জুনের দুপুর। মাথার ওপর সূর্যের তাপ এমন, যেন কেউ আগুনের বর্ষণ করছে। বাতাসে শূন্যতা, নীরবতা। চারদিকে সবকিছু থমকে গেছে। অথচ এই রাজধানীর বুকে এক সময় গাছের শীতলতার অভাব ছিল না। গাছের ছায়ায় বসে দুপুরে লোকজন বিশ্রাম নিত। এখন? সেই জায়গাটায় এখন এক চকচকে কাঁচঘেরা দোকান কিংবা দালান। যার দরজায় দামি স্বয়ংক্রিয় গেট, আর ভেতরে চলছে এসি। এমন এক কৃত্রিম পরিবেশ যেখানে প্রাকৃতিক বাতাস ঢোকারও জায়গা নেই।
Advertisement
এই যে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, এই যে চারদিকে শুধু গরম আর ধুলাবালি এর জন্য দায়ী কে? কেউ না, আমরাই।
আমরা নিজের হাতে গাছ কেটেছি, আবার নিজের হাতেই শরীরের ঘাম মুছে দিয়ে বলি, ‘বৃষ্টি হয় না কেন?’ আমরা টিনের ছাদে এসি লাগাই, তারপর প্রশ্ন করি, ‘পুকুরের পানি শুকায় কেন?’ আমরা বর্ষায় ছবি তুলি জলাবদ্ধতায় দাঁড়িয়ে, অথচ গাছ লাগানোর সময় বলি, ‘জায়গা নাই ভাই।’ এই যে দ্বিমুখিতা, এখানেই শুরু মরুভূমির গল্প।
এই বাস্তবতাই আমাদের মনে করায়, কেন আজকের দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। আজ ১৭ জুন বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। একদিন বিশ্ব নেতারা বসে ঠিক করলেন, আমরা শুধু পরিবেশ রক্ষা করব, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করব, মরুভূমিকে থামাব। আর সেই অঙ্গীকারে প্রতিটি দেশের মানুষকে এই সমস্যার সচেতন করতে এ দিনটিকে বিশেষভাবে গঠন করা হলো। কারণ খরা আর মরুকরণ শুধু দূরের কোনো দেশ বা বস্তুর সমস্যা নয়, এটা আমাদের সবার ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি।
Advertisement
খরা আসছে কেবল আফ্রিকার বুকে নয়, এটা আসছে আমার আপনার বাসার উঠোনে। একদিন হয়তো আমাদের সন্তান বলবে, ‘বাবা তুমি কী সত্যিই ফলগাছ দেখেছো?’ আমরা হয়তো আফসোসের সুরে বলে উঠবো, ‘হ্যাঁ বাবা, তখন গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল আমাদের শহর, গ্রাম।’
মাটি আজ কথা বলছে না। তার ভেতরে নেই শীতলতা, নেই আর্দ্রতা। খালি রোদ খায়, পানি পেলেও ধরে না। কারণ তার শেকড় আর আগলে রাখে না গাছ।
এই পৃথিবী কারো একার নয়। কিন্তু আমরা একা একা সবকিছু কেটে নিচ্ছি, খেয়ে নিচ্ছি, ব্যবহার করছি। বিনিময়ে কিছুই ফিরিয়ে দিচ্ছি না। ভুলে গেছি, একটা গাছ কাটা মানে কেবল একটা কাঠ ফেলা নয়, সেটা মানে মরুকরণের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া।
মার্কিন জীব রসায়নবিদ এবং লেখক আইজ্যাক আসিমভ একবার বলেছিলেন, ‘মানবজাতি তার বন ধ্বংস করছে, যেন তারা বুঝতেই পারছে না যে এই বন ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।’
Advertisement
বিশ্ব আজ খরা প্রতিরোধের কথা বলছে। কিন্তু প্রতিরোধ কি বক্তৃতা দিয়ে হয়? হয় না। প্রতিরোধ শুরু হয় হাত মাটি লাগানো থেকে। গাছ লাগাও নিজের হাতে, নিজের উঠোনে, নিজের সন্তানের নামে। কারণ গাছ মানে কেবল ছায়া নয়, গাছ মানে একটি জীবনের গল্প।
জার্মান বন বিজ্ঞানী পিটার ওহলেবেন'র বক্তব্য অনুযায়ী, ‘যদি আমরা বনকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাই, তাহলে তাদের বড় হতে দিতে হবে।’
তবে শুধু গাছপালা লাগানোই যথেষ্ট নয়। খরা ও মরুকরণ রোধে আমাদের দরকার জল সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ, টেকসই কৃষি ও মাটির সুরক্ষা ব্যবস্থা, জলাধার ও পুকুর সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, মোকাবিলায় কার্বন নির্গমন হ্রাস, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
তবে এত কিছুর মাঝেও গাছ থেকেই শুরু হয় সবকিছু। একটা দেশ যত আধুনিক হবে, তার রাস্তায় তত বেশি গাছ থাকবে। আর যত গাছ কমবে, ততই মানুষ শহরে বন্দি হবে এসি ঘরে, কৃত্রিম বাতাসে, শুকনো জীবনে।
তাই আজকের দিনে বলি, আমরা যদি মরুভূমিকে থামাতে চাই, আমাদের ফিরতে হবে গাছের ছায়ায়। না হলে একদিন হয়তো দুপুরের ছায়া খুঁজে বেড়াবে সবাই, থাকবে না ঠান্ডা হাওয়া, থাকবে না ফল, থাকবে শুধু গল্প। সেই গল্প...যেই গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকবে গাছ।
আরও পড়ুন পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম বানিয়ে সফল রাজু শিশুশ্রম কি দারিদ্র্যেরই ফসল?কেএসকে/এএসএম