তানজিদ শুভ্র
Advertisement
বাঙালির খাদ্যতালিকায় বিরিয়ানি যেন এক আবেগের নাম। যে কোনো উৎসব, পার্বণ কিংবা বিশেষ দিনে বিরিয়ানি ছাড়া যেন জমেই না। মসলা, চাল, মাংস আর ঘ্রাণে মোড়া এই খাবারটি আজ যেমন জনপ্রিয়, তেমনি এর রয়েছে শতাব্দী পেরোনো এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস।
‘বিরিয়ানি’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। ‘বিরিয়ান’ শব্দের অর্থ ভাজা বা সেঁকা। ধারণা করা হয়, প্রাচীন পারস্য বা ইরানে এর উৎপত্তি, যেখানে মাংস ও চাল একসঙ্গে রান্না করে ভিন্নধর্মী খাবার তৈরি করা হতো। সেই খাবার ছিল রাজকীয়। পরবর্তীতে মোঘলদের হাত ধরে এই খাবার ভারতবর্ষে আসে। কেউ কেউ বলেন, ভারতের দক্ষিণে তামিল সংস্কৃতিতেও এমন ধরনের খাবার ছিল, যার নাম ছিল ‘ওন সরু’। তবে মূলধারায় বিরিয়ানিকে ভারতবর্ষে জনপ্রিয় করেছে মোঘল সম্রাটরা।
মোঘল সাম্রাজ্যে বিরিয়ানি ছিল উচ্চবিত্ত ও রাজার দরবারের প্রিয় খাবার। বিশেষ করে সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহলের সঙ্গে এক কাহিনি জড়িত। কথিত আছে, একবার তিনি সৈন্যদের শারীরিক দুর্বলতা দেখে রাজকীয় বাবুর্চিকে বলেন এমন এক পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে যা সহজে বহনযোগ্য ও শক্তিদায়ক হয়। তখনই তৈরি হয় বিরিয়ানি; একপাত্রে চাল, মাংস, মসলা ও ঘি দিয়ে রান্না করা এক অনন্য খাবার।
Advertisement
বিফ বিরিয়ানি
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজকীয় খাবার সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে এটি গ্রহণ করে নিজেদের মতো করে রূপ দেয়। ফলে তৈরি হয় নানা স্বাদের ও ধরনের বিরিয়ানি।
বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা যত বেড়েছে, ততই এর রূপ ও স্বাদে এসেছে বৈচিত্র্য। আজকে আমরা যে সব ধরনের বিরিয়ানির কথা বলি তা মূলত আঞ্চলিক রূপান্তরের ফসল। সবচেয়ে বিখ্যাত বিরিয়ানিগুলোর একটি হায়দরাবাদি বিরিয়ানি। এতে মাংস কাঁচা অবস্থায় মসলা ও দই মেখে চালের সঙ্গে স্তর করে চাপা আগুনে রান্না করা হয়।
বিরিয়ানিতে আলু অনেকেরই প্রিয়। বড় আলুর টুকরা বিরিয়ানির স্বাদও বাড়ায়। তবে আলু ব্যবহারের পেছনের গল্প ভিন্ন। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হারিয়ে কলকাতায় নির্বাসনে আসার সময় তার সঙ্গে ছিল লখনউয়ের বাবুর্চির দল। তাদের হাত ধরেই কলকাতায় আসে বিরিয়ানি। অর্থনৈতিক সংকটে আলু ব্যবহার শুরু হয় মাংসের বিকল্প হিসেবে, যা আজ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।
Advertisement
ইলিশ বিরিয়ানি
প্রতিটি অঞ্চলের পরিবেশ, উপকরণ ও সংস্কৃতিরভেদে বিরিয়ানি নতুন রূপ পেয়েছে। এদেশেও বিরিয়ানি একসময় শুধু ঢাকার নবাবি খাবার ছিল। পরে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে লাল কাপড়ে মোড়া হাঁড়ি ভর্তি বিরিয়ানি।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে বিরিয়ানির হাঁড়ি লাল কাপড়ে মোড়ানো থাকে কেন? প্রাচীন ইরানে খাবার পরিবেশনের একটি রাজকীয় রীতি ছিল রুপার থালাবাসনে পরিবেশিত খাবার ঢেকে রাখা হতো গাঢ় লাল রঙের কাপড়ে। সময় গড়িয়েছে, সমাজ বদলেছে, তবু লাল কাপড়ে মোড়া খাবার আজও এক ধরনের ঐতিহ্যের ধারক। একসময় বিরিয়ানি ছিল রাজ দরবারের বিলাসিতা, তারই নিদর্শন ছিল এভাবে বিশেষ কাপড়ে ঢেকে পরিবেশন। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরে এখনো দেখা যায় বিরিয়ানির পাত্রে লাল কাপড়ের ব্যবহার।
বিরিয়ানি শুধু খাবার নয়, উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঈদ, বিয়ে, জন্মদিন সব আয়োজনেই বিরিয়ানি থাকে খাবারের তালিকায়। রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসারে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। নানা ধরনের মাংস, গরু, খাসি, মুরগি এমনকি ডিম কিংবা মাছ দিয়েও এখন বিরিয়ানি তৈরি হয়।
পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি যেমন হাজীর বিরিয়ানি, মামুন বিরিয়ানি, নান্না মিয়ার বিরিয়ানি এই নামগুলো একেকটি স্বাদের আইকন হয়ে উঠেছে। শুধু খাবারের স্বাদ নয়, এদের প্রস্তুতির ধরন, উপকরণের মান এবং মসলার পরিমিত ব্যবহার বিরিয়ানিকে দিয়েছে আলাদা এক পরিচিতি।
চিকেন বিরিয়ানি
তবে দুঃখজনকভাবে, এই জনপ্রিয় নামগুলোকে পুঁজি করে আজ অনেক জায়গায় ‘ঢাকাই কাচ্চি’ বা ‘হাজীর বিরিয়ানি’ নাম দিয়ে বিরিয়ানি বিক্রি করা হচ্ছে, যার স্বাদ ও মান মূল ব্র্যান্ডের ধারে কাছেও নেই। শহরের বাইরে এমনকি রাজধানীর ভেতরেও কিছু রেস্তোরাঁ শুধু নাম ব্যবহার করে মানুষের আগ্রহ টানছে, অথচ স্বাদে নেই সেই আসল ঘ্রাণ, নেই শুদ্ধ ঘি-মসলার ব্যবহার। ফলস্বরূপ, অনেকেই প্রথমবার খেয়ে হতাশ হচ্ছেন এবং ঢাকাই বিরিয়ানির প্রতি এক ধরনের ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে।
এই ‘নামের প্রভাব’কে কাজে লাগিয়ে যারা ব্যবসা করছেন, তাদের কারণে মূলধারার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি পরিবেশনের মান প্রশ্নের মুখে পড়ছে। একে এক ধরনের খাদ্য-সংস্কৃতি অপব্যবহারও বলা যায়। তাই ভোজনরসিকদের সচেতন হওয়া দরকার।
বিরিয়ানির ইতিহাস শুধু এক খাদ্যের ইতিহাস নয়, এটি বহু সংস্কৃতির, সময়ের ও মানুষের মেলবন্ধনের কাহিনি। পারস্যের রাজসভা থেকে মোঘল দরবার, নবাবি ব্যঞ্জন থেকে বাঙালির প্রিয় খাদ্য এই পথচলা যেমন সুগন্ধে মোড়া, তেমনি ইতিহাসে সমৃদ্ধ। বিরিয়ানি আজ শুধু স্বাদ নয়, এক ঐতিহ্য যা যুগে যুগে মানুষকে এক সুতোয় বেঁধেছে, ভালোবাসার এক চিরন্তন রেসিপি হয়ে।
আরও পড়ুন রোদ-ধুলার শহরে হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ভাজা স্বাদের টানকেএসকে/জিকেএস