘ছেলেটা গবেষক হতে চেয়েছিল। বিদেশে পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে গবেষণা করতে চেয়েছিল।’ মঙ্গলবার (২৪ জুন) তিনি কলেজে গিয়ে ছেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড আনতে গিয়েছিলেন। মন ভার হয়ে আসে তার।

তিনি বলেন, ‘রাতে ওর বন্ধুরা ফোন করে বলে- আংকেল, ফারহান থাকলে আজ পা ছুঁয়ে সালাম করত, দোয়া চাইত। আমরাও আপনার সন্তান। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

‘পরীক্ষার কথা ভাবলেই বুকটা খালি খালি লাগে’

মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে ৪ আগস্ট শহীদ হন শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ। ছিলেন বিএএফ শাহীন কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী। গানপ্রিয় ও স্কাউট সদস্য আহনাফকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ স্কাউটস ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। প্রধান উপদেষ্টা নিজ কার্যালয়ে আহনাফের মায়ের হাতে পুরস্কারটি তুলে দেন। পুরস্কার হাতে নিয়েই স্মৃতিফলকে গিয়ে ছেলের সোনালি প্রতিকৃতি ছুঁয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আজ ও বেঁচে থাকলে পরীক্ষার হলে যেতো। আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘পরীক্ষার সময় এসেছে, বুকটা আরও বেশি খালি লাগছে। ছেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ডটা এখন শুধু যন্ত্রণার স্মৃতি।’

আরও পড়ুন এইচএসসি পরীক্ষায় সাড়ে ১২ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসিতে সবাই অংশ নিচ্ছে, আমার ভাইটা দিতে পারবে না নিউইয়র্কের সম্ভাব্য মেয়র কে এই জোহরান মামদানি?

পরীক্ষায় বসছেন না শহীদ মারুফওমারুফ হোসেনের যার বয়স ছিল ১৯ বছর। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার করেছিল ডিবি। সেই থেকেই তাকে নিয়ে পরিবার ছিল শঙ্কিত। এরপর বরিশালে নানা বাড়িতে রাখা হয়। কাজীরহাট একতা ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার তার এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল।

কিন্তু গত ১৯ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। তার মরদেহ পাওয়া যায় তিন দিন পর অর্ধগলিত অবস্থায়। বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, ‘ও ছিল আমার বন্ধুর মতো। কবরস্থান থেকে বলা হয়েছে ১০ লাখ টাকা না দিলে কবরটা রাখবে না। আর ওর মা ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

আব্দুল আহাদ সৈকতঢাকা কমার্স কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন আব্দুল আহাদ সৈকত। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সৈকত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নেন বাবার সঙ্গে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে মাথায় গুলি লেগে শহীদ হন তিনি।

বাবা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঘণ্টা বেঁচেছিল। আমি ছিলাম পাশে। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমার ছেলে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, আজ তাকে কেবল কবরে দেখতে পারি।’

আফিকুল ইসলাম সাদসাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন সাদ। ৫ আগস্ট ধামরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। ফ্রিল্যান্সিং করে পরিবারের জন্য কিছু করতে চাওয়া সাদ ছিল গ্রাফিক ডিজাইনে পারদর্শী।

মৃত্যুর আগের দিন ৪ আগস্ট তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘যে দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে।’ সাদকেও আহনাফের মতো মঙ্গলবার ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়েছে। তার বাবা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেটা এখনো চোখের সামনে ভাসে। নিজের ডিজাইনে আন্দোলনের পোস্ট বানিয়ে ফেসবুকে দিত। পরিবারকে সাহায্য করতে চাইতো।’

এএএইচ/এমআরএম/এএসএম