জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি ১ জুলাই।
Advertisement
শুনানির সময় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তবে বাকি দুজন পলাতক থাকায় তাদের হাজির করা সম্ভব হয়নি। শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় পলাতক দুজনের বিষয়ে দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এখন অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি হবে। তবে পলাতকদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমরা আইনজীবী ঠিক করে দেবো। পরে আগামী ১ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৬ জুন ট্র্যাইব্যুনাল-১ পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আগামী সাত দিনের মধ্যে হাজির হতে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং পরদিন দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তবে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরেও পলাতক দুই আসামি ট্র্যাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় ট্র্যাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন।
প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন শুনানির জন্যে এই দিন ঠিক করে আদেশ দেন। একই সঙ্গে পলাতক আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে আইনী লড়াইয়ের জন্যে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী ঠিক করে দেওয়া হবে বলেও আদেশ দেন ট্র্যাইব্যুনাল।
Advertisement
মঙ্গলবার (২৪ জুন) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সাইমুম রেজা তালুকদার (পিয়াস)। উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, প্রসিকিউটর আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।
২৪ জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে গত মঙ্গলবার (১৭ জুন), (বাংলা ও ইংরেজি) দুটি পত্রিকায় এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চিফ প্রসিকিউটরের দাখিল করা ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আমলে নিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে যে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি সত্ত্বেও অভিযুক্ত দুজন পলাতক রয়েছেন বা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেছেন। তাই তাদের ২৪ জুন এই ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। অন্যথায় তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ সম্পন্ন হবে। এর আগে দুই জনকে হাজির হতে দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য গত ১৬ জুন নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সে অনুযায়ী এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। সেদিন ট্র্যাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
এর আগে গত ১ জুন শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
Advertisement
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সাড়ে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যার দায় শেখ হাসিনার। তার নির্দেশ, উসকানি ও প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। শেখ হাসিনার নির্দেশে আন্দোলন দমনে মরণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করার প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগ হলো, প্রথম অভিযোগ, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ–নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। এতে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক আচরণের ঘটনা ঘটে।
দ্বিতীয় অভিযোগ, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন।
তৃতীয় অভিযোগ, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চতুর্থ অভিযোগ, রাজধানীর চাঁনখারপুলে আন্দোলনরত নিরীহ–নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম অভিযোগ, আশুলিয়ায় নিরীহ নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
অন্যান্য ডকুমেন্ট:
আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংঘটনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন ও সিসিটিভি ফুটেজ, আসামিদের টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপ, ডিজিটাল সাক্ষ্যপ্রমাণের ফরেনসিক প্রতিবেদন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি ও ভিডিও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে পাওয়া দাপ্তরিক নথিপত্র ইত্যাদি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত তিনটি মিস কেস বা বিবিধ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত বিবিধ মামলায় গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই–বাছাই ও পর্যালোচনার পর তা ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় একটি এবং ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরেকটি বিবিধ মামলা আছে ট্রাইব্যুনালে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে।
যার মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম