ড.ফোরকান আলী
Advertisement
পহেলা মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। প্রাসঙ্গিকভাবেই এ সময় শ্রমিকদের নিয়ে কিছু কথা হয়, কিছু লেখালেখি হয়, কিছু সেমিনার সিম্পোজিয়াম হয়, কিছু তথ্য হালনাগাদ করা হয় আর কিছু উদ্যোগের খবর জাতির সামনে পেশ করা হয়। কিন্তু সত্যিকারার্থে শ্রমিকদের উন্নয়ন হচ্ছে কতটুকু? তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও জানি এভাবে একটু একটু করেই হয়তো একদিন বাংলাদেশ থেকে তথা পুরো বিশ্ব থেকে শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ হবে এবং শ্রমিকদের জন্য শ্রমবান্ধব কর্মসংস্থান, শ্রমবান্ধব আইন, নিয়মনীতি, ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন হবে।
আমাদের দেশে কয়েক শ্রেণির শ্রমিক রয়েছেন। এদের একেক জনের মর্যাদা, সম্মান, বেতন, জীবিকা, জীবনযাত্রার মান একেক রকম। বলাই বাহুল্য এক্ষেত্রে পাহাড়সম বৈষম্য দৃশ্যমান। সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে বেসরকারি চাকুরের ব্যবধান অনেক। আবার সরকারি চাকরিতে যে বিভিন্ন গ্রেড রয়েছে তাতেও আকাশাপাতাল ব্যবধান দৃষ্টিকটু। তা ছাড়া চাকুরে ছাড়াও অন্যান্য পেশার মানুষের যেমন-রিকশাওয়ালা, বাসশ্রমিক, ঘাটশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, গৃহকর্মী, কারখানা শ্রমিকদের মধ্যকার ব্যবধানও চরম বৈষম্যপূর্ণ। ফলে দিনরাত কাজ করতে হয়, বাবা-মাকে এমনকি সঙ্গে শিশু সন্তানকেও। সবচেয়ে অবাক বিষয় পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রেরও বড্ড অভাব। তাই এমন অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ আছে যারা সংসার চালাতে গিয়ে নিজের ছোট্ট শিশুকে ঠেলে দেয় কর্মজগতে, যাতে তার আয় দিয়ে সংসারটাকে কোনোভাবে টেনেটুনে চালানো যায়। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একটি ভয়াবহ সমস্যা হলো শিশুশ্রম।
শিশুশ্রমবাংলাদেশ জাতীয় শ্রমআইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখন প্রায় ৩৫ লাখ শিশু কাজ করছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু এমন কাজে জড়িত যা শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য।
Advertisement
বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। একজন শিশু বা কিশোর যখন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা তখন পেটের দায়ে বাবা-মা নিজেরাই তাদের হাতে বইয়ের বদলে তুলে দেন শ্রমের জোয়াল। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছ না।
শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তাহীনতাএতো গেলো শিশু-কিশোরদের শ্রমের কথা, কিন্তু এরচেয়েও ভয়াবহ আরেকটি দিক হচ্ছে এই সব কাজে শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তাহীনতা। সরকারি হিসেবে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। এর মধ্যে আড়াই লাখেরও বেশি শিশু মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। বিভিন্ন যানবাহনে, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে চলা অননুমোদিত বিভিন্ন হিউম্যান হলারে, নির্মাণ কারখানায়, ইটের ভাটায়সহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। এসব কাজে শিশুদের শারীরিক মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকারও হতে হয়। শ্রমক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে না পড়লেও বেশ কিছু সেমিনারে প্রস্তাব এসেছে শিশুবান্ধব পুলিশ বা থানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। বিভিন্ন কলকারখানা বা কর্মক্ষেত্র ছাড়াও বাসাবাড়িতে কাজ করা শিশুদের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। তবে এদের বেশিরভাগই হচ্ছে নারীশিশু। যারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। এছাড়াও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।
কিশোর শ্রম আইনের কথাবাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু-কিশোর। আর এ শিশু-কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমজীবী। শ্রমজীবী শিশু-কিশোরদের জন্য আমাদের দেশে কিছু আইন-কানুন রয়েছে। এগুলো সবাইকে মেনে চলা প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। এর ফলে শ্রমজীবী কিশোর-কিশোরীরা লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হয় এবং তাদের সার্বিক দুর্দশা বেড়ে যায়।
শিশু-কিশোরের সংজ্ঞাপ্রথমেই দেখা যাক, শ্রম আইন অনুযায়ী, শিশু-কিশোরের সংজ্ঞা কী। বাংলাদেশ শ্রম আইনে বলা হয়েছে-ধারা-২ : সংজ্ঞাসমূহ- বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোনো কিছু না থাকিলে, এ আইনে- (৮) ‘কিশোর’ অর্থ চৌদ্দ বছর বয়স পূর্ণ করেছেন কিন্তু আঠার বছর বয়স পূর্ণ করেননি এমন কোন ব্যক্তি; (৬৩) ‘শিশু’ অর্থ চৌদ্দ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোন ব্যক্তি।
Advertisement
ধারা-৩৬ : বয়স সম্পর্কে বিরোধ (১) যদি কোনো ব্যক্তি শিশু কি কিশোর এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তাহলে পরিদর্শক প্রশ্নটি, কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বয়স সংক্রান্ত প্রত্যায়নপত্রের অবর্তমানে, কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের নিকট সিদ্ধান্তের জন্য প্রেরণ করবেন। (২) উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত কোনো ব্যক্তির বয়স সংক্রান্ত প্রত্যায়নপত্র তার বয়স সম্পর্কে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে।
কিশোর শ্রমিকের কর্মঘণ্টাঅনেক মালিক কিশোরদের দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করিয়ে নেন। এটি বেআইনি। এতে ওদের কচি দেহ ও কোমল মনের ভারসাম্য বজায় থাকে না। আইনে কিশোরদের একটি কর্মঘণ্টা রয়েছে। ধারা- ৪১ : কিশোরের কর্মঘণ্টা-(১) কোনো কিশোরকে কোনো কারখানা বা খনিতে দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার অধিক এবং সপ্তাহে ত্রিশ ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করতে দেয়া হবে না। (২) কোনো কিশোরকে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে দৈনিক সাত ঘণ্টার অধিক এবং সপ্তাহে বিয়াল্লিশ ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করতে দেয়া যাবে না। (৩) কোনো কিশোরকে কোনো প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা ৭ ঘটিকা থেকে সকাল ৭ ঘটিকার মধ্যবর্তী সময়ে কোনো কাজ করতে দেওয়া যাবে না। (৪) যদি কোনো কিশোর অধিককাল কাজ করেন, তাহলে অধিককালসহ তার কাজের মোট সময়- ক. কারখানা বা খনির ক্ষেত্রে, সপ্তাহে ছত্রিশ ঘণ্টা; খ. অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, সপ্তাহে আটচল্লিশ ঘণ্টা; এর অধিক হবে না। (৫) কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো কিশোরের কাজের সময় দু’টি পালায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, এবং এর কোনো পালার সময়সীমা সাড়ে সাত ঘণ্টার বেশি হবে না। (৬) কোনো কিশোরকে কেবলমাত্র একটি রিলেতে নিয়োগ করা যাবে এবং পরিদর্শকের নিকট হতে লিখিত পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত ত্রিশ দিনের মধ্যে তা একবারের বেশি পরিবর্তন করা যাবে না। (৭) এ আইনের অধীন সাপ্তাহিক ছুটি সংক্রান্ত বিধান কিশোর শ্রমিকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে এবং এ বিধানের প্রয়োগ কিশোর শ্রমিকের ক্ষেত্রে স্থগিত করা যাবে না। (৮) একই দিনে কোনো কিশোর একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন না।
ধারা-৪৩: কিশোরের কাজের সময়ের নোটিশ (১) কোন প্রতিষ্ঠানে কিশোর শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে তাতে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে কিশোরের কর্মঘণ্টা সম্পর্কে, তার কাজের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখসহ, একটি নোটিশ প্রদর্শন করতে হবে। (২) উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত নোটিশে প্রদর্শিত সময় কাজ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে, প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের ক্ষেত্রে যেভাবে স্থির করতে হবে, এবং তা এমন হবে যেন উক্ত সময়ে কর্মরত কোন কিশোরকে এ আইনের খেলাপ কোন কাজ করতে না হয়। (৩) কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এতদসংক্রান্ত বিধান উপ-ধারা (১)-এর অধীন নোটিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। (৪) সরকার বিধি দ্বারা উক্ত নোটিশের ফরম এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবে।
কিশোর শ্রমিকের ছুটিকর্মে নিযুক্ত কিশোর-কিশোরীদেরকে বছরে নির্ধারিত নিয়মে বার্ষিক ছুটি প্রদানের বিধান রয়েছে। এ ছুটি কারখানা, চা-বাগান, দোকান-বাণিজ্য বা শিল্প প্রতিষ্ঠান সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধারা-১১৭: মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি (২) কোনো প্রতিষ্ঠানে অবিচ্ছিন্নভাবে এক বছর চাকরি পূর্ণ করছেন এমন প্রত্যেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিককে পরবর্তী বারো মাস সময়ে তার পূর্ববর্তী বারো মাসের কাজের জন্য মজুরিসহ নিম্নবর্ণিত হারে গণনার ভিত্তিতে ছুটি মঞ্জুর করতে হবে; যথা- ক. কোনো কারখানার ক্ষেত্রে, প্রতি পনের দিন কাজের জন্য একদিন; খ. কোনো চা-বাগানের ক্ষেত্রে, প্রতি আঠার দিন কাজের জন্য একদিন; গ. কোনো দোকান বা বাণিজ্য অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, প্রতি চৌদ্দ দিন কাজের জন্য একদিন। (৬) উপ-ধারা (৪)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের এ ধারার অধীন ছুটি পাওনা বন্ধ হয়ে যাবে যখন তার পাওনা অর্জিত ছুটি- ক. কোনো কারখানা অথবা চা-বাগানের ক্ষেত্রে, ষাট দিন; খ. কোন দোকান বা বাণিজ্য অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, আশি দিন হয়।
ধারা-১১৯ : ছুটি অথবা বন্ধের সময়ের মজুরি হিসাব ও প্রদান (২) যদি কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিককে একসঙ্গে অন্যূন চার দিনের এবং কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিককে একসঙ্গে অনূন্য পাঁচ দিনের বার্ষিক ছুটি মঞ্জুর করা হয় তাহলে, যতদূর সম্ভব, তার ছুটি শুরু হবার আগে তাকে ছুটির মজুরি প্রদান করতে হবে।
বেআইনিভাবে কিশোরকে কাজে নিয়োগ বা চুক্তির শাস্তি:কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা দপ্তর শ্রম আইনের বিধান অমান্য করে কিশোর-কিশোরীকে কাজে নিয়োগ দিলে বা চুক্তি করলে তাকে দণ্ড পেতে হবে। আইনে বলা হয়েছে-ধারা-৩৫ : শিশু সংক্রান্ত কতিপয় চুক্তির ব্যাপারে বাধা-নিষেধ এ অধ্যায়ের বিধান সাপেক্ষে, কোনো শিশুর মাতা-পিতা বা অভিভাবক শিশুকে কোনো কাজে নিয়োগের অনুমতি প্রদান করে কারো সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবেন না।
ব্যাখ্যা এ ধারায় ‘অভিভাবক’ বলতে শিশুর আইনগত হেফাজতকারী বা শিশুর ওপর কর্তৃত্ব আছে- এমন যে কোনো ব্যক্তিকেও বুঝাবে। ধারা-২৮৪ : শিশু এবং কিশোর নিয়োগের জন্য দণ্ড কোন ব্যক্তি কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে, অথবা এ আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরি করার অনুমতি দিলে, তিনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
ধারা-২৮৫ : ধারা ৩৫ লংঘন করে শিশু সম্পর্কে কোনো চুক্তি করার দণ্ড কোনো শিশুর পিতা-মাতা বা অভিভাবক ধারা ৩৫-এর বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশু সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদন করলে, তিনি এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
গৃহকর্মী হিসেবে কিশোর-কিশোরীউপরে উল্লেখিত আইন কানুন শ্রমজীবী কিশোর-কিশোরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও গৃহকর্মে নিযুক্ত কিশোর-কিশোরীদের প্রযোজ্য হয় না। গৃহকর্মীদেরকে এখনো দেশের প্রচলিত শ্রম আইনের আওতাভুক্ত করা হয়নি। যদিও ওরা সংখ্যায় অনেক। এ প্রেক্ষিতে মাননীয় হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে এক রিট মামলার শুনানি শেষে এতদ্সংক্রান্ত আইনগত দিক নির্দেশনা দেন। ১২ বছরের কম বয়সীদের গৃহকর্মের কাজে নিয়োগ দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী গৃহপরিচারীকাদের সুরক্ষা ও শিক্ষাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বলেছেন আদালত।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা, ২০১০ : সরকার ২০১০ সালে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছেন। এ নীতিমালায়, ১৪ বছরের নিচে কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই নিবন্ধন করতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক গৃহকর্মীর ক্ষেত্রে অভিভাবকের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। গৃহকর্মীকে নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দিতে হবে। ওকে তার মজুরি পরিশোধ করতে হবে মাসের প্রথম সপ্তাহে। সপ্তাহে একদিন ছুটি দিতে হবে। অসুস্থাবস্থায় ওকে কাজে বাধ্য করা যাবে না। চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে বাড়িতে পাঠানো যাবে না। এ বিষয়গুলো সরেজমিনে দেখভাল করার জন্য সরকার উপযুক্ত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করবেন ইত্যাদি। এ নীতি আইন হিসেবে কার্যকর আছে। এসবের পাশাপাশি ‘গৃহ শ্রমিকের জন্য শোভন কাজ’ শীর্ষক আইএলও কনভেনশন (নং. ১৮৯) অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করা আশু প্রয়োজন। তবেই ওরা একদিন জাতির বোঝা না হয়ে সম্পদ হয়ে উঠবে।
শৈশব বিক্রি করা শিশুশ্রমিকপরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, দেশের ৩৫ লাখ শিশুশ্রমিকের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১৩ লাখ শিশু, যা মোট শিশুশ্রমিকের ৪১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের শিশুশ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৩ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে ৬ থেকে ১৬ বছরের মোট ৪ লাখ ২০ হাজার শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে। এদের শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। এই পরিসংখ্যানের বাইরে যে কত শত শিশুশ্রমিক আছে, সেই হিসাব নেই।
জাতীয় শিশুনীতি ২০১১-তে শিশু-কিশোরদের যে সংজ্ঞা রয়েছে তা হলো, শিশু বলতে আঠারো বছরের কম বয়সী সকল ব্যক্তিকে বুঝাবে। কিশোর-কিশোরী বলতে ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে বোঝাবে। শিশু ও মহিলা অধিদফতরের তথ্যানুসারে ১৮ বছরের কম বয়সের জনসংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ যা মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। এই শিশুনীতির ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘শিশু জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। শিশুকে পূর্ণ মর্যাদাবান মানুষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। দেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত রয়েছে।
সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪, ৩৭,৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ এ সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এ শিশুদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ এ শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় শিশু আইন ১৯৭৪ যা যুগোপযোগীকরণে ২০১১ রূপে প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড, সিআরসি) ১৯৮৯ এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করা হয়। শিশুনীতি বাস্তবায়ন হলে শিশুদেরকে আনন্দের শৈশবকে বিক্রি করতে হবে না। বই-খাতার বদলে হাতুড়ি শাবল হাতে নিয়ে শিশুশ্রমিকের অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াতে হবে না।
আরও পড়ুন তুষারের শহর থেকে মহাকাশে লাইকা চরাঞ্চলে একমাত্র যান ঘোড়ার গাড়িলেখক: গবেষক ও সাবেক অধক্ষ
কেএসকে/এএসএম