স্টেডিয়ামে আসেননি। তবে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত ভুটান ও সিঙ্গাপুরের ম্যাচ দুটি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন সাবেক তারকা ফুটবলার, দেশের অন্যতম সিনিয়র কোচ সফিকুল ইসলাম মানিক। এমনকি শিলংয়ে হওয়া ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ থেকেও চোখ ফেরাননি তিনি।
Advertisement
তিন ম্যাচের মধ্যে ভারত ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি ছিল এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার লড়াই। অভিজ্ঞ কোচ সফিকুল ইসলাম মানিকের মতে, ভারত ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি জেতা উচিত ছিল বাংলাদেশের। তাহলে আজ গ্রুপে ভালো অবস্থানে থাকতো হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার দল, ৪৫ বছর পর আবার এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হতো।
আড়াই মাসে তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, ফুটবলে তার আসল ঠিকানা ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ফিরে আসা, দর্শক স্টেডিয়ামমুখী হওয়া, ভারত ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জিততে না পারার কারণ এবং ফুটবল ঘিরে ফিরে আসা উন্মাদনা ধরে রাখার জন্য করণীয়- এমন নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন জাতীয় দলের সাবেক এই কোচ। তিনি মনে করেন, হামজা চৌধুরী এবং পরে শামিত সোম যোগ হওয়ায় বাংলাদেশ দলের যে শক্তি বেড়েছে তাতে ভারত ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে দুই ম্যাচ থেকে ৬ পয়েন্ট পাওয়া উচিত ছিল।
জয় কেন পাওয়া হলো না? এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে মানিক বলেন, ‘আমি ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু করি। দেখুন! এমন নার্ভাস ভারতকে আগে পায়নি কখনো বাংলাদেশ। ভারত যার কারণে এতটা নার্ভাস হয়েছিল, সেই হামজা চৌধুরীকে কোচ ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেননি। হামজা সুপারস্টার। তাই অনেক সময় দেখা যায়, সুপারস্টাররা নিজের মতো করে মাঠে খেলতে চান। হামজাও সেটা করেছেন। সে ক্ষেত্রে কোচের উচিত ছিল হামজার কাজটা নির্ধারণ করে দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে বলবো, ভারতের বিপক্ষে বেশ কয়েটা কর্নার কিক নিয়েছেন হামজা। কেন? হামজা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। ২২ খেলোয়াড়ের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা। তিনি যদি কর্নারের সময় ভারতের বক্সে থাকতেন তাহলে ভারতের রক্ষণ তটস্থ থাকতো। কর্নারের সময় হামজা ডি-বক্সে থাকলে ভারতের একাধিক খেলোয়াড় তাকে মার্ক করতেন। হামজার সাথে হেডের প্রতিযোগিতায় না পারলে ভারতের ডিফেন্ডাররা তাকে টেনে ধরতে চাইতেন, ফেলে দিতে চাইতেন। তখন কিন্তু পেনাল্টি পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো। সেটা হয়নি। হামজাকে তেমন হেডে যেতে দেখা যায়নি।’
Advertisement
ভারতের ম্যাচ নিয়ে মানিকের আরও বিশ্লেষণ এরকম, ‘ভারত নার্ভাস ছিল, আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা ছিল ওভার এক্সসাইটেড। হামজা আছেন, ভালো খেলতে হবে, জিততে হবে- এসব কারণে সিলি মিসটেক করেন। যেমন শুরুতেই জনির গোল করতে না পারা তার একটা কারণ। ভারত ফুটবল দলের অবস্থা বর্তমানে তেমন ভালো নয়। যে কারণে তারা হামজাকে দেখে নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।'
মানিক মনে করেন, সিঙ্গাপুরের চেয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ ভালো খেলেছে। কোচ নিশ্চয় ভারতের ম্যাচ কাটাছেঁড়া করেছেন। সেভাবেই দলটি তৈরি করা উচিত ছিল। ‘ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল সিঙ্গাপুর ম্যাচের প্রস্তুতি। যে দলটিকে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে খেলানো হবে সেই দলকেই ভুটানের বিপক্ষে খেলানো উচিত ছিল। ভুটানের বিপক্ষে যারা খেলেছেন তারাতো ভালোই করেছে। তাহলে সিঙ্গাপুরের ম্যাচে তিনটি পরিবর্তন কেন?’
‘শামিত ঢুকবেন বলে একটি পরিবর্তন নিশ্চিত ছিল। বাকি দুজন কেন বদলানো হলো। জামাল ভূঁইয়াকে যদি আপনি সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে না খেলান তাহলে তাকে ভুটানের বিপক্ষে কেন খেলানো হলো? আমাদের ফরমেশন যদি এমন হতো যে, বাম দিকে ফাহামিদুল, ডান দিকে রাকিব এবং স্ট্রাইকার পজিশনে শামিত। জামাল ভূঁইয়া তার জায়গায়ই থাকতে পারতেন। আবার এমনও করা যেত শামিতকে শুরুতেই না নামিয়ে উইনিং একাদশ দিয়ে স্টার্ট করা। কিছু সময় পর তাকে নামালে সিঙ্গাপুরও বিভ্রান্ত হতো। কোচ হয়তো ভেবেছেন, শামিতকে না নামালে দর্শক খেপবে। খেপুক। ভয় পেলে কোচিং করানো যায় না। অনেক সময় তারকা খেলোয়াড়দের তুরুপের তাস হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।’
স্লো স্টার্টই কাল হয়েছে বলে মনে করেন সফিকুল ইসলাম মানিক, ‘ভারতের বিপক্ষে শুরু থেকেই চাপ দিয়ে খেললো বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে করলো রক্ষণাত্মক মুডে। ২-০ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর আমরা অ্যাটাকিং খেলা শুরু করলাম। দ্বিতীয়ার্ধে অনেকগুলো কর্নার পেলো বাংলাদেশ। ওই অবস্থায় ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট হলেও জামাল ভূঁইয়াকে খেলানো দরকার ছিল। আগের ম্যাচে যেহেতু জামালের কর্নার থেকে হামজা গোল করেছেন কোচ সেই কম্বিনেশনটা আবার তৈরি করতে পারতেন।’
Advertisement
‘আরেকটি বিষয় হলো মো. রিদয়কে খেলানো ভুল ছিল। হামজার সাথে রিদয়ের সমন্বয়ই গড়ে ওঠেনি। এক সময় মনে হয়েছিল, কে কোন পজিশনে খেলছেন বোঝাই যাচ্ছিল না। সিনিয়র সোহেল রানাকে অনেকে বলেন সিন্ডিকেট ফুটবলার; কিন্তু সে তো ভুটানের বিপক্ষে ভালো খেলেছেন। গোল করেছেন। তাকে নেওয়া হয়নি। আবার দেখেন রাকিব গোল করেছেন সিঙ্গাপুরের ম্যাচে। স্কোরারকে নামিয়ে নেওয়া হলো রাইট ব্যাকে। রাকিবকে নিচে নামানোর সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী। ভুটানের বিপক্ষে তাজউদ্দিন তো ভালোই খেলেছেন। তাকে রাখা হলো না সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে। খেলোয়াড় পরিবর্তনে কোচের আরও কৌশলী হওয়া দরকার ছিল।’
কিছু বিষয় পছন্দ হয়নি সফিকুল ইসলাম মানিকের। এই যেমন, সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে কনসার্ট। ‘এটা কোনো টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ছিল না। ছিল না ফাইনালও। তাহলে কনসার্ট কেন করা হলো। এতে খেলোয়াড়দের কিছুটা হলেও মনসংযোগ বিঘ্নিত হয়। আমাদের ফোকাস দিতে হবে জয়ের দিকে। অন্য কোনো দিকে নয়।’
‘আরেকটি বিষয় হলো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে দলের তারকা খেলোয়াড়দের মনোসংযোগ ধরে রাখতে কোচের কঠোর হওয়া উচিত ছিল। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচের আগে হামজা ও শামিত যেভাবে ইন্টারভিউ দিয়েছেন, সেটা ঠিক হয়নি। কোচ থেকে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত আসা উচিত ছিল।’
‘বাফুফের হয়তো মার্কেটিং পলিসি ছিল। তবে কোচের সেটা অ্যালাউ করা উচিত হয়নি। কোচ নিষেধ করলে বাফুফে সভাপতিও হয়তো তাতে হস্তক্ষেপ করতেন না। কারণ, তিনিও ফুটবলার ছিলেন। এসব কারণে খেলোয়াড়দের মনোসংযোগ খেলা থেকে কিছুটা হলেও অন্যদিকে গিয়েছে। কেবল আনুষ্ঠানিক যে ব্রিফিংগুলো ছিল সেখানেই হামজা-শামিত থাকতে পারতেন। গণহারে ইন্টারভিউ, ছবি তোলা থেকে তাদের বিরত রাখা উচিত ছিল। তারা মুখে কিছু হয়তো বলেননি। তবে মনে মনে বিরক্ত হয়েছেন হয়তো। কারণে, এসবে অভ্যস্ত নন তারা'- বলেছেন সফিকুল ইসলাম মানিক।
অনেকদিন পর ফুটবল ঘিরে যে উত্তেজনা ও জাঁকজমক অবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে খুব খুশি মানিক। এই ক্রেজ ধরে রাখতে কয়েকটি উপায়ও বাতলে দিয়েছেন সাবেক এই তারকা ফুটবলার।
মানিক বলেন, ‘আমি মনে করি, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে থেকেই ফুটবলে এই পরিবর্তনটা দেখা গেছে। হামজা চৌধুরী আসার পর যে হাইপ তৈরি হয়েছিল তার জন্য ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি অনেকেই দেখেছেন। ফুটবলের নবজাগরণের সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। এখানে আমি একটু উদাহরণ হিসেবে বলবো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দর্শকদের মধ্যে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল তেমন ছিল সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ ঘিরে।’
‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জিতলে ওই রাতেই রাস্তায় মিছিল হতো। মানুষ মিছিল করে করে ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকা ছাড়তো। জিততে না পারায় দর্শকরা হয়তো হতাশ হয়েছে। তবে আশা ছাড়েনি। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবল ফেরাও জাগরণ তৈরি আরেকটা কারণ। ভুটানের বিপক্ষে জয়ের পর মানুষের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। কারণ, আগের ম্যাচে তো তাদের কাছে হেরেছিল। ওই ম্যাচ জেতায়ই দর্শক অনুপ্রেরণা পায়। আমরা যে দর্শক মিস করছিলাম সেটা দেখা গেছে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে। এই ম্যাচটির দিনক্ষণ অনেক আগেই ঠিক করা ছিল। যে কারণে অনেকে বিদেশ থেকেও ম্যাচ দেখতে আসার পরিকল্পনা করেছিল। এই স্টেডিয়ামের একটা ঐতিহ্য আছে। সেখানে ফুটবল ফেরা খুবই ইতিবাচক বিষয়।'
আপনি কি মনে করেন, এ জাগরণ আগামী ম্যাচগুলোতেও দেখা যাবে। এটা ধরে রাখতে হলে কি করা উচিত বাফুফের? ‘আমাদের আরও দুটি হোম ম্যাচ আছে। একটি হংকং ও আরেকটি ভারতের বিপক্ষে। কোন দলই কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। এই দুই ম্যাচ জেতা জরুরি। এই দুই ম্যাচ টার্গেট করে এখন থেকেই পরিকল্পনা সাজানো উচিত। জাতীয় দলের প্রস্তুতির জন্য সময় দিতে হবে। বাকি ম্যাচ চারটি কবে হবে তা নির্ধারিত। তাই ঘরোয়া সূচি এভাবে তৈরি করতে হবে যাতে কম হলেও ম্যাচের আগে এক সপ্তাহ প্রস্তুতি নেওয়া যায়। বাছাইয়ের ম্যাচ শেষ পর্যন্ত আমাদের জয়ের ফোকাসে থাকতে হবে'- জবাব মানিকের।
ঘরোয়া ফুটবল আরও সুন্দর ও প্রতিযোগিতামূলক করা দরকার বলেও মনে করেন মানিক। ‘ঘরোয়া ফুটবল বেশি জমলে জাতীয় দলের পাইপলাইনে খেলোয়াড় বেশি হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ে। এ মাসেই প্রবাসী ফুটবলারদের একটা ট্রায়াল আছে। আমি মনে করি, সেই ট্রায়ালে যদি ভালো খেলোয়াড় পাওয়া যায় তাহলে তাদের ঘরোয়া লিগে খেলার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তখন স্থানীয়রা প্রবাসীদের চেয়ে ভালো করতে চাইবে। প্রবাসীরাও স্থানীয়দের চেয়ে ভালো করতে চাইবে। এখন তো খেলোয়াড়দের লক্ষ্যই থাকে জাতীয় দল। সেখানে জায়গা নিতে কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে হবে। এমন যেন না হয় যে, গদবাঁধা কিছু খেলোয়াড় নিয়েই জাতীয় দল হয়। প্রবাসী আসায় এখন জাতীয় দলে ঢোকার চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। এটা আরও বাড়লে কোচও দল তৈরিতে অনেক অপশন পাবেন’- মনে করেন সফিকুল ইসলাম মানিক।
আরআই/আইএইচএস/